ডিজিটাল বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাসের ভূমিকা ও বাস্তবতা

আবু জাফর আহমেদ মুকুল
মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম


বিশ্ব অর্থনীতির সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে শিল্পবিপ্লবের ফলে। বর্তমান বিশ্বও টিকে আছে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির ওপর। এখন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে মোট তিনটি শিল্পবিপ্লব ঘটেছে। এ শিল্পবিপ্লব-গুলো বদলে দিয়েছে সারা বিশ্বের গতিপথ, বিশ্ব অর্থনীতির গতিধারা।

১৭৮৪ সালে পানি ও বাষ্পীয় ইঞ্জিনের নানামুখী ব্যবহারের কৌশল আবিষ্কারের মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছিল প্রথম শিল্পবিপ্লব। এতে এক ধাপে অনেকদূর এগিয়ে যায় বিশ্ব। এরপর ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ আবিষ্কারের ফলে একেবারেই পাল্টে যায় মানুষের জীবনের চিত্র।

কায়িক পরিশ্রমের জায়গা দখল করে নেয় বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রপাতি। শারীরিক শ্রমের দিন কমতে থাকে দ্রুততর গতিতে। এটিকে বলা হয় দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব। প্রথম শিল্পবিপ্লব থেকে দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের প্রভাব আরও বিস্তৃত। দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের ঠিক ১০০ বছরের মাথায় ১৯৬৯ সালে আবিষ্কৃত হয় ইন্টারনেট। শুরু হয় ইন্টারনেটভিত্তিক তৃতীয় শিল্পবিপ্লব।

ইন্টারনেটের আবির্ভাবে তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের সময় তথ্যপ্রযুক্তির সহজ ও দ্রুত বিনিময় শুরু হলে সারা বিশ্বের গতি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ম্যানুয়াল জগৎ ছেড়ে যাত্রা শুরু হয় ভার্চুয়াল জগতের। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আসছে এ ভার্চুয়াল জগতেরই আরও বিস্তীর্ণ পরিসর নিয়ে। যেখানে মানুষের আয়ত্তে আসছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ইন্টারনেট অব থিংস বা যন্ত্রের ইন্টারনেট, যা সম্পূর্ণ রূপেই মানবসম্পদের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে! এ নিয়েই এখন তোলপাড় চলছে সারা দুনিয়াজুড়ে।

প্রযুক্তিনির্ভর এ ডিজিটাল বিপ্লবকেই বলা হচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ধারণাটি প্রথম এপ্রিল, ২০১৩ সালে জার্মানিতে আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপিত হয়েছিল। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মূলত তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল বিপ্লব। এ বিপ্লবের ফলে নানামুখী সম্ভাবনার সৃষ্টি হবে দেশের সামগ্রিক চালচিত্রে। যেমন- অটোমেশনের প্রভাবে কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকি হ্রাস, উৎপাদন শিল্পে নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে বড় পরিবর্তন, বিশেষায়িত পেশার চাহিদা বৃদ্ধি, সামগ্রিক জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন। এ বিপ্লব অর্জনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে ক্লাউড কম্পিউটিং, ইন্টারনেট অব থিংস (IoT) এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI)।

বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই তথ্যপ্রযুক্তিতে অনেক ভালো করেছে এবং বর্তমান বিশ্বের আধুনিক সব তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্ব এখন জোর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দিকে। ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর জননেত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দেওয়ার সময়ই আমাদের এই নতুন বিপ্লবে শামিল হতে সুযোগ করে দেন। বাংলাদেশও রয়েছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, বর্তমান আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা দ্বিতীয় শিল্প যুগের।যার ফলে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ অনলাইন ক্লাস নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে।

উল্লেখ্য, গত ২৪ মার্চ, ২০২০ইং ইউজিসির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকার কারণে ছাত্রছাত্রীদের যে ক্ষতি হচ্ছে তা সাময়িক ভাবে পূরণ করার লক্ষ্যে শিক্ষকদেরকে অনলাইন ক্লাস নিতে বলা হয়। গত ৬ এপ্রিল, ২০২০ইং আবারও এক বিজ্ঞপ্তিতে অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণ, মূল্যায়ন ও ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ করার আহ্বান জানায় ইউজিসি।

