শুক্রবার, ০৯ জুন ২০২৩, ০৯:১০ অপরাহ্ন

ফার্মাসিস্টদের অধিকার বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ও আমাদের করণীয় 

  • আপডেট টাইম রবিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০২২, ৮.২৬ পিএম
ফার্মাসিস্টদের অধিকার বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ও আমাদের করণীয় 

আবুল বাশার রিপন খলিফা


বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পে বঙ্গবন্ধু 

১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যে ভাষা আন্দোলন শুরু করেছিলেন, ১৯৫২ সালে তা বাঙালীর জাতীয়তাবাদী চেতনায় পরিণত হয়ে ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে নতুন মাত্রা পায়। পরবর্তীতে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন, ষাটের দশকের ৬-দফার আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং সত্তরের জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে তা বাঙালীর একটি পৃথক জাতিসত্তা বিনির্মাণ করে যা স্বাধিকার আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। নির্বাচনে বাঙালীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার অস্বীকৃতি ও পূর্ব বাংলায় ব্যাপক গণহত্যা শুরুর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এই স্বাধিকার আন্দোলন স্বাধীনতা আন্দোলনে পর্যবসিত হয়েছিল।

২৩ বছর ধরে পর্যায়ক্রমিক এই সংগ্রামের প্রতিটি স্তরে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব দিয়েছেন, আমাদের আত্মপরিচয়সমৃদ্ধ একটি জাতিরাষ্ট্র উপহার দিয়েছেন, ১৯৫০-এর দশকের আগে পূর্ববঙ্গে কয়েকটি দেশীয় ওষুধের উদ্যোগ ছিল। কিন্তু অভ্যন্তরীণ চাহিদার উপর তাদের প্রভাব সামান্য ছিল। ১৯৬০ এর দশকে, কয়েকটি বিদেশী এবং দেশীয় উদ্যোগের আগমন। এর পরও ওষুধের বাজারে আমদানি নির্ভরতা বেড়েছে। দেশীয় উৎপাদন ও বিক্রয়ের উপর বিদেশী কর্পোরেশনেরও একচেটিয়া আধিপত্য রয়েছে, যা স্বাধীনতার পর থেকে চলে আসছে। স্থানীয় ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প উৎপাদন ও বিক্রয় উভয় ক্ষেত্রেই পিছিয়ে  ছিল।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিন্নভিন্ন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে শুরু করেন।

বঙ্গবন্ধুর করা ছায়া স্বাস্থ্যনীতি

ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প একটি অনিশ্চিত অবস্থানে ছিল। দেশের ওষুধের চাহিদার ৭০ শতাংশের বেশি বড় খরচে আমদানি করতে হয়েছিল। বিদেশী কোম্পানিগুলো দেশের পরিমিত উৎপাদনের সিংহভাগ  প্রস্তুত করতো। কার্যকর সরকারি সংস্থার সংবিধির   অভাবের কারণে ওষুধ শিল্পের ওপর তদারকি একইভাবে সীমিত ছিল।তৎকালীন সময়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে ‘ড্রাগ কন্ট্রোলার অফিস’ থাকলেও  বিপজ্জনক ওষুধে বাজার প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কমিটির প্রধান করেছিলেন তৎকালীন প্রখ্যাত চিকিৎসা পণ্ডিত ডাঃ নুরুল ইসলামকে। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ১৯৭৩ সালে জনগণকে ওষুধ সংগ্রহ এবং অত্যাবশ্যক বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় কমাতে সহায়তা করার জন্য এটি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। কমিটিকে, ওষুধ বাজারজাতকরণে কোম্পানি নির্বাচন, যাচাইকরণ, পরিমাণ এবং মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে অন্যান্য দেশ থেকে ফার্মাসিউটিক্যালস আমদানির নিয়মাবলী এবং নিয়ন্ত্রণ করতে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ ট্রেডিং কর্পোরেশন একটি “ড্রাগ সেল” গঠন করেন যাতে আমদানি সীমিত করা হয় । এটিই ছিল বাংলাদেশে প্রথম ‘ছায়া চিকিৎসা নীতি’, যদিও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। ফলস্বরূপ, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি আর ওষুধ আমদানিতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা যেন নষ্ট না করে  এবং মানুষ তাদের কষ্টার্জিত অর্থ অপ্রয়োজনীয় ওষুধের পরিবর্তে জীবনরক্ষাকারী এবং জটিল ওষুধের,ক্রয়ের জন্য ব্যয় করতে পারে।

