পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস: সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাব্য পথ
মাহমুদ শরীফ
কোভিড- ১৯’র কবলে পুরো বিশ্ব। সমস্ত পৃথিবী নাস্তানাবুদ। বর্তমানে আমরা একটা কঠিন এবং ভয়াবহ মহামারির মধ্যে দিয়ে সময় পার করছি। থমকে গেছে পুরো বিশ্ব।
সেই সঙ্গে আমাদের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো বন্ধ রয়েছে। ব্যহত হচ্ছে শিক্ষা সহ সকল ধরনের সহযোগী কার্যক্রম। যার ফলে ছাত্রছাত্রীরা নিজের পড়াশোনাসহ দৈনিক রুটিন থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে এবং সেশন জ্যামের সম্ভাবনার হার দিন দিন বেরেই চলছে।
প্রায় তিন মাস যাবত বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ থাকা এবং পড়াশোনা থেকে দূরে থাকায় অবসর সময় কাটাতে শিক্ষার্থীরা বেছে নিয়েছে , গল্পের বই, শিল্পকর্ম, চিত্রকর্ম, ইনডোর গেইম, লেখালেখি, টেলিভিশন দেখাসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যয় করছে অহেতুক সময়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন সত্য-মিথ্যা খবর এবং স্বজনদের মৃত্যুর খবর শুনে অনেকে মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা এই জন্য এসব মাধ্যম থেকে যথাযথ দূরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন এবং নির্ভরযোগ্য সংবাদ মাধ্যম থেকে সংবাদ গ্রহন করার পরামর্শ দিচ্ছেন।
এসকল কথা বিবেচনা করে আমাদের মনে হয় নির্দিষ্ট মাত্রায় সীমিত পরিসরে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ক্লাসের মান বজায় রেখে অনলাইন ক্লাস শুরু করা যেতে পারে। এতে করে এই সকল সমস্যা থেকে প্রাথমিক ভাবে বেরিয়ে আশা যাবে, আস্তে আস্তে অভ্যাসে পরিনত হবে এবং পড়াশোনা থেকে দূরে সরে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। যদিও এটা বাস্তবায়নে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে ।
তা স্বত্তেও আমাদের মনে হয় সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে আগালে সেটিও বাধা হয়ে দাড়াতে পাড়বে না। অনলাইন ক্লাসের মূল উদ্দেশ্য হতে পারে শিক্ষার্থীদের মোটামুটি পড়াশোনা মধ্যে রাখা এবং পড়াশোনার ধারাবাহিতা বজায় রাখা। আবার আমাদের অনলাইনে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাটাকে নিয়ে আসার কথা বললেও ভুল হবে এবং এটা বাস্তবায়ন করার মতো আমাদের সক্ষমতা এখনো হয়নি।
কিছু সীমাবদ্ধতা এবং সমস্যা সমাধানের জন্য কয়েকটি সম্ভাব্য পথ নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে-
সকল শিক্ষার্থীকে অনলাইন ক্লাসের আওতায় আনা: প্রথমত সকল শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি প্রয়োজন অনলাইন ক্লাসে এবং এটি একজন শিক্ষার্থীদের অধিকার। তাই বিভিন্ন সুবিধা দিতে পারলে সকলের উপস্থিতি সম্ভব। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ গ্রাম এবং নিম্ন আয়ের পরিবার থেকে আসা, সকলকে অনলাইন ক্লাসের আওতায় আনার জন্য তাদের কথা বিবেচনা করতে হবে এবং সকলের কথা মাথায় রেখে ক্লাস ডিজাইন করলে এই সমস্যা সমস্যা সমাধান সম্ভব। ক্লাস ডিজাইনের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রনালন একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা দিতে পারে। ( ক্লাস ডিজানের বিষয়ে পরবর্তী আলোচনা করা হবে)।
শিক্ষার্থীদের ডিভাইস: অনলাইন ক্লাসের জন্য প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের জন্য অন্তত একটি ল্যাপটপ বা স্মার্টফোনের প্রয়োজন। যাদের এইসকল ডিভাইসের অভাব তাদের জন্য বিভিন্ন দেশি বিদেশী ইলেকট্রনিক কোম্পানিগুলো স্বল্প লাভে কিস্তিতে নির্দিষ্ট ডিভাইস সরবরাহ করতে পারে।