ইউনেস্কো রিপোর্ট অনুযায়ী, আমাদের দেশে প্রায় ৪০ মিলিয়ন শিক্ষার্থী যার মধ্যে ১৭.৩৩ মিলিয়ন প্রাথমিক, ১৫.৮৬ মিলিয়ন মাধ্যমিক আর ৩.১৫ মিলিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থী। বাংলাদেশের ৪৬টি পাবলিক, ১০৫টি প্রাইভেট এবং ৩টি আন্তর্জাতিকসহ (ইউজিসি ওয়েবসাইট কর্তৃক প্রাপ্ত) মোট ১৫৪টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে গত ১৮ মার্চ থেকে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার।

শিক্ষাবান্ধব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে ‘আমার ঘরে আমার স্কুল প্রোগ্রামের আওতায় সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে এই অনলাইন ক্লাস সরাসরি পরিচালিত হচ্ছে, যা দেশব্যাপী সব মহলের প্রশংসা কুড়িয়েছে। সেমিস্টারের ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে কিছু কলেজেও সীমিত পরিসরে অনলাইন শিক্ষণ অ্যাপ্লিকেশন যেমন জুম, গুগল ক্লাসরুম, গুগল মিট বা সমমানের লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ব্যবহার করে পাঠদান প্রক্রিয়া চালু রেখেছে ।

এদেশের সকল সেক্টরে অনলাইন ব্যবস্থার মতো উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনলাইন ক্লাস করা জরুরি। করোনার এই পরিস্থিতিতে মানবিক শিক্ষক হওয়াটা খুব দরকার। বর্তমান প্রেক্ষাপটে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষার্থীদের সেসন জট নিরসনে নিম্নলিখিতভাবে পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারেঃ

১) বাংলাদেশে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে এ বছর চলে যাবে। শিক্ষার্থীরা ১ বছরের সেসন জটে পড়বে এবং ৪ বছরের অনার্স ৫ বছরের বেশি অতিক্রান্ত হবে। সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রেও তাদের বয়স কনসিডার করা হবে না । আবার, অনলাইন ক্লাস নেওয়া নিয়ে অনেকের ভ্রান্ত ধারনা আছে সকলকে উপস্থিতি থাকতে হবে, বিষয়টা সে রকম নয়। ক্লাসটি ও Course Materials সকল শিক্ষার্থীর ব্যাচ, Zoom ও Youtube এ সংরক্ষিত থাকবে। তাই যে কোন সময় একজন ছাত্র রেকর্ডকৃত ক্লাস ও Course Materials দেখে নিতে পারবে।

২) আমার কাজের অভিজ্ঞতা দেখে দেখছি প্রত্যেকটি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৩% অস্বচ্ছল শিক্ষার্থী রয়েছে । এমনকি প্রায় অধিকাংশ সাহায্য প্রার্থীরা সামাজিক মাধ্যম এবং স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে আর্থিক সাহায্য চেয়েছেন। তাই যারা বলছেন ব্যক্তিগত ল্যাপটপ নেই তারা স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে অনলাইন ক্লাসে সংযুক্ত হতে পারেন। কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণ কমাতে, বাংলাদেশে স্বল্পতার মধ্যেও চালু হওয়া অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম আমাদের মতো শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, আমরা স্মার্টফোনটি শুধু সামাজিক যোগাযোগ হিসেবে ব্যবহার না করে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহার করতে পারি।

৩) যে সকল শিক্ষার্থীরা ফেসবুকে স্টাটাস দিয়ে দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের Excuse দিয়ে ক্লাস করতে চায় না তারাও কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে, তারা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী এবং প্রকৃতপক্ষে তারা দরিদ্র নয়। তবে এটি সত্যি যে, মান-সম্মানের ভয়ে প্রকৃত দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীরা সামাজিকভাবে কখনো বলতে চায় না তারা দরিদ্র।

৪) অনেক শিক্ষার্থী মনে করেন অনলাইন শিক্ষার জন্য প্রধান বাধাঁ- ব্যান্ডইউথের গতি আর দাম। বাংলাদেশে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে কম-বেশি নিম্ন আয়ের বা দরিদ্র শিক্ষার্থী রয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীদের কোন মোবাইল অপারেটরের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে চুক্তি করে প্যাকেজ সুবিধা দেওয়া যেতে পারে এবং চুক্তি অনুযায়ী ব্যান্ডইউথের গতি বিষয়ে নিশ্চয়তা দিবে মোবাইল অপারেটর কোম্পানি। তবে সরকারের কাছে, অনেক অব্যবহ্নত ব্যান্ডউইথ রয়েছে যা কর্তৃপক্ষ চাইলে শিক্ষার্থীদের অনলাইন কার্যক্রমে ব্যবহার করতে পারে। এমনকি, অনেক মোবাইল কোম্পানির কাছে সরকার কয়েক হাজার কোটি বকেয়া টাকা পাবে। সরকার চাইলে সেটাও করোনাকালীন সময়ে শিক্ষার্থীদের কল্যানে সমন্বয় করা সম্ভব।