শোষণ-বঞ্চনা-দারিদ্র্য-অশিক্ষা-কুসংস্কার-সাম্প্রদায়িকতা-দুর্নীতিমুক্ত একটি উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন।যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের শিল্প বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি ছিল অনস্বীকার্য এবং একটি বাস্তব সত্য। বঙ্গবন্ধু ওষুধ আমদানি সীমিত করতে, দেশীয় ওষুধ উৎপাদন বাড়াতে এবং খাত নিয়ন্ত্রণ করতে ১৯৭৪ সালে “ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর” প্রতিষ্ঠা করেন। তিনিই দেশের তরুণ শিল্পপতিদের সহায়তার জন্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থাকে আর্থিক সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে তিনি ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে ঔষধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণের ও পরামর্শের দায়িত্ব দেন। দেশে মানসম্পন্ন ওষুধ নিশ্চিত করার জন্য ওষুধ উৎপাদন, বিপণন এবং আমদানি-রফতানি অধিকতর কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালে ওষুধ প্রশাসন পরিদপ্তরকে   অধিদফতরে উন্নীত করেন।দেশীয় চাহিদার শতকরা প্রায় ৯৯ ভাগ ওষুধ বর্তমানে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়। বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওষুধ রফতানি হচ্ছে।

১৯৭২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫(ক) অনুসারে জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব এবং অনুচ্ছেদ ১৮(১) অনুসারে জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন তিনি। বর্তমানে দেশে জনগণ সরকারি ও বেসরকারি খাতে যে স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে, তা পরিসর ও গুণগত মানের দিক থেকে আরও উন্নত করা প্রয়োজন। জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০১১-এর মূলমন্ত্র ছিল ‘সবার জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্য ও জরুরি চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা’। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফার্মেসি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ফার্মেসিকে একটি পেশাগত বিষয় এবং ফার্মাসিস্টদের পেশাজীবী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। স্বাস্থ্যসেবায় ডাক্তার ও নার্সের ভূমিকা যেমন অপরিসীম, তেমনিভাবে ওষুধ সংরক্ষণ, গুণগত মান, সঠিক ওষুধ নির্বাচন ও ওষুধের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিতকরণে স্বাস্থ্যসেবায় গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টের ভূমিকাও অপরিহার্য।

বাংলাদেশের ওষুধের অভ্যন্তরীণ বাজার

২০২০-২০২১ সালে বাংলাদেশের ওষুধের অভ্যন্তরীণ বাজার ২৫ হাজার কোটি টাকার উপরে এবং ২০২১ সালে রফতানির পরিমাণ ছিল ২০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার। আমাদের দেশে উৎপাদিত ওষুধ এখন বর্তমানে, দেশের ওষুধের চাহিদার ৯৯ শতাংশ অভ্যন্তরীণভাবে পূরণ করা হয়, বাকি ২০০ টি দেশে রপ্তানি করা হয়। স্নাতক ফার্মাসিস্টরা ইতিমধ্যেই দেশের প্রধান ফার্মাসিউটিক্যাল কর্পোরেশনগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। আর এ ওষুধের গুণগত মান ও উৎপাদন নিশ্চিত করতে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন প্রকৃত জননায়ক হিসেবে মানুষের এই আকাঙ্ক্ষাটি বাংলাদেশের সংবিধানে রূপদান করেছিলেন। বৈদেশিক মুদ্রার অপচয়রোধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের অধীনে প্রয়োজনীয় ওষুধ আমদানির লক্ষ্যে একটি সেল গঠন না করলে হয়তোবা এ পর্যন্ত আমরা ফার্মাসিস্,  আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকতা।