টেকনিক্যাল সমস্যা এবং পরিচালনার দক্ষতা: ডিজিটাল অনলাইন ক্লাসের জন্য বর্তমান আমরা দেখতে পাচ্ছি বেশ কিছু অ্যাপলিকেশন ব্যবহার করা হচ্ছে এবং জনপ্রিয় হয় উঠছে। যেমন- জুম, গুগল মিট, গুগলক্লাস রুম, ফেইসবুক লাইভ ইত্যাদি। সকল টেকনিক্যাল সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন প্রযুক্তি এক্সপার্টদের সহায়তায় টিউটোরিয়াল ভিডিও এবং অনলাইন ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে পারে ইউজিসি।
ইন্টারনেট ডাটা এবং মূল্য: আমাদের মধ্যে অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে যারা। দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা। টিউশনির টাকা দিয়ে অনেকেই চলতে হয় এবং এখন তাদের সকল আয়ের উৎস বন্ধ। আর এদিকে প্রতিদিন কয়েকটা ক্লাসে এবং ব্রাউজে ৮০০ এমবি থেকে ১ জিবি ইন্টারনেট খরচ হয়। যার সাধারণ মূল্য প্রায় ১০০ টাকা। প্রতিদিন এই পরিমান অর্থ দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য প্রায় অসম্ভব।
তাই তাদের অনলাইন শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের জন্য ফ্রি একসেস এপ্লিকেশনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ( যেমন ফ্রি ফেইসবুকের মতো ফ্রি জুম একসেস) অথবা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর আইডি নম্বর অনুসারে বিনামূল্য বা স্বল্পমূল্যের ডেটা প্যাক চালু করা যেতে পারে এবং এটি বিভিন্ন টেলিকোম্পানির সাথে চুক্তির মাধ্যমেই সমাধান করা সম্ভব।
দূর্বল ইন্টারনেট: গ্রামে ইন্টারনেট সমস্যা অনেক রয়েছে। টেলিভিশনের চটকদার বিজ্ঞাপন আর বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। যদিও আমরা বলি ৪ জি ইন্টারনেট পৌছে গেছি। কিন্তু গ্রামবাংলায় এখনো ৩জি ইন্টারনেটও ঠিকমতো পাওয়া যায় না। যা দ্বারা লাইভ ক্লাস চালানো প্রায় অসম্ভব আর এই সমস্যার দ্রুত সমাধানেরও তেমন কোন উপায় নেই। তবে শিক্ষার্থীরাই এই সমস্যা সমাধানের জন্য তার নির্দিষ্ট জায়গা খুজে বের করতে হবে যেখানে শক্তিশালী ইন্টারনেট পাওয়া যাবে।
ক্লাস ডিজাইন: অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রে এর ক্লাস ডিজাইন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ক্লাসের মান: ক্লাসের মান বাজায় রাখতে ক্লাসের সংখ্যা কমিয়ে ক্লাসের কনটেন্টের উপর গুরুত্ব দেয়া জরুরী। সপ্তাহে প্রতি কোর্সের ১-২ টি মানসম্মত ক্লাস করা যেতে পারে।
একাডেমিক কারিকুলাম: এই অস্থায়ী সমস্যা চলাকালীন নতুন ভাবে কোর্সের স্বল্পমেয়াদী কারিকুলাম করা যেতে পারে।
ক্লাসের সময় এবং সময় কাল: সকলের মতামতের সাপেক্ষে ক্লাস প্রতিনিধির সাথে কথা বলে ঠিক করা যেতে পারে ক্লাসের সময়কাল ক্লাসের ধরণ অনুসারে করা যেতে পারে।
ক্লাস রেকর্ডিং: অনলাইন ক্লাসটি যদি রেকর্ড করে রাখা হয় এবং ইউটিউব কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গ্রুপে আপলোড করা হয়। কোন শিক্ষার্থী যদি ক্লাসটি মিস করে থাকে তাহলে পরবর্তীতে সুযোগমতো ডাউনলোড করে দেখে বিষয়বস্তু আরো বেশি পরিষ্কার হতে পারে এবং নোট নিতে পারে।
ক্লাস লেকচার নোট এবং পেজেন্টেশন স্লাইড: উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর মতো ক্লাস লেকচার নোট নোট করা যেতে পারে। এতে করে যদি কোন শিক্ষার্থী ইন্টারনেট বা ডেটা সমস্যায় যথাসময় ক্লাসে নাও আসতে পারে তাহলে যে এসকল রিসোর্স গুলো প্রিন্ট করে পরবর্তীতে তার পড়া শেষ করতে পাড়বে এবং পরবর্তী দিনের ক্লাস সম্পর্কে আগাম ধারনা পেয়ে যাবে। রিসোর্স প্রিন্ট করার জন্য বিভিন্ন কম্পিউটার দোকান বা ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্র ব্যবহার করা যেতে পারে।
ক্লাস এ্যাসইনমেন্ট: এ্যাসাইনমেন্টের জন্য নির্দিষ্ট সময় দিয়ে দেয়া এবং ইমেইলের মাধ্যমে পাঠানো যেতে পারে।
আমরা অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে নিজেদের যতটুকু সামনে এগিয়ে রাখতে পারি। পরবর্তীতে আমাদের এইসময়গুলোই এগিয়ে থাকবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।