জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ পুরো বাঙালি জাতিকে মুক্তি পথে দেখিয়েছে। বঙ্গবন্ধু দেখিয়েছেন চাইলেই ক্ষমতার জোড়ে কাউকে বেশি দিন দাবিয়ে রাখা যায় আর বাঙালিদের তো নয়ই। ১৯ মিনিটের নাতিদীর্ঘে ভাষণে পুরো জাতীর ইতিহাস, বর্তমান ও ভবিষ্যত মূল্যায়নের সেই দলিল অনুকরণীয় হয়ে আছে পুরো পৃথিবী বাসীর জন্য। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে ৭ই মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ নিয়ে তরুণ প্রজন্মের ভাবনা তুলে ধরেছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক মাসুম মাহমুদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাকিব বলেন, হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি জাতির সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। ৪৭ থেকে ৭১ পাকিস্তানি শাসকদের অর্থনৈতিক, সামাজি, রাজনৈতিক, সামরিক শোষণে অত্যাচারিত ও দিশেহারা বাঙালি জাতি যখন মুক্তির পথ খুঁজছিলো, তখনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই জাতির পথপ্রদর্শক রূপে হাজির হয়েছেন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তার আহ্বানে সার্বভৌমত্ব ও মুক্তির আশায় রেসকোর্স ময়দানে জনসমুদ্রের জোয়ার এসেছিলো। এই মুক্তিকামী মানুষদের তিনি তার বজ্রকন্ঠে শুনিয়েছিলেন আশার বাণী ও মুক্তির আহ্বান। সেদিন তার ঐকতান লয়ে সমবেত হয়েছিলো সমগ্র বাঙালি জাতি। তার সেই সুর মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস স্বাধীনতাকামী মানুষদের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মানবিকতা আর অসাম্প্রদায়িকতার এক মহাকাব্যিক রচনা এই ঐতিহাসিক ভাষণ। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে আজও তার সেই ভাষণ তরুণ প্রজন্মকে অত্যাচার, শোষণ আর দূর্নীতির বিরূদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান করে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আলী তিনি বলেন, বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ এক দীপ্তিমান কালজয়ী দলিল ও স্তম্ভ। এটা শুধু বাঙালি জাতির জন্য নয় বরং সারাবিশ্বে মানবতার জন্য অনুকরণীয় এক মহাকাব্য যা ২০১৭ সালের ৩০ শে অক্টোবর বিশ্ব ঐতিহ্য দলিল হিসাবে স্বীকৃতি পায়।
৭ই মার্চের এই অদম্য প্রয়াস বাঙালি তরুণদের জন্য এক নতুন উদ্দিপনা, যা বাঙালি তরুণ প্রজন্মকে শিখিয়েছে কিভাবে শিকলে মােড়ানো অতি শক্ত স্তম্ভ থেকে গনতান্ত্রিক স্বাধীনতা ও মুক্তি নামক অধিকার আহরন করে নিজেদের ভিতরে প্রতিষ্ঠা করে মর্যাদাসম্পন্ন সুনাগরিক হওয়া য়ায়।
ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘’যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’’ অতএব ভাষণটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মানবিকতা আর অসাম্প্রদায়িকতার এক মহাকাব্যিক রচনা। যা তরুণ সমাজকে উজ্জীবিত করে, এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখায়।
আবদুল্লাহ আল মনসুর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যয়নরত আছেন তিনি জানান, ৭ ই মার্চ বাঙালি জাতীয় জীবনে একটি অবিস্মরণীয় দিন। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা অর্জনের অনুপ্রেরণা। বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই অনুপ্রেরণার বাতিঘর। তিনি একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছেন, এবং বাঙ্গালীদের স্বাধীন জাতি হিসেবে বাঁচার স্বপ্নে অনুপ্রাণিত করেছেন।
১৯৭১ সালের ৭ ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক জ্বালাময়ী ভাষণ এবং দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ এর জন্ম। কিন্তু নিতান্ত পরিতাপের বিষয় স্বাধীনতার দীর্ঘ চার দশক পরেও আমরা ৭ ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের গুরুত্ব ও প্রত্যাশা উপলব্ধি করতে পারিনি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা ছিল শোষণ বৈষম্যহীন একটি গণতান্ত্রিক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। মানুষের মৌলিক অধিকার সমূহ ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা। বাক স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তা-চেতনায় সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলা। সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাসহ মানবাধিকারসমূহ নিশ্চিত করা। কিন্তু আমার তা করতে পারেনি।বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পৃথিবীর জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। কিউবার প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, “আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি” আজ আমাদেরকে বঙ্গবন্ধুর মতো অবিসংবাদিত মাহা-মানব হতে হবে। বঙ্গবন্ধু যেভাবে দেশকে ভালোবেসেছেন, দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন, ঠিক সেইভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, সমাজ ও জাতীয় জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে। গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও কর্মসংস্থান ইত্যাদি সকলের কাছে সহজলভ্য করতে হবে। প্রত্যেক নাগরিককে রাষ্ট্রের দেওয়া অধিকার ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করতে হবে। তবেই বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা পূর্ণতা লাভ করবে।
পুজা সরকার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টি বিভাগের শিক্ষার্থী তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষন ছিল বাঙ্গালীর মুক্তির সনদ। ৭ মার্চ বিকাল ৩টা ২০ মিনিট এ বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত হয়। লাখো মানুষের উপস্থিতিতে ময়দান ছিলো কানায় কানায় পরিপূর্ণ। শ্লোগান ছিল পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা। সে দিন ১৯ মিনিটে বঙ্গবন্ধু ইতিহাস এর পুরো ক্যানভাস তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দিব , এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এই শব্দ গুলো আমাদের অন্যায় এর প্রতিবাদ করতে শেখায়, কিভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন মনোভাব নিয়ে মাটি কামড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তা শেখায় ৭ ই মার্চের ভাষণ। আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাছে অত্যাচার ও শোষনের প্রতিবাদী শব্দ হচ্ছে ৭ই মার্চের ভাষণ।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জান্নাত আরা বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ শুধু একটি ভাষণই নয় এ যেন এক মহাকাব্য,বাঙালির মুক্তি আকাঙ্খার এক প্রকট গর্জন । শুধু বাঙালির জন্যই নয় সারা বিশ্বের জন্য অনুকরণীয় এক দলিল। ইউনেস্কো ৩০ অক্টোবর ২০১৭ তারিখ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য দলিল’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় যা সংস্থাটির ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রার’-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ পুরো মুক্তিযুদ্ধকালে মানুষকে উদ্দীপনা দিয়েছে।মনে জুগিয়েছে যুদ্ধ জয়ের অপার শক্তি।স্বাধীনতার ডাক। তার আত্মবিশ্বাসী সেই বজ্রকণ্ঠের ডাকে প্রাণ বাজি রেখেছিল বাংলার সাহসী সন্তানরা।অতঃপর ছিনিয়ে আনে আমাদের চির কাঙ্ক্ষিত “মুক্তি”।সেই বাংলাদেশকে আরো প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধ করা আজকের তারুণ্যের দায়িত্ব। আমরা আশা করি আমাদের মুক্তির গৌরবের সেই ইতিহাসকে বুকে ধারণ করে আগামী দিনের বাংলাদেশ তরুণদের প্রচেষ্টায় শিক্ষা, শিল্প ও প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হয়ে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থী ঝুমুর মল্লিক বলেন,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতিদীর্ঘ ১৮ মিনিটের একটি ভাষণ যা মুক্তিকামী বাঙালির স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিল তা সাধারণ কোনো ভাষণ ছিল না।৭ ই মার্চের এই ভাষণ ছিল এক অমর কাব্য।সেই ভাষণেরই পরিণতি আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ।৫০ বছরেও সেই ভাষণের আবেদন এতটুকু কমেনি। “রক্ত যখন দিয়েছি,রক্ত আরো দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এই লাইনটি অনুধাবন করলে আমরা বুঝতে পারি এই ভাষণ ছিল সাধারণ নিপীড়িত জাতির এক আশার বাণী। একজন ব্যক্তি একটি অলিখিত বক্তৃতা দিয়েছেন এবং তা দেশ কালের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী সার্বজনীনতা পেয়েছে। বাঙালির কাছে এর থেকে বড় পাওয়া আর কিছুই হতে পারে না। বর্তমান যুব সমাজের কাছে আমার এতটুকু চাওয়া যে আমরা যেন ৭ ই মার্চের এই অমর কাব্যের তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারি এবং বঙ্গবন্ধুর “সোনার বাংলা”গড়ার যে স্বপ্ন,তার দক্ষ কারিগর হতে পারি।