সরকারি-বেসরকারি প্রত্যেক হসপিটালে হসপিটাল ফার্মাসিস্ট নিয়োগ এর মাধ্যমে আমরা ফার্মাসিস্টরা, অন্যান্য পেশাজীবীদের সাথে মিলে বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশ হতে সাহায্য করেছি। আমরা, আজ বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের শক্তিশালী অবস্থানে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে স্বীকৃতি দিই। বাংলাদেশের উন্নত রাষ্ট্রের এই অভিযাত্রায় অন্যান্য পেশাজীবীদের সঙ্গে আমরা ফার্মাসিস্টরাও অংশ নিয়েছি। আজকের বাংলাদেশে ওষুধ শিল্পের যে বলিষ্ঠ অবস্থান, এর পেছনে বঙ্গবন্ধুর যে অবদান ছিল তা আমরা ওষুধবিজ্ঞানীরা গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি।

পঞ্চাশের দশকের আগে পূর্ব বাংলায় কয়েকটিমাত্র স্থানীয় ওষুধ কোম্পানি ছিল। কিন্তু দেশীয় চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত নগণ্য। ষাটের দশকে এখানে কয়েকটি বিদেশী কোম্পানির আগমন ঘটে, সেই সঙ্গে আরও কয়েকটি দেশী কোম্পানিও উৎপাদন শুরু করে।তৎকালীন সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের এ ভূখণ্ডে ওষুধ কোম্পানি ছিল না বললেই চলে। ওই সময় পূর্ব বাংলায় বহুজাতিক কোম্পানির মধ্যে অন্যতম ছিল ফাইজার ও গ্ল্যাক্সো। এছাড়া হাতে গোনা কিছু ওষুধ কোম্পানির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ফার্মাপাক, এড্রুক ও অ্যালবার্ট ডেভিড। তারপরে একমি ও অপসোনিন। বহুজাতিক ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানি তৈরির সক্ষমতা আমাদের দেশীয় কোনো কোম্পানির নেই—অনেকেরই ধারণা ছিল এমন। তবে সত্যি কথা বলতে সক্ষমতা ছিলও না—এটা পাকিস্তান আমল থেকেই। বিশেষ করে অবাঙালিরাই ওষুধ শিল্প বা এ ধরনের উদ্যোগের উদ্যোক্তা ছিলেন। সে সময় বহুজাতিক কোম্পানির উচ্চপদে ও পর্যায়ে বিদেশী কিংবা অবাঙালিদেরই বেশি দেখা যেত। কিন্তু এ সত্ত্বেও এখানকার ওষুধের বাজারে আমদানি নির্ভরতা কমেনি। উপরন্তু দেশীয় উৎপাদন ও বিক্রয়ে বিদেশী কোম্পানির একচেটিয়া আধিপত্য বজায় থাকে, যা স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও অব্যাহত ছিল। স্বভাবতই ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রির ক্ষেত্রে দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো অনেক পিছিয়ে ছিল।

ড্রাগ সেল গঠনে বঙ্গবন্ধু

সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শক্ত হাতে বিভিন্ন সেক্টরে বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। তখন ওষুধ সেক্টরের পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত নাজুক। দেশের চাহিদার ৯০ভাগের  বেশি ওষুধ অত্যন্ত মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে আমদানি করতে হতো। দেশে যে সামান্য উৎপাদন হতো তারও সিংহভাগ ছিল বিদেশী কোম্পানিগুলোর উৎপাদিত। ওষুধ সেক্টরে সরকারী নিয়ন্ত্রণও অত্যন্ত সীমিত ছিল, কারণ এই নিয়ন্ত্রণের জন্য কোন কার্যকর সরকারী সংস্থা ছিল না। যা ছিল তা হলো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বদলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি ‘ড্রাগ কন্ট্রোলারের অফিস।’ এর ফলে অনেক ক্ষতিকর ও অপ্রয়োজনীয় ওষুধ বাজারে প্রচলিত ছিল। দেশের মানুষ যাতে প্রয়োজনের সময় প্রয়োজনীয় ওষুধটুকুই কেনে এবং মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় বন্ধ করা যায় সে লক্ষ্যে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু দেশের কয়েকজন প্রখ্যাত চিকিৎসককে নিয়ে ১৯৭৩ সালে একটি কমিটি গঠন করেন, যার প্রধান ছিলেন তখনকার বিখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী জাতীয় অধ্যাপক ডাঃ নূরুল ইসলাম। এই কমিটিকে এ বিষয়ক নীতিমালা প্রণয়ন ও বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ওষুধ বাছাই, মান যাচাই, পরিমাণ ও মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে আমদানি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেয়া হয়।

