কেমন আছে মতিহারের সবুজ চত্বর?

আনন্দ কুমার সাহা


রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩৮ হাজার, শিক্ষকদের সংখ্যা ১২০০’র অধিক, কর্মকর্তার সংখ্যা প্রায় ৭৫০, কর্মচারীর সংখ্যা ১৭০০’র অধিক। পরিবার-পরিজনসহ প্রায় অর্ধ লক্ষ মানুষের সমাগম এই মতিহার ক্যাম্পাসে। কিন্তু বর্তমানে এই ক্যাম্পাস প্রাণহীন-মৃতপ্রায়।

তবু এর মধ্যেও বেশ কয়েকজন ক্যাম্পাস বাসিন্দা সকাল-সন্ধ্যায় নিয়মিত প্যারিসরোডে হাঁটা-চলাফেরা করে থাকেন। তবে বেশী দেখামেলে পক্ষীকূলের। ফাঁকা ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ধরনের পাখির দেখা মিলছে; যার মধ্যে শালিক-ঘুঘুর আধিক্য বেশী। সাদা বকগুলো বধ্যভূমি থেকে মধ্য ক্যাম্পাস পর্যন্ত আহারের জন্য বিচরণ করছে। ঘুঘু পাখিগুলোকে স্বাভাবিক সময়ে রাস্তায় কিংবা প্যারিস রোডে এভাবে দেখা যেতো না। ঘুম থেকে উঠেই প্যারিস রোডে তাদের বিচরণ বেশ ভাল লাগে।

রাবি করোনা

ক্যাম্পাসে প্রায় ৫৬টি কুকুর বিভিন্ন জায়গায় বিচরণ করছে। কাজলা গেট দিয়ে প্রবেশ করে প্যারিসরোডে ৮-১০টি, কিছুদূর এগিয়ে উপাচার্য মহোদয়ের বাসভবনের সামনে ৪-৫টি, সিনেট এবং প্রশাসন ভবন এলাকায় ১০-১২টি, শহীদ মিনার, অডিটরিয়াম, বিনোদপুর গেট বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছু সংখ্যক কুকুরকে সন্ধ্যার দিকে বিশ্রাম নিতে দেখা যায়। ছাত্র-কর্মচারী এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এগিয়ে এসেছেন তাদের তদারকির জন্যে এটা দেখে খুব ভাল লাগে।

রাবি কুকুর

টিএসসিসি’র একজন কর্মচারী গাজীভাই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেলেই তিনি বাসা থেকে খিচুড়ি রান্না করে কুকুরদের খাওয়াতেন। এসময়েও এর ব্যতিক্রম হয়নি, প্রতিদিন টিএসসিসি-তে রান্না করে দুপুরে বিভিন্ন জায়গায় কুকুরদের খাবার পরিবেশন করেন তিনি। গাজী সাহেবের সঙ্গে যোগদান করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

রাবি কুকুর খাবার

কৃষি প্রকল্পের পক্ষ থেকে চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, মরিচ সরবরাহ করা হয় এবং গাজী সাহেবকে সাহায্য করার জন্য কৃষি প্রকল্প থেকে একজনকে তার সাথে কাজ করার জন্য নির্ধারিত করা হয়েছে। মাননীয় উপাচার্য মহোদয়ের বাসভবন থেকে মাঝে মাঝে রাতে কুকুরের খাবার দেয়া হয়ে থাকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র প্রসেনজিৎ এবং তার কয়েকজন বন্ধু মিলে দুপুরে রাকসু ভবনের সামনে খিচুড়ি রান্না করে কুকুরদের সন্ধ্যায় খাবার সরবরাহ করে থাকে। এভাবেই ছাত্র-শিক্ষক, কর্মচারী-কর্মকর্তা এগিয়ে এসেছেন বিভিন্নভাবে দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য।

রাবি কুকুর খাবার

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কল্যাণ তহবিলে দান করেছেন ১ কোটি টাকা। উপ-উপাচার্য চৌধুরী মো. জাকারিয়ার নেতৃত্বে রসায়ন বিভাগ প্রস্তুত করেছে স্যানিটাইজার। যা বিভিন্ন মহলে বিতরণ করা হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি দান করেছেন এক দিনের বেতন।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অতিথি পাখি এসেছিলো প্রচুর সংখ্যক। আশ্রয় নিয়েছিলো তৃতীয় বিজ্ঞান ভবনের পিছনের পুকুরে এবং রোকেয়া হল সংলগ্ন পুকুরে। ইতোমধ্যে কচুরিপানায় ভরে গিয়েছে তৃতীয় বিজ্ঞান ভবনের পিছনের পুকুর, দেখা যাচ্ছে না অতিথি পাখিদের।

ক্যাম্পাসে আম-লিচু গাছে প্রচুর মুকুল এসেছিলো। কিন্তু সে পরিমাণ আম ধরে নাই। অবশ্য যা আছে মোটামুটি তাও কম নয়। প্রশাসন ভবনের পাশের গাছগুলোর আমে যখন রোদের আলো পড়ে, খুব সুন্দর লাগে। হেঁটে যেতে মাথায় ঠেকে যায় আমগুলো। রবীন্দ্রভবনের সামনে টুকিটাকি সংলগ্ন ছোট্ট একটি গাছে আম ধরেছে, বেশ বড়ও হয়েছে, মাটি ছুঁই ছুঁই।

