মঙ্গলবার, ২১ মার্চ ২০২৩, ১০:৫৪ পূর্বাহ্ন

করোনায় কৃষকের দিনকাল

  • আপডেট টাইম বৃহস্পতিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২০, ৫.০১ পিএম

গোলাম মোস্তফা


ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে। যেনো আকাশ কাঁদছে। কলিমউদ্দিনের মাথায় হাত। ধানে পাক ধরেছে। কয়েক দিন পর কাটতে হবে। দিনমজুর পাওয়া যাচ্ছে না। এলাকার দিনমজুরগুলোরও দম ফেলার ফুসরত নেই। তার উপরে চলছে করোনার ভয়। সহজে কেউ কারোর বাড়ি যাচ্ছে না। তাই কলিমউদ্দিন ধান কাটা নিয়ে চিন্তায় আছে।

এবার এলাকায় ধান অবশ্য মানুষ কম লাগিয়েছে। কেনোনা গত কয়েক বছর ধরে ধান চাষ করে কৃষকের খরচ পর্যন্ত ওঠেনি। তাই এলাকায় ধান চাষ কম। কিন্তু করোনার কারণে মানুষের চিন্তা বেড়েছে। সবাই এখন খাদ্য মজুদের চিন্তায় পড়ছে। অন্তত পেটে খেয়ে বাঁচতে হবে।সেই চিন্তায় অনেকের সাথে কথা বলে জানলাম ধান এবার তারা কম বিক্রি করবেন। আর গত কয়েকবছরের তুলনায় লাগিয়েছেনও কম।

কেউ কেউ শুধু বছরে খাবারের জন্য যতটুকু লাগে ততটুকু ধান লাগিয়েছেন। ফলে এবার দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা মানুষগুলো খাদ্য সংকটে পড়তে পারেন। অতএব কৃষিতে প্রণোদনা জোগানোর বিকল্প ভাবার সূযোগ নেই। তাই দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বোঝার এখনই উপযুক্ত সময়।

যেসব কৃষকেরা সবজী আবাদ করেছিলেন তারা পুরো লসের কবলে পড়েছেন। ভাল দাম পাচ্ছেন না। বিশেষ করে কৃষক দাম পাচ্ছেন না। যেসব সবজী অল্পদিনের মধ্যে উৎপাদিত হয় এবং দ্রুত বিক্রি করতে হয় সেইসব সবজীর দাম এবার কৃষক করোনার কারণে পেলোনা। কেনোনা সবজী তো বাইরে রপ্তানি হয়নি। ফলে স্হানীয় বাজারে সস্তায় এসব সবজী বিক্রি করতে হয়েছে।

গ্রামের প্রায় প্রতি বাড়িতেই দেশি হাস মুরগী থাকে। কিন্তু এই সময়টাতে রাণীক্ষেত রোগ বেশি হয়। নবম দশম শ্রেণির কৃষিশিক্ষা বই ঘেটে দেখলাম হাঁস মুরগীর রাণীক্ষেত রোগটি ভাইরাসজনিত৷ ফলে কোনো একটা হাঁসমুরগির হলে পরে সেই বাড়ির সব হাস মুরগী দুই তিন দিনের ভেতর মারা যায়। এই রোগ হলে হাস মুরগী চুনা পায়খানা করে, ঝিমায় এবং ঘড়ঘড় শব্দ করে অনেকসময়। তো এই সময়টাতে করোনা হবার কারণে পশু হাসপাতাল বন্ধ। ফলে সরকারি হাসপাতাল থেকে রাণীক্ষেত রোগের টিকা পাওয়া যাচ্ছেনা। ভেটেরিনারি ফার্মেসি থেকে কিনতে অনেক টাকা খরচ করতে হচ্ছে। তাছাড়া তেমন বাইরে যাবারও উপায় নেই।