আমদানি নিয়ন্ত্রণের সুবিধার্থে এ জন্য গঠন করা হয় ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) অধীনে একটি ‘ড্রাগ সেল।’ এর মাধ্যমে অনেক ওষুধের আমদানি নিষিদ্ধ এবং অনেকগুলোর আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বাস্তব অর্থে বাংলাদেশে এটিই ছিল প্রথম একটি ‘ছায়া ওষুধনীতি’, পূর্ণাঙ্গ না হলেও যা ছিল তখনকার পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখযোগ্য। এর ফলে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ওষুধ আমদানি খাতে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় বন্ধ হয়, জনগণ অপ্রয়োজনীয় ওষুধের পেছনে কষ্টার্জিত পয়সা খরচ না করে জীবন রক্ষাকারী ও অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের পেছনে তা খরচ করতে সক্ষম হয় এবং গরিব জনগণের জন্য সাশ্রয়ী খরচে চিকিৎসা সেবা প্রদান চালু করা সম্ভব হয়। ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু দেশে নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপনে আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য ইতোমধ্যে যে ‘বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক’ ও ‘বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা’ গঠন করেছিলেন, তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ওষুধ সেক্টরে নতুন শিল্পোদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে নির্দেশ দেন। ওষুধ প্রশাসন পরিদফতরকে নির্দেশ দেন নিবিড়ভাবে প্রযুক্তিগত পরামর্শ দিতে। এবং ওষুধ প্রশাসন পরিদফতরের প্রথম পরিচালক বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক হুমায়ুন কে এম এ হাই আন্তরিকভাবে এ নির্দেশ পালন করতে থাকেন। ফলে অনেকগুলো নতুন দেশীয় ওষুধ শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠে। এর ফলে জীবন রক্ষাকারী ওষুধগুলোর দাম কমে আসার পাশাপাশি এগুলো সহজলভ্য হয়।

দেশীয় পেটেন্ট কৃত ওষুধে বঙ্গবন্ধুর অবদান

বঙ্গবন্ধু জনস্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থে বিভিন্ন বিদেশী কোম্পানির পেটেন্টকৃত ওষুধও দেশীয় কোম্পানি কর্তৃক উৎপাদনের জন্য গরিব দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে পেটেন্ট আইনের বাইরে রাখেন। আমলাতন্ত্র তখন বঙ্গবন্ধুকে বলেছিল যে ওষুধের পেটেন্ট না মানলে পেটেন্টধারী বিদেশী কোম্পানিগুলো সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করবে। এ প্রসঙ্গে জাতীয় অধ্যাপক ডাঃ নূরুল ইসলাম ও অধ্যাপক হুমায়ুন কে এম এ হাই উভয়ের জবানিতেই শুনেছি, বঙ্গবন্ধু এর উত্তরে যা বলেছিলেন তার মর্মার্থ হলো আমি সারাজীবন বাংলার মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার আদায়ের জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি, সারাজীবন ঘরসংসার ফেলে জেল খেটেছি। না হয় বাংলার মানুষের ওষুধের অধিকারের জন্য আরও কিছুদিন জেল খাটব। তারা মামলা করলে তো আমার বিরুদ্ধে করবে, তোমাদের বিরুদ্ধে নয়। তোমাদের ভয় নেই। তোমাদের যা বলেছি তা কর। ওসব পেটেন্টওলা ওষুধ আমার দেশের কোম্পানিগুলোকে বানাতে দাও। আমার কাছে আগে আমার দেশের গরিব মানুষের জীবন। এত দাম দিয়ে তারা ওসব পেটেন্টওলা ওষুধ খেতে পারবে না 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যদি সে সেদিন প্যাটেন্টের উদ্যোগ না দিতেন তাহলে জীবন বাঁচাতে পারে এমন ওষুধের উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশ হতে পারতো না। ভ্যাকসিন, হার্ট ও ক্যান্সারের ওষুধ, ইনসুলিন ও অন্যান্য জটিল ওষুধ এখন বাংলাদেশি কোম্পানিগুলো তৈরি করছে। অন্তত ১৮টি কম্পানি ইতিমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ বাজারজাতকরণে সমর্থ হয়েছে। চলতি বছরের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য বলছে, দেশের জনসংখ্যা ১৮ কোটি ৫০ লাখ। ১৮.৫০ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে প্রতি বছর ২০০০ কোটি টাকার ওষুধের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে প্রতিবছর ওষুধের বাজার শতকরা ১২ পার্সেন্ট হারে বাড়ছে। এই ক্ষেত্রের উদ্যোক্তারা মনে করেন যে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আগামী ১০ বছরে ঔষধ শিল্পের ব্যবসায়ীরা বিশ্বের ঔষুধ রপ্তানিকারী দেশের মোট ব্যবসার অন্তত ৫% পেতে পারে। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) বাংলাদেশকে বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছিল। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে চূড়ান্ত উন্নীত হবে।

