পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার ইতিকথা | পর্ব ২
সজীবুর রহমান
পণ্য উৎপাদন থেকেই পুঁজিবাদের জন্ম। সামন্তবাদী ব্যবস্থা ছিল মূলত জমিকেন্দ্রিক। হস্তশিল্প বা গৃহশিল্প থাকলেও তা খুব বেশি উন্নত ছিল না। ক্রমে ক্রমে এই শিল্প বিকাশ লাভ করতে থাকে। এসময় আবিষ্কার হয় তাঁত মেশিন, বাষ্প ইঞ্জিন সহ কলকারখানা । মানুষ লোহা গলাতে এবং ইস্পাত তৈরি করতে শিখলো, ফলে শিল্পের বিকাশ ঘটলো। অন্যদিকে গ্রাম-শহরের সঙ্গে বিদেশে গ্রাম-শহরের পণ্য আমদানি-রপ্তানি চলছিল সৃষ্টি হয়েছিল নতুন এ শ্রেণি “বণিকশ্রেণি”।
সমান্তবাদ সমাজ ভেঙ্গে পুঁজিবাদী সমাজ গড়ার মূল কারণ ছিল উৎপাদন। সমান্তবাদ সমাজে মুক্ত শ্রমিকের অভাব ছিল যার কারণে যন্ত্রপাতি ও মেশিন থাকার পরেও উৎপাদন বাড়ছিল না। মুক্ত শ্রমিকের অভাব থাকার মূল কারণ ছিল তারা ভূস্বামীর জন্য মাঠে কাজ করতো এবং তার উপরে তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে হতো। তাই এসময় পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা একটি প্রগতিশীল সমাজ ব্যবস্থায় রূপ নেয় আর সামন্তবাদ হয়ে ওঠে প্রতিক্রিয়াশীল।
এরই মাধ্যমে ইউরোপে প্রথম বুর্জোয়া উৎপাদন বা পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার প্রথম আবির্ভাব হয়। ১৭৭৯ সালে মহান ফরাসি বিপ্লবের ভেতরেই ইউরোপে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা যাত্রা শুরু হয়েছিল,যা পরবর্তীতে ১৯১৭ সালে পর্যন্ত সারা পৃথিবী জুড়েই রাজত্ব করে বেরিয়েছে।
পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় পুঁজিপতি নির্দিষ্ট মজুরির বিনিময়ে শ্রমিক নিয়োগ করে। শ্রমিকেরা শ্রম করে উৎপাদন করে। কিন্তু উৎপাদিত সম্পদ এর উপরে তার কোন অধিকার নেই, সে শুধু তার শ্রমের বিনিময়ে ওদের কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট মজুরি পাবেন অর্থাৎ শ্রম বিক্রি করে সে মজুরি পাবে। মজুরি পছন্দ না হলে সে চাকরি নাও করতে পারে এই অধিকার শ্রমিকের দেওয়া হত। এটি হচ্ছে পুঁজিবাদী সমাজের অবস্থা যেটা ছিল সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থা থেকে অনেক বেশি ভালো । তার কারণ এখানে কাজ করার স্বাধীনতা ছিল।শ্রমিকরা নিজেদের পছন্দ মত জীবিকা নির্বাহ করতে পারত।
পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা কে বলা হতো সমাজীকৃত উৎপাদন। কারণ পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় যে উৎপাদন করা হতো তা সমস্তই করা হতো সমাজের মানুষের জন্য । উৎপাদন সমাজস্বীকৃত, মালিকানা ব্যক্তিগত পুঁজিবাদী সমাজের এই হল মূল বিরোধ, অন্তর্দ্বন্দ্ব। আর শীঘ্রই এই সমাজ ব্যবস্থায় পুঁজিপতিরা সুকৌশলে শ্রমিকদের শোষণ করা শুরু করল । ধরার উপায় নেই বলেই পুঁজিপতিরা সুকৌশলে শোষণের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে থাকে। অশিক্ষিত শ্রমিক হিসাব করে বুঝতে পারত না শোষণের পরিমাণ কতটুকু!! কিন্তু তারা জানত তারা শোষিত। বলা যায় তাহলে শ্রমিকরা কম মজুরিতে রাজি হয় কেন??
