ড. শামসুজ্জোহা
ড. আনন্দ কুমার সাহা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৮ হাজার এবং শিক্ষকের সংখ্যা ১২০০ (বারশত’র) অধিক। অনেক শিক্ষক অবসরে গিয়েছেন। আমরা যারা কর্মরত আছি- তারা কতজন শিক্ষকের কথা মনে রাখি। কিন্তু ড. শামসুজ্জোহাকে আমরা সবাই স্মরণে রাখি। কেউ কেউ জীবদ্দশায় এমন কিছু কীর্তি রেখে যান, যা তাঁদের অমর করে রাখে।
ড. জোহা ১৯৩৪ সালে পশ্চিম বাংলার বাকুড়া জেলায় এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ছিলেন একজন চাকুরিজীবী এবং মা ছিলেন একজন গৃহিণী। স্কুল জীবনে ড. জোহা ছিলেন একজন আদর্শ পড়ুয়া ছাত্র। জোহার অমায়িক ও মধুর ব্যবহারে তাঁর সহপাঠীরা তাঁর অকৃত্রিম বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলো। ১৯৪৮ সালে এবং ১৯৫০ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে যথাক্রমে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বিভাগে উর্ত্তীণ হন। ১৯৫৩ সালে রসায়ন বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্মান ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৫৪ সালে একই বিষয়ে এম.এস.সি থিসিস গ্রুপে প্রথম শ্রেণি অর্জন করেন।
১৯৬১ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত জোহার জীবনের স্বর্গীয় সময়। এ সময়ে তিনি পি-এইচ.ডি গবেষণার জন্য লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজে অধ্যায়নরত ছিলেন। পড়াশুনার পাশাপাশি সামাজিকতা এবং খেলাধূলা নিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় কাটান। ১৯৬৪ সালে পি-এইচ.ডি ডিগ্রী অর্জন করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। ড. জোহা ছিলেন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। বাবা-মা সহ ছয় ভাই-বোন। বাবার সামান্য আয়। জোহার স্বভাবসিদ্ধ হাসিমাখা আচরণে তাঁর পরিবারের কষ্টের কথা কেউ বুঝতে পারত না।
১৯৫৫ সালে পাকিস্তান অর্ডন্যান্স কারখানায় সহযোগী পরিচালক পদে যোগদান করেন। ১৯৬১ সালে চাকুরি ইস্তফা দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে রসায়ন বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ড. জোহা এস.এম. হলের আবাসিক শিক্ষক হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৮ সাল থেকে মৃত্যুর মূহুর্ত পর্যন্ত ড. জোহা প্রক্টরের দায়িত্ব পালন করেন।
১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী জেলের মধ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা করে। বারুদের মতো সাধারণ জনতা রাস্তায় নেমে আসে। উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা এমনকি মন্ত্রীদের বাসভবনে আগুন লাগিয়ে দেয়। সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে।
সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যার প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল বের করে এবং পুলিশি হামলায় বহু ছাত্র আহত হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করার চেষ্টা করে। মেইন গেটে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. জোহা ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণে রাখবার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। পাশাপাশি সেনা সদস্যদের সঙ্গে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছেন- যাতে ছাত্রদের প্রতি কোন গুলি ছোঁড়া না হয়।
উল্লেখ করা প্রয়োজন ১৭ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের উপর লাঠিচার্জ করা হয়। অনেক ছাত্র রক্তাক্ত অবস্থায় হলে ফিরে আসে। ড. জোহার সাদা শার্টে রক্ত লেগে যায়। জোহা সেই রক্তমাখা শার্ট দেখিয়ে ছাত্র-শিক্ষকের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন- এরপর আর যদি গুলি করা হয়, কোন ছাত্রের গায়ে লাগার আগে সে গুলি আমার বুকে লাগবে। ড. জোহা সে কথা রেখেছিলেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টায় মেইন গেটের উল্টোদিকে নাটোর রোডে পাকিস্তানি সেনা সদস্যরা বুলেট ও বেয়নেটের খুঁচায় জোহাকে হত্যা করে।
উনসত্তরের গণআন্দোলনে তাঁর মৃত্যুর শোক বাঙালিদের শক্তিতে পরিণত হয়েছিলো। বাঙালির স্বাধীকারের আন্দোলন স্বাধীনতার দিকে ধাবিত হয়। এদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনের ইতিহাসে শহীদ ড. শামসুজ্জোহার আত্মত্যাগ এক অনন্য ঘটনা। আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।