দেশীয় ওষুধ শিল্পের স্বার্থে বঙ্গবন্ধুর অকুতোভয় উচ্চারণ

ওষুধের পেটেন্ট না মানা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর মতো এমন অকুতোভয় উচ্চারণ তখনকার তৃতীয় বিশ্বের আর কোন রাষ্ট্রনায়ক করার সাহস পাননি। কয়েকটি বিদেশী ওষুধ কোম্পানি এ জন্য মামলার প্রস্তুতিও নিয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মামলা করার মতো স্পর্ধা দেখায়নি। ফলে দেশীয় কোম্পানিগুলো বিপুল প্রণোদনা লাভ করে এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজারের কারণে জীবন রক্ষাকারী ওষুধগুলোর দাম কমে আসার পাশাপাশি এগুলো সহজলভ্য হয়। এভাবে দেশের জনগণ ও দেশীয় ওষুধ শিল্প উভয়পক্ষই উপকৃত হয়। দেশের অর্থনীতিতেও তা অবদান রাখতে শুরু করে। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্মম  হত্যাকান্ডের পর তদানীন্তন সরকার বঙ্গবন্ধুর আমলের আমদানি-নিষিদ্ধ ওষুধগুলোর ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করে নেয়। এর ফলে ক্ষতিকর ও অপ্রয়োজনীয় ওষুধগুলো পুনরায় এদেশে আমদানি ও স্থানীয়ভাবে উৎপাদন শুরু হয়। ওষুধের বাজার পুনরায় প্রায় একচ্ছত্রভাবে বিদেশীদের হাতে চলে যায়। এ অবস্থা ১৯৮২ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এর অবসানে দেশের মানুষকে ক্ষতিকর ও অপ্রয়োজনীয় ওষুধের হাত থেকে রক্ষা করতে এবং দেশীয় ওষুধ শিল্পকে পুনরায় প্রণোদনা দিতে ১৯৮২ সালে দেশে প্রথম পূর্ণাঙ্গ জাতীয় ওষুধনীতি প্রণীত হয়। কিন্তু তাতেও বঙ্গবন্ধু সরকারের সময়ে অর্থাৎ ১৯৭৩ সালে যে ওষুধ আমদানি নীতিমালা বা ‘ছায়া ওষুধনীতি’ প্রণয়ন করা হয়েছিল তাই ছিল মূলনীতি। আমরা সবাই জানি যে ১৯৮২ সালের ওষুধনীতিটি ছিল রোগীবান্ধব ও শিল্পবান্ধব একটি অত্যন্ত সফল ওষুধনীতি।১৯৮২ সালের দিকে ১৬ শতাংশ ওষুধ দেশে তৈরি হতো, ৮৪ শতাংশ ওষুধ আমদানি করা হতো। ওষুধের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত ৮টি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান। বিদেশি বেশ কয়েকটি কোম্পানির এ দেশে কোনো কারখানা ছিল না। তারা অন্য কোম্পানির কারখানায় ওষুধ বানিয়ে নিজেদের ব্র্যান্ড লাগিয়ে বাজারজাত করত। বাজারে তখন প্রায় ২ হাজার ৫০০ ওষুধ ছিল।