৫) অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন ক্লাসের জন্য শিক্ষার্থীদের অনেকের অংশগ্রহণের সক্ষমতা না থাকা এবং অনেকের অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা কথা বলা হয়েছে। কিন্তু একটি বিষয় আমরা লক্ষ্য করেছি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রদের লিস্ট করে আর্থিক সাহায্য প্রদান করছেন। এমনকি, প্রত্যেকটি বিভাগের শিক্ষক, এলামনাই এসোসিয়েশন, বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানসহ স্থানীয় প্রশাসন অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীদের জন্য এগিয়ে এসেছেন।

৬) অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনির্ধারিত এই ছুটির সময়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় যে ক্ষতি হচ্ছে, তা পুষিয়ে নিতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পরে সাপ্তাহিক ছুটির দিনসহ অন্যান্য সময়ে অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়া শুভংকরের ফাঁকি বলে আমি মনে করি এবং যা গুনগত শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক। এমনকি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের সেসনজট নিরসনের জন্য কোন প্ল্যান উপস্থাপন করেনি এবং কোন কোন প্রকার জরিপ না করে বলছে তাদের অধিকাংশ শিক্ষার্থী দরিদ্র ও স্মার্ট ফোন নেই যা খুবই দুঃখজনক একটি বিষয়।

উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) জরিপ-২০১৯ মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৯ কোটি ৮১ লাখ। এদের মধ্যে ৯ কোটি ২৪ লাখ মোবাইল ফোন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী, ৫৭ লাখ ৩৫ হাজার ব্রডব্যান্ড ব্যবহারকারী এবং বাকি ৪০ হাজার ওয়াইম্যাক্স ব্যবহারকারী। মুঠোফোন অপারেটরদের বৈশ্বিক সংগঠন জিএসএমএ, দেশের প্রায় ৬০% লোক স্মাট ফোন ব্যবহার করে। আগামি ২০২০ সালে নতুন স্মার্টফোনের ব্যবহার বৃদ্ধিতে শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে ৭ নম্বরে থাকবে বাংলাদেশ।

৭। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর ইন্টারনেট সংযোগসহ প্রযুক্তিগত অন্যান্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা না থাকার বিষয়টি বলা হয়েছে যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশের নির্বাচনি ইশতেহারের সাথে সাংঘর্ষিক বলে অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এ ধরনের বক্তব্য প্রত্যাহার করা উচিত এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের প্লাটফর্ম হিসেবে অনলাইন লার্নিং ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা করা দরকার।

৮) যারা ভাবছেন, ঈদের ছুটির পর অবস্থা স্বাভাবিক হলে অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে সকল কিছুর সমস্যা সমাধান করে ফেলবেন । তারা প্রকৃতপক্ষে অন্ধকারে আছেন বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে যেখানে আগামি এক বা দুই বছরের জন্য অনলাইন ক্লাসের পরিকল্পনা করছেন। সেখানে বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় Physically Class নেওয়ার জন্য পরিকল্পনা করছেন। তবে এটি সত্যি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের Physically Class নেওয়ার মাধ্যমে ছাত্র-শিক্ষক করোনায় ঝূঁকি বাড়ার আশংকা রয়েছে।

৯) বিশ্বব্যাপী শিক্ষাব্যবস্থায় ইনস্ট্রকটিজম, কনস্ট্রাকটিজম এবং কানেক্টিভিজম এই তিন ধরেন ক্লাসরুম শিক্ষাদান পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগেুলো এখনো ক্লাস লেকচার বেইজ বা ইনস্ট্রকটিজম এবং মুখস্থ ভিত্তিক পরীক্ষা নিয়ে পড়ে রয়েছে। এমনকি পাশের দেশে ভারতে কনস্ট্রাকটিজমে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। কনস্ট্রাকটিজম মূলত সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা ভিত্তিক লার্নিং।

১০) চলমান সেমিস্টারে যাদের ফাইনাল পরীক্ষা বাকি আছে। তাদেরকে ইউজিসি নির্দেশ অনুযায়ী, বিভাগীয় একাডেমিক কমিটির মাধ্যমে প্রশ্ন প্রণয়ন করে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। অনেকে ছাত্র ভাবছেন, এ সেমিস্টারে পরীক্ষা ছাড়া অটো গ্রেড পাবেন কিংবা ক্লাস কম করে পরীক্ষা দিবেন! এ আশা কেবল স্বপ্ন দেখার মতো বাস্তবতা নয়।