বেকার সর্বহারা মানুষ বাঁচার প্রয়োজনে কাজে বাধ্য হয়, এটাই ছিল মর্মকথা।। বুর্জোয়া সমাজে দিন দিন বাড়তে থাকে দাস ও সামন্ত যুগের মতোই অত্যাচার কিন্তু তা হয় সূক্ষ্ম কৌশলে। এ সময় নারী নির্যাতন, শ্রেণিসংগ্রাম, শ্রেণীবৈষম্য ইত্যাদির অস্তিত্ব ছিল কিন্তু কালের প্রয়োজনে এগুলো চেহারা ও কায়দা পাল্টে যায় মাত্র। তাই আগেও দেখা গেছে যেখানে শোষণ আছে শ্রেণীসংগ্রাম সেখানে থাকবে।
ইতিহাসে সমগ্র পুঁজিবাদী যুগের শ্রমিক শ্রেণীর রক্তঝরা কাহিনী ভরপুর ছিল। যেদিন থেকে জন্ম পুঁজিবাদের সেদিন থেকেই তার পাশাপাশি জন্ম নিয়েছিল পাল্টা শক্তি। শ্রমিকশ্রেণী জন্মলগ্ন থেকেই লড়াই শুরু করেছিল পুজিবাদের বিরুদ্ধে। তাদের সশস্ত্র শ্রেণিসংগ্রামের উদাহরণ ও কম নেই। ১৮৭১ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণী সশস্ত্র ভাবে বুর্জোয়া শ্রেণীকে উৎখাত করে শ্রমিকশ্রেণীর প্রতিষ্ঠা করেছিল। এটি অবশ্য ৭১ দিন টিকে ছিল এটাই হলো শ্রমিকশ্রেণীর প্রথম রাজত্ব। এটাকে ইতিহাসের বিখ্যাত “প্যারি কমিউন” বলে। এই প্যারি কমিউন এর পতনের ৪৬ বছর পর ১৯১৭ সালে মহান লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার শ্রমিকশ্রেণী বুর্জোয়াদের উৎখাত করে। এরপর সেখানে সৃষ্টি হয় সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা।
কেন পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার পতন হলো তখন?? পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার মূল সমস্যা জায়গা ছিল পুঁজিপতিরা উৎপাদনের উদ্যোগ নিজেরাই নিত। পুঁজিপতির উদ্যোগ আর পরিকল্পনায় উৎপাদন বহুলাংশে নির্ভর করত । পুঁজিপতিরা উৎপাদন করত তাদের ব্যক্তিগত মুনাফার জন্য, সমাজের কল্যাণ কখনোই বিবেচনা করত না। সব সময় হিসাব করত কত উৎপাদন করলে, কি দাম ধার্য করলে কি পরিমাণে বিক্রি হবে, তা থেকে তার লাভ কত হবে।
প্রায়ই দেখা যেত কারখানায় উৎপাদন ক্ষমতা থাকলেও পুঁজিপতি উৎপাদন কম করত। কারণ সে হিসেব করে দেখে উৎপাদন বাড়ালে জিনিসের দাম কমে যাবে। এর চেয়ে কম উৎপাদন করে বেশি দামে বিক্রি করলে মোট লাভ হবে বেশি। এই ঘটনা বিশেষ করে তখনই হয়েছিল যখন কয়েকজন সমাজের পুঁজিপতিদের হাতে সব কল-কারখানা থাকত । আর এই জন্য ছোট পুঁজিবাদীরা মার খেয়েছে তখন। আর সমস্ত অর্থই মাত্র কয়েকজন পুঁজিপতির হাতে এসে জমা হয়েছিল। যার ফলে বড়লোকরা দিনদিন বড়লোক হচ্ছিল আর গরীবেরা আরও গরিব।
অধিকাংশ সময় পুঁজিপতি ব্যক্তিগত আন্দাজে উৎপাদন করেত। যার ফলস্বরূপ কিছুদিন পরপরই দেখা দিত বাজারে এত পণ্য এসে হাজির হয়েছে যে তা আর বিক্রি হচ্ছে না। তখন পুঁজিপতিরা বলত অতিরিক্ত উৎপাদন হয়ে গেছে। কিন্তু আসলে অতিরিক্ত উৎপাদন হয়েছে বলা যায় না। সাধারণ মানুষের হাতে পয়সা নেই, সামর্থ্য নেই তাই বিক্রি হচ্ছে না। বিক্রি হচ্ছে না মানে বাজারে উৎপাদন বেশি তা নয়। মানুষের দরিদ্রতার কারণে ক্রয় ক্ষমতা কমে এসেছে, এই কারণেই মানুষ কিনতে পারছে না। কিন্তু পুঁজিবাদীরা বলতে লাগলো জনগনের প্রয়োজন মিটে গেছে বলে বাজারে জিনিস পড়ে আছে। তাই জনগণ আর পণ্য ঘরে তুলছে না এই বলে তারা শ্রমিক ছাটাই করতে শুরু করত ।
একবার ১৯২৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অতি উৎপাদনে সংকট দেখা দিয়েছিল। বাজারে প্রচুর জিনিস এসে গেছে বিক্রি হচ্ছে না, শেষে কি করা যায় বস্তা বস্তা গম সমুদ্রে ফেলে দেয়া হলো।গুদামের পর গুদাম কাপড় পুড়িয়ে দেওয়া হল। অথচ সেই বছর উৎপাদনের জন্য কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বহু লোক বেকার হয়, খাবার জোগাড় করতে পারেনি, না খেয়ে থেকে মরেছে, পরণের কাপড় জোগাড় করতে পারেনি । কিন্তু কেন এমন করল?? কেন পুঁজিপতিরা মনে কোন মায়া নেই??
কারণ তারা জানে মুনাফা আর মুনাফা। উৎপাদিত দ্রব্য নষ্ট না করে জনগনের মধ্যে বিতরণ করলেও জনগণের উপকার হত ঠিকই কিন্তু তাতে ক্ষতি হত পুঁজিপতিদের। কারণ এর ফলে পরবর্তীকালে পণ্যের চাহিদা কমে যেত দাম পড়ে যেত এর কারণে তারা কোন সহয়তা করেনি । সেই সময়কার একটি গল্প আছে যে, শীতকালে এক কয়লা শ্রমিকের ছেলে তার মাকে বলছে, “ মা শীত করছে কয়লা জ্বালাচ্ছো না কেন?? “। মা বলছে “ কয়লা কেনার টাকা নাই, তোমার বাবার চাকরি চলে গেছে “। ছেলে বলল ” কেন চাকরি চলে গেল বাবার “।মা উত্তরে “বাজারে কয়লা বেশি হয়ে গেছে তাই”।
এই ছিল তখনকার পরিস্থিতি, তাই এই সমাজ ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আাসার জন্য অনেক শ্রমিক আন্দোলন হয়। সর্বশেষ মহান লেলিনের নেতৃত্ব রাশিয়ায় শ্রমিকশ্রেণী পুঁজিপতিদের উৎখাত করে এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব আনে। রাশিয়ার পর চীন, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, কিউবার শ্রমিকরাও পুঁজিবাদী সমাজের উৎখাত করে এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা চালু করে।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।