বঙ্গবন্ধুর প্রতি ফার্মাসিস্টদের ঋণ

আজ যে আমরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় কমদামে জীবন রক্ষাকারী ওষুধগুলো তৈরি করতে পারছি এবং ওষুধের পেটেন্ট আমাদের দেশের ওপর ২০৩২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রয়োজ্য হবে না, তার তৎপরতার জন্য আমরা বর্তমান সরকার এবং পথ দেখানোর জন্য বঙ্গবন্ধুর কাছে ঋণী। আমরা ফার্মাসিস্টরা আরও একটা কারণে বঙ্গবন্ধুর কাছে কৃতজ্ঞ। স্বাধীনতার আগে পূর্ব পাকিস্তানে ফার্মাসিস্টদের পেশাগত রেজিস্ট্রেশন প্রদানের জন্য কোন ফার্মেসি কাউন্সিল ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল, কিন্তু এখানে নয়। যদিও ১৯৬৪ সালে এদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের প্রতিষ্ঠা হয়। এর ফলে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা কোন সরকারী স্বীকৃতি পেত না। তারা বিদেশে গিয়ে ফার্মাসিস্ট হিসেবে কাজ করতে সমস্যায় পড়ত। ফার্মেসি গ্র্যাজুয়েটস্ এ্যাসোসিয়েশনের কাছ থেকে সদস্যভুক্তির একটি সনদপত্র নিয়ে তাদের বিদেশে পাড়ি জমাতে হতো। কিন্তু এটি ছিল কেবল একটি পেশাগত সংগঠনের স্বীকৃতি, কোন সরকারী স্বীকৃতি নয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে সরকার ফার্মাসিস্টদের এই পেশাগত রেজিস্ট্রেশন প্রদানের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং বঙ্গবন্ধু তখনকার স্বাস্থ্যমন্ত্রী মরহুম আবদুল মান্নান এমপিকে নির্দেশ প্রদান করেন। তিনি ও অধ্যাপক হুমায়ুন  এ বিষয়ক আইনের খসড়া প্রণয়ন করে তা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠান। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতার কারণে সেটি বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হতে পারেনি।

১৯৭৫ সাল পর্যন্ত এই খসড়াটি আইন মন্ত্রণালয়ে পড়ে থাকে। পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে তা সামরিক সরকার থেকে ‘ফার্মেসি কাউন্সিল এ্যাক্ট’-এর পরিবর্তে ‘ফার্মেসি কাউন্সিল অর্ডিন্যান্স’ আকারে ঘোষিত হয়। এই আইনটি প্রণয়নের তথা ফার্মাসিস্টদের সরকারী পেশাগত স্বীকৃতি প্রদানের নিয়ম প্রণয়নের জন্য আমরা ফার্মাসিস্টরা বঙ্গবন্ধুর কাছে ঋণী। এই রেজিস্ট্রেশনের কারণে এখন ফার্মাসিস্টরা বিদেশে প্রচুর সংখ্যায় চাকরি করতে পারছে এবং দেশেও ওষুধ শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিয়োগপ্রাপ্ত হচ্ছে। বর্তমানে এ বিষয়ে কয়েকজন ব্যক্তির নাম উল্লেখ না করলে আমরা হয়তো অকৃতজ্ঞই থেকে যাব, তাদের মধ্যে হলেন প্রফেসর এ বি এম ফারুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রফেসর এ ওয়াই এসকে ফিরোজ আহমেদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,প্রফেসর আনোয়ারুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়  উনাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে ফসল হিসাবে আজ ফার্মাসিস্টদের পেশাগত পরিচয় রেজিস্ট্রেশনে নির্ধারিত হয়েছে। সেখানে উল্লেখ থাকে যে আরো বহু  সম্মানিত  শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা আমাদের অধিকার আদায় শক্তিতে রূপান্তরিত করে।