তাদেরকে বিরক্ত করছে না কেউ। যারা বিরক্ত করবে- তারাতো এখন হোম কোয়ারেন্টাইনে। গত বছরে কোন এক সময় লিচুতে কেবল রং ধরেছে এক দিনেই অপরিপক্ক সে লিচুর অর্ধেক শেষ। এটা কি খাওয়ার জন্য সুস্বাদু ছিলো, না তাও নয়। বয়সের কারণে, বান্ধবীদের বীরত্ব দেখানোর জন্য লিচু পাড়া।

গত বছর রোকেয়া হলের পিছন থেকে আম পাড়াকে কেন্দ্র করে ভীষণ গণ্ডগোল। অবশেষে ১০টি গাছের লিচু, ২০টি গাছের আম পাকার পূর্বেই শেষ। দেখে মনে হয়েছিলো ধ্বংসযজ্ঞ, কালবৈশাখীর ঝড়ে লণ্ডভণ্ড। এবার এখনও কোন আমবাগানে পাহারাদার নেই, তবুও আমগুলো মাটি ছুঁই ছুঁই আমগাছের নিচে অজস্র ছোট ছোট আম পড়ে আছে। কুড়ানোর পরও গাছের নীচে বিছিয়ে আছে প্রচুর আম। বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে আম ঝরে পড়ে যাচ্ছে।

আমগুলো বলছে- ‘আমার খেলার সাথীরা তোমরা কোথায়? বড্ড মিস্ করছি তোমাদের’।

রাবি আম গাছ

এরই মধ্যে দায়িত্বপালন করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রহরীরা, ফুলগাছগুলোতে পানি দিচ্ছে মালীরা। মধ্য ক্যাম্পাস, পশ্চিম এবং পূর্ব পাড়া সযত্নে পরিষ্কার করছে পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা। বিকট গন্ধের মধ্যে ডাস্টবিনগুলো পরিষ্কার করছে পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা। কেউ কেউ বলে থাকেন ওরা কাজ করে না। কিন্তু একবার ভাবুনতো, যারা ডাস্টবিনগুলো প্রতিনিয়ত পরিষ্কার করছে, সমাজে এ ধরনের কাজ আমরা কতজন করি। কি দিতে পারি আমরা তাদের? একটি হুইল সাবান দিয়েছি এতেই খুশি তারা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদমিনার চত্ত্বরের ঘাসগুলো সবুজ হয়েছে। গত দেড়মাস থেকে সেখানে এক নাগাড়ে পানি দেয়া হচ্ছে ঘাসগুলোকে সতেজ সবুজ রাখার জন্য। প্রচণ্ড খরাতে অনেক জায়গার ঘাস পুড়ে গিয়েছে। কিন্তু শহীদমিনারের সবুজ ঘাস ডাকছে তার বন্ধুদের। প্রতি সন্ধ্যায় দেখা হতো তাদের সাথে যারা জন্মদিন পালন করতো, যারা আঞ্চলিক সংগঠনের সভা করতো সাংস্কৃতিক জোটের কর্মীদের ভীষণ মিস্ করছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদমিনার।

ভীষণ মিস্ করছে, নব নির্মিত জিমনেশিয়ামের পাশ্ববর্তী মাঠটি। ফল এসেছে মালটা গাছে। দেখতে ভীষণ ভাল লাগছে গাছগুলোকে। গাঢ় সবুজ পাতাগুলো দেখতে ভীষণ সুন্দর। কাঠবাদাম গাছগুলো যত্নে অত্যন্ত সুন্দর হয়েছে। পাশে দাঁড়ানো পলাশ গাছে নতুন কচিপাতা, কি অপূর্ব পরিবেশ দেখার কেউ নেই।

রাবি

বধ্যভূমি- সে আর আগের মতো নেই। চারিদিকে জঙ্গল ছিলো, এক ভূতুড়ে পরিবেশ। কিন্তু বধ্যভূমির সামনে চেয়ার-টেবিলে বসে থাকে পুলিশ ভাইয়েরা। পাশেই রয়েছে- ‘শতবর্ষে শতপ্রাণ’। দক্ষিণ দিকে ভীষণ মিষ্টি ফল- সবেদার বাগান মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আখের জমিতে প্রচণ্ড রোদের মধ্যে কোদাল দিয়ে জমি পরিষ্কার করছে শ্রমজীবী মানুষ। কথা রাখছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনার- ‘এক ইঞ্চি জমি অনাবাদি রাখা হবে না’।

সবই আছে, এ মুহূর্তে নেই যাদের জন্য এ ক্যাম্পাস। কোথায় আছে, কেমন আছে! জানিনা। সবাই ভাল থাকুক, নিরাপদে থাকুক, ফিরে আসুক তাদের প্রিয় মতিহারে। জয় বাংলা।


লেখকঃ প্রফেসর আনন্দ কুমার সাহা, উপ-উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন
fb-share-icon
Tweet

এই বিভাগের আরও সংবাদ

Leave a Comment