১১) অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে গুগল ফর্ম, গুগল ক্লাসরুমসহ আরও বেশিকিছু থার্ড পার্টি অ্যাপস আছে যা দিয়ে আগে থেকে সময় নির্ধারণ করে দিয়ে পরীক্ষা নেওয়া যায়, এক্ষেত্রে পরীক্ষার্থী ওই অ্যাপসটি বন্ধ করলে বা একই সময়ে অন্য কোনো এপস চালু করলে বা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উত্তর না করতে পারলে তাদের পরীক্ষাটি বাতিল বলে গণ্য হয়। সুতরাং, পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের সুযোগ খুব কম থাকে। একই পদ্ধতিতে অনলাইনে শিক্ষার্থী ভর্তি ও মূল্যায়ন সম্ভব। ইমেইলের মাধ্যমে এসাইনমেন্ট নেওয়া এবং প্রেজেন্টেশন সরাসরি ভিডিও কনফারেন্স এর মাধ্যমে নেওয়া যেতে পারে।

১২) অনলাইন এসেসমেন্ট এর ক্ষেত্রে শিক্ষকগণকে সতর্ক থাকতে হবে । আমাদের শিক্ষার্থীরা যেহেতু গ্রামীন এলাকায়ও থাকে সেহেতু এসাইনমেন্ট বেশি ওয়ার্ডে না দিয়ে গবেষণার মতো মূল অ্যাবস্ট্রাক্ট এর মতো ১০০ শব্দে দেওয়া যেতে পারে। যার ফলে একজন শিক্ষার্থী স্মার্ট ফোন দিয়ে টাইপ করে যাতে সহজে এসাইনমেন্ট টি করতে পারে।

১৩) দেশে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ধরনের একাডেমিক, টেকনিক্যাল বা প্রশাসনিক সহযোগিতার জন্য কোন MoU নেই। যার করোনার মহামারিতে অনলাইন শিক্ষাক্রমের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পিছিয়ে পড়া বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে সহযোগিতা করতে পারছে না। তবে এ বিষয়টি প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের পক্ষে আইকিউসি বা ইউজিসি এগিয়ে নিতে পারে।

১৪) বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন লার্নিং বাস্তবায়ন করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি, তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, বিটিআরসি ও মোবাইল অপারেটর কোম্পানি সমন্বয়ে আহবায়ক কমিটি গঠন করে এবং প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকনিক্যাল ও মনিটরিং কমিটি করে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।

১৫) শিক্ষার বিভিন্ন শাখায় বিশেষ করে ইঞ্জিনিয়ারিং, কৃষি, মেডিকেল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয় যেখানে ব্যবহারিক ক্লাস রয়েছে সেখানে সমস্যা রয়েই গেল। এক্ষেত্রে তত্ত্বীয় কোর্স চালানো সম্ভব হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যাবহারিক ক্লাস নেয়া সম্ভব হবে না। তবে করোনা পরিস্থিতি আগামী কয়েক মাসের মধ্যে স্বাভাবিক না হলে চলতি সেমিস্টারের ব্যাবহারিক কোর্স সমূহ পরবর্তী সেমিস্টারে অফার করার ব্যবস্থা করার বিষয়টি চিন্তা করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে একাডেমিক বিশেষজ্ঞরা একটি সমাধান বের বের করতে পারবেন বলে মনে করি।

মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে প্রতিটি ঘটনা থেকে কিছু শেখে। সম্প্রতি, উচ্চ আদালতে শারীরিক উপস্থিতি ছাড়া তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভার্চুয়াল উপস্থিতির মাধ্যমে আদালতের বিচার কার্যক্রম শুরু করছে যা প্রশংসা পাওয়ার দাবিদার। বহির্বিশ্বের উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মোটামুটি সম্পূর্ণরূপেই একটি আপদকালীন ব্যবস্থা হিসেবে অনলাইন ক্লাসে পাঠদান প্রক্রিয়া শুরু করেছে। অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের কিছুটা সহযোগিতামূলক মনোভাব পোষণ করলে ছাত্রছাত্রীদের মনোযোগ আকর্ষণ করা যায় খুব সহজে।

বর্তমানে শিক্ষার্থীরা যেভাবে প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে উঠছে তাতে দূরশিক্ষণ কার্যক্রম সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এগিয়ে আসা উচিত। আশা করি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ও নীতি নির্ধারকগণ সে পথে হাঁটবে।


লেখকবৃন্দ: শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে এর শিক্ষক।

Scroll to Top