বাংলাদেশ হসপিটাল ফার্মাসিস্টদের হালচাল

বিশ্বে আমাদের দেশের ঔষুধশিল্পটা যতটা ঊর্ধ্বমুখী তার বিপরীতে ততোটাই নিম্নমুখী হলো আমাদের এই চিকিৎসা খাত। আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যাবস্থার দুর্বলতার জায়গাটা বুঝতে পেরেছি। তাই অবিলম্বে “হসপিটাল ফার্মেসি” চালু করে ফার্মাসিস্টদেরকে রুগিকে সেবা করার সুযোগ করে দিন। তাহলে “ফার্মাসিস্টরা” পাবে তাদের ন্যায্য অধিকার আর জনগণ পাবে মানসম্মত চিকিৎসা।উন্নত বিশ্বে ফার্মাসিস্ট ছাড়া স্বাস্থ্যসেবা অসম্পূর্ণ। বাংলাদেশ কেন পিছিয়ে! বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বাংলাদেশের গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের কাজে লাগান। সরকারি হাসপাতালে গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দেন। বিসিএসএ ফার্মাসিস্ট কোটা রাখুন। একজন গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট কাজ করে থাকেন ওষুধ উৎপাদনে, ওষুধের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণে, কমিউনিটি ফার্মেসিতে (মডেল ফার্মেসি), হসপিটাল ফার্মাসিস্ট হিসেবে নিরাপদ ওষুধ ব্যবহার নিশ্চিত করতে ও ওষুধ নিয়ে গবেষণায়। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ২০,০০০ নিবন্ধিত ফার্মাসিস্ট রয়েছেন। তাদেরকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে দেশের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হবে। হবে ওষুধের সঠিক ও নিরাপদ ব্যবহার।

বাংলাদেশে ২০১৮ সালের মার্চ মাসে ‘হসপিটাল ফার্মাসিস্ট’ চালু করার একটি সরকারি গেজেট প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে আজ অবধি সেই গেজেটের বাস্তবায়ন হয়নি। WHO নির্দেশনা অনুসারে, বিশ্বের ফার্মাসিস্টদের ৫৫ শতাংশ কাজ করবেন ‘কমিউনিটি ফার্মাসিস্ট’ হিসেবে, ৩০ শতাংশ ফার্মাসিস্ট কাজ করবেন হাসপাতালের চিকিৎসা সেবায়, ৫ শতাংশ কাজ করবেন সরকারি সংস্থায়, ৫ শতাংশ শিক্ষা কার্যক্রমে এবং ৫ শতাংশ কাজ করবেন বিভিন্ন ঔষুধ কোম্পানিতে। অথচ বাংলাদেশের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ফার্মাসিস্টরা কাজ করছেন বিভিন্ন ঔষুধ কোম্পানিতে। হসপিটালে যদি ফার্মাসিস্ট না থাকে তাহলে, প্রেসক্রিপশন অনুসারে সঠিক ওষুধের ডিসপেন্সিং, ড্রোজ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সঠিকভাবে মনিটরিং করা, মেডিকেল হিস্ট্রি সংরক্ষণ করা, অ্যান্টিবায়োটিক এর সতর্কতা ও রুগির রেজিস্ট্রার রেকর্ড করে রাখা, ড্রাগ ইন্টারঅ্যাকশন চেক করা, রোগীর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে তা ব্যবস্থা গ্রহন করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশের স্নাতকোত্তর  এবং স্নাতক ফার্মাসিস্টরা ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে (উৎপাদন, গুণমান নিয়ন্ত্রণ, গুণমান নিশ্চিতকরণ, গবেষণা ও উন্নয়ন, বিপণন, উৎপাদন পরিকল্পনা, বিতরণ, নিয়ন্ত্রক বিষয়, ব্যবসা উন্নয়ন এবং রপ্তানি), সরকারি সংস্থা, বেসরকারি হাসপাতাল, কমিউনিটি ফার্মেসিগুলিতে কাজ করার জন্য তাদের পেশাদার দক্ষতা ব্যবহার করে। ওষুধের অপব্যবহার কমাতে এবং নিরাপদ ওষুধের ব্যবহার নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের উদ্যোগে ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে দেশে মডেল ফার্মেসি চালু হয়েছে। মডেল ফার্মেসি স্নাতক ফার্মাসিস্ট ড্রাগ স্টোরেজ, ডিসপেনসিং এবং ওষুধের পাশাপাশি ওষুধের নিয়ম কাউন্সেলিং সম্পর্কে তথ্য প্রদান করতে পারেন। স্নাতক ফার্মাসিস্ট বর্তমানে ২০০ টিরও বেশি মডেল ফার্মাসিতে নিযুক্ত আছেন। তাদের কাজের পরিবেশ ও দায়িত্বের জন্য ফার্মেসি কাউন্সিল তাদের ‘ফার্মেসি ইন-চার্জ-ফার্মেসি ম্যানেজার’ পদে নিয়োগের উদ্যোগ নিচ্ছে। এছাড়াও, স্নাতক ফার্মাসিস্টরা ইতিমধ্যেই উচ্চমানের চিকিৎসা এবং যৌক্তিক ওষুধ ব্যবহারের জন্য সারা দেশে বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে কঠোর পরিশ্রম করছেন। ‘হাসপাতাল ফার্মাসিস্ট’ ছাড়া আজকের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া অসম্ভব।