অন্যদিকে একটা বাড়িতে হয়ত একটা মুরগি দেশীয় পদ্ধতিতে দশটা ডিম নিয়ে বসেছে। সেখান থেকে হয়ত আটটা বাচ্চা ফুটল। তো এই আটটা বাচ্চার জন্য অতটাকা দিয়ে ফার্মেসি থেকে টিকা কিনে এনে দেওয়ার কাজটা কেউ করতে চাইবে না।আমার এলকায় দেখলাম বেশিরভাগ বাড়িতে রাণীক্ষেত রোগের কারণে সব হাস মুরগী মারা গেছে। ফলে কৃষি পরিবারও খুব একটা স্বস্তিবোধ করছে না। পরম মমতায় যে গৃহিণী তার ছাগলটি পুষছেন, হাসমুরগী পুষছেন, লাউ কুমড়ার চাষ করছেন, তিনি যদি তা ভাল দামে বেচতে না পারেন অথবা তা মারা যায় তাহলে তার দুঃখের শেষ থাকে না।

কৃষক পরিবারে ব্যাপরটা এমন হয়ে গেছে যে আলুর লাভ ঝালের ভিতর। কথাটার মানে হল- কোনো আবাদ থেকে যতটুকু বাড়তি হচ্ছে ততটুকু অন্য আবাদে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে।

এখনকার কৃষকের ছেলে মেয়েরা প্রায় অধিকাংশ পড়ালেখা করছে। তাই কৃষকের ঘরে সাচ্চা কৃষক কম তৈরী হচ্ছে। কৃষক বলছে – সারা জীবন আমি খাটুনি করলাম। আমার ছেলে মেয়ে যেনো এরকমটি না করে। এই চিন্তা থেকেই পড়ালেখা করাচ্ছে। পড়ালেখা করাতে গিয়েও কি শান্তি আছে! প্রাইভেট পড়াতে পড়াতে জীবন শেষ। প্রাইভেট না পড়লে পিছিয়ে পড়বে। এই পিছিয়ে পড়তে কেউ চায় না।

অনেক কৃষক কিন্তু তার ছেলে মেয়েকে পড়াতে গিয়ে জমিও বিক্রি করছে। গ্রামের কোনো পরিবারের চাকরিজীবী সদস্য সেই জমি কিনছে। কৃষক শান্তি পাচ্ছে এই ভেবে যে তার ছেলে মেয়েও যখন পড়াশোনা করে চাকরি করবে তখন তারাও এরকম জমি অনেক কিনতে পারবে!! কৃষকের ছেলে মেয়েকে পড়ানোর উদ্দেশ্য হল – চাকরি পাওয়া। কিন্তু এত চাকরি কোথা থেকে আসবে সেই ভাবনা কি কারো আছে!!

অনেকের ছেলে মেয়ে স্হানীয় সরকারি বেসরকারি কলেজ থেকে অনার্স, মাস্টার্স, বিএ পাশ করে চাকরি পাচ্ছে না। তখন মামা খালু না থাকলে চাকরি হয় না- এই ধারনাও অধিকাংশ কৃষক পেয়ে গেছে। সত্যিসত্যি এই করোনায় কৃষকের দূর্গতি তাই আরো বেড়েছে।

‘সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা’- কবির এই উক্তি এখন কেবল খাতা কলমে টিকে আছে। কৃষকের কোনো সম্মান নেই প্রকৃত অর্থে। কেনোনা শিক্ষিত মহলের কাছে অফিসার পুত্র কন্যার যতোটা সুযোগ আমি পেতে দেখি, কৃষক সন্তানের ততোটা সুযোগ পেতে দেখি না। তবে বর্তমান সরকার বেশ এই ব্যবধান ঘোচাতে কাজ করেছে। আমার দাবি দেশের কৃষকদেরকে সম্মানিত করা হোক রাষ্ট্রীয়ভাবে। কৃষিতে ভুর্তকী দেয়া হোক ব্যাপকভাবে।

করোনায় কৃষক চিন্তায় আছে। ভাল নেই কৃষকের মনমানসিকতা। ধান কাটা নিয়ে যে তামাশা চলছে তাতে কৃষক বিস্মিত এবং চিন্তিত। জমিতে ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভাল দম পাচ্ছে না। সন্তানের প্রাইভেটের টাকা জোগাড় করতে পারছে না। যেনো সাধ না মিটিল আশা না পুরিল।


লেখকঃ প্রতিষ্ঠাতা এবং পরিচালক, বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট প্রোটেকশন সোসাইটি (বিইপিএস)।

The Campus Today YouTube Channel

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
themesbazar_creativenews_II7
All rights reserved © 2019-20 The Campus Today