সোমবার, ২৯ মে ২০২৩, ০৮:১১ পূর্বাহ্ন

জীবন সংগ্রামে একজন বীর যোদ্ধা কুবির আব্বাস উদ্দীন

  • আপডেট টাইম শনিবার, ১২ নভেম্বর, ২০২২, ৪.০৭ পিএম

মোহাম্মদ রাজিব, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়: ছোটবেলা থেকে অদম্য মেধাবী আব্বাস উদ্দীনের প্রধান প্রতিবদ্ধকতা আর্থিক টানাপোড়ন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে বাবা হারানোর পর থেকে আর্থিক প্রতিবদ্ধকতা বারবার তাড়া করেছে তাকে। ঠিক তখন থেকেই বীরের মতো আব্বাস কখনো নির্মাণ শ্রমিক, কখনোবা দর্জির কাজ করে সংসার টেনে নিয়ে যাচ্ছেন।

সম্প্রতি সে ঝালমুড়ি বিক্রি শুরু করেছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস গেইটে। কথাগুলো বলছি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের (২০২০-২১) শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আব্বাস উদ্দীনের।

অদম্য মেধাবী আব্বাস ছোটবেলা থেকে পড়াশুনায় অন্যদের মতোই বড় স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠছিলেন। কিন্তু শুরু থেকেই আর্থিক অনটন, বাবা-মায়ের টানাপোড়নে সংসারের তাকে নানা রকম বাধাবিপত্তি মুখোমুখি হতে হয়েছে।তবুও আব্বাস দমে যাননি,পিছপা হননি কখনো।কবি নজরুলের সেই অমর রচনা বিদ্রোহী কবিতার মতোই প্রতিটি ক্ষেত্রে লড়াই করেছে বীরের মতো।আবার মাত্র ১৪ বছর বয়সে বাবাকে হারানো তাকেঁ অথৈ সাগরে ফেলে দেয়। একদিকে বাবা হারানো অন্যদিকে পড়াশুনা চালিয়ে নেওয়া প্রবল আগ্রহ। তখনি তার পাশে দাড়াঁয় বড় ভাই আক্কাস উদ্দিন। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাবে বড় ভাইয়ের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে ফের দুঃখ দুর্দশা নেমে আসে পরিবারে।

তিন ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট আব্বাস। ভাই আক্কাস ও বোন ফাতেমার বিয়ে হয়ে গেলে মা শাহানারা বেগমকে নিয়ে একাই সংসার চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

নবম শ্রেণীতে পড়াকালীন সময় থেকে চাকুরি করে নিজের পরিবারের পাশে দাড়াঁন তিনি। দর্জি, রাজমিস্ত্রির সহকারী(হেলপার), ভিডিও ফটোগ্রাফীসহ নানারকম কাজ করতে হয় তাকে। তবে পাশাপাশি পড়াশুনার অদম্য আগ্রহ তাকেঁ বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি জীবনযুদ্ধে । তার সাথে কথা বলে জানা যায়,বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই ছোট্ট একটি বাসায় মাকে নিয়ে বসবাস করেন আব্বাস। সম্প্রতি সংসারের টানাপোড়ন নিয়ে চিন্তার ভাঁজ পড়ে আব্বাসের কপালে। তখনি মাথায় আসে ক্যাম্পাসের সামনে ঝালমুড়ি বিক্রির। পড়াশুনার পাশাপাশি ঝালমুড়ি বিক্রি করে নিজের পড়াশুনা ও সংসার চালাতে হচ্ছে বলে জানান আব্বাস। তিনি বলেন, ক্লাস শেষ হওয়ার পর যতটুকু সময় পাই সেই সময়টাতে ঝালমুড়ি বিক্রি করি। বেচা-কেনা শেষ করে বাসায় যেতে প্রায় রাত ১০টা বেজে যায়। সারাদিনের ক্লান্তিতে সহজে ঘুম চলে আসে তবে রাত ৪টা থেকে সকাল ৮ টা পর্যন্ত একাডেমিক পড়াশোনা শেষ করার চেষ্টা করি।

জানা যায়,আব্বাস নুরুল উলুম ইদ্রিসিয়া দাখিল মাদ্রাসা থেকে ৪.১৭ পেয়ে দাখিল পাশ করেন। পরবর্তীতে স্হানীয় একটি কলেজে ভর্তি হয় সে এবং প্রথমবার এইচ এস সি পরিক্ষায় ইংরেজীতে অকৃতকার্য হয় আব্বাস। তবে আব্বাসের পড়ালেখার প্রতি প্রবল ইচ্ছা শক্তি আর একাগ্রতা কোন ভাবেই দমিয়ে রাখতে পারেনি তাকে । পরবর্তীতে আবারো তার খালাতো বোন জান্নাতের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেলে পুনরায় পরিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয় এবং অবশেষে নানুপুর লায়লা কবির ডিগ্রি কলেজ থেকে আব্বাস জিপিএঃ৩.৬৭ পেয়ে এইচ এস সি পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়।

এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা ভাল ফলাফল না করলেও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার স্বপ্ন ছিল স্কুল জীবন থেকে।বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কোচিং করার সুযোগ পায়নি আব্বাস। বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করে বই পড়তেন। তবে সবসময় সাহস জুগিয়েছে খালাতো বোন জান্নাত। এইচএসসিতে প্রথমবার ইংরেজিতে কৃতকার্য হতে না পারা আব্বাস ভর্তি পরীক্ষায় সেই ইংরেজিতে ৩০ মার্কের মধ্য ২৫ পেয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হয়। আর্থিক অনটনের কারণে কয়েকটি মেধাবৃত্তি পেলেও শর্ত সাপেক্ষ হওয়ায় নিতে পারেনি সেগুলো। তবে সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) প্রস্তুতির পাশাপাশি বিদেশে পড়তে চান আব্বাস।

তিনি বলেন, অর্থনীতিতে পড়লে বিসিএসের পাশাপাশি বিদেশে উচ্চতর শিক্ষার জন্য প্রায় ১৬টি ডিগ্রির সুযোগ রয়েছে। ফ্রি অথবা ৫০% স্কলারশিপের সুযোগ পেলে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনের জন্য বিদেশে চলে যাবো। তার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। নিজস্ব সম্পত্তি না থাকায় এখন থেকেই কিছু একটা করার চেষ্টা করছি। তাছাড়া পরিবারের আয় করার মতোও মানুষ নেই। আমি কার উপর নির্ভর করবো? জন্ম থেকেই পরিবারের যতটুকু সামর্থ্য ছিল ততটুকু দিয়ে বড় করেছেন। এখনও পরিবারের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকাটা নিজের কাছেও বোঝা মনে হচ্ছে।

তার মা শাহানার বেগম ছেলের সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে কেদেঁ বলেন,পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতেই আমার ছেলে ঝালমুড়ির দোকান দিয়েছে। ছেলে সারাদিন খাটাখাটনি করে যতটুকু উপার্জন করেন তা দিয়েই আমাদের সংসার চলে। তাছাড়া ক্যাম্পাসের বাহিরে রোদ-বৃষ্টির ঝড়-ঝাপটায় নানান সমস্যা পোহাতে হয় তার (আব্বাস)। তবে ক্যাম্পাসের ভিতরে হলে আরো নিরাপদ ও সুবিধা হতো বলে মনে করেন তিনি।

আব্বাসও দুংখ প্রকাশ করে বলেন, সুনির্দিষ্ট কোন বসার মতো কোথাও জায়গা পাচ্ছি না, যার কারনে ভ্যানে করে যখন যেখানে জায়গা পাই সেখানে বসে দোকান চালিয়ে নিই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা পেলে ব্যবসার কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে নিতে সহজ হতো।

আব্বাসের ঝালমুড়ি খেতে বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি ভীড় লেগে থাকে শিক্ষার্থীদের। তারা বলেন,বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র এভাবে ঝালমুড়ি বিক্রি করতে পারে সেটা কল্পনাতীত। তার জীবন সংগ্রামের অদম্য সাহস আর অধ্যবসায় আমাদের মুগ্ধ করেছে। তার ঝাঁলমুড়ি কেমন হচ্ছে সেটি বিষয় নয়, সে আমাদের ক্যাম্পাসের। আমরা এজন্য এখানে খেতে আসি। এসময় অনেকে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে আব্বাসকে দোকান বসাতে দেয়ার দাবি জানান।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মুহ. আমিনুল ইসলাম আকন্দ বলেন, এ বিষয়টি নিয়ে আমরা পূর্ব থেকে অবগত আছি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে আমরা সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি, তার নাম আমাদের নোটবুকে আছে। এছাড়াও ভবিষ্যৎ সুযোগ পেলে আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করতে চাই।

সুনির্দিষ্ট স্থানে আব্বাসের দোকানের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের রিসোর্স সীমিত থাকার কারনে আমরা কোনো কিছু করতে পারছি না। বিষয়টা সামাজিক দায়বদ্ধতার মধ্যে পড়ে। এ বিষয় নিয়ে আমরা কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলব

The Campus Today YouTube Channel

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
themesbazar_creativenews_II7
All rights reserved © 2019-20 The Campus Today