আমাদের দেশে স্নাতক ফার্মাসিস্টের সহায়তা ছাড়াই ওষুধ রাখা, বিতরণ করা এবং বিতরণ করা হয়। এই দেশের হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স এবং স্নাতক ফার্মাসিস্টরা তাদের পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবায় যথেষ্ট অবদান রাখবে যখন স্নাতক ফার্মাসিস্টরা হাসপাতালে নিযুক্ত থাকবে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সংস্থায় স্নাতক ফার্মাসিস্টদের চাকরি এবং পদোন্নতির সম্ভাবনা দিয়ে স্বাস্থ্যসেবা উন্নত করা এখন সময়ের প্রয়োজন। ২০০৬ সালে দেশে স্নাতক ফার্মাসিস্টের সংখ্যা ছিল ২৮০, এবং এখন তা ২০,০০০ প্রতি বছর, গড়ে ৪,০০০ ফার্মাসি স্নাতক ১৫টি সরকারি এবং ২৮ টি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন এবং বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল তাদের স্নাতক ফার্মাসিস্ট হিসাবে নিবন্ধন করে।

বিশেষায়নে ফার্মাসিস্টরা,দিতেপারে নিশ্চিন্ত  স্বাস্থ্যসেবা

দেশে নিরাপদ ওষুধ সংরক্ষণ, ওষুধের অপব্যবহার প্রতিরোধ এবং যৌক্তিক ব্যবহারের জন্য সরকারি হাসপাতালে (জেলা হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল এবং মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল) ফার্মাসিস্টদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি হাসপাতালে উন্নত বিজ্ঞান-ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার জন্য ফার্মাসিউটিক্যাল বিপণন ও বিতরণ ব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন আনা। পজিশনিং করা যেতে পারে: 

  • প্রথম ধাপে – ফার্মাসিস্ট (ক্লিনিক্যাল)
  • দ্বিতীয় ধাপে-ফার্মাসিস্ট (ফার্মেসি ইনচার্জ)
  •  তৃতীয় ধাপে-সিনিয়র ফার্মাসিস্ট (ক্লিনিক্যাল)
  •  চতুর্থ ধাপে-ডেপুটি ফার্মাসিস্ট
  • পঞ্চম ধাপঃ-প্রধান ফার্মাসিস্ট।

হাসপাতালের ফার্মাসিস্টদের পরিচালনার জন্য এবং জেলা হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল এবং মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে স্নাতক ফার্মাসিস্ট নিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য স্বাস্থ্য ও ফার্মাসি সেবা বিভাগ, পাশাপাশি নার্সিং এবং মিডওয়াইফারি বিভাগগুলি প্রতিষ্ঠা  একান্ত প্রয়োজন ।

আমেরিকান ফার্মাসিস্টরা দ্য বোর্ড অফ ফার্মাসি বিশেষায়িত তেরো বিশেষায়নে ফার্মাসিস্টদের হসপিটালের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে ব্যবহার করছেঃ

  • কার্ডিওলজি ফার্মেসি
  • যৌগিক নির্বীজন প্রস্তুতি ফার্মেসি
  • ক্রিটিক্যাল কেয়ার ফার্মেসি
  • জেরিয়াট্রিক ফার্মেসি
  • সংক্রামক রোগ ফার্মেসি
  • পারমাণবিক ফার্মেসি
  • পুষ্টি সমর্থন ফার্মেসি
  • অনকোলজি ফার্মেসি
  • পেডিয়াট্রিক ফার্মেসি
  • ফার্মাকোথেরাপি
  • মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ফার্মেসি
  • সলিড অর্গান ট্রান্সপ্ল্যান্ট ফার্মেসি
  • ভ্রমণসংক্রান্ত যত্ন ফার্মেসি

উপরে উল্লেখিত বিভিন্ন ধাপে ফার্মাসিস্টগণ তাদের ফার্মাকোলজিক্যাল, টক্সিকোলোজিক্যাল, ফার্মাসিউটিক্যাল টেকনোলজি, বায়োফার্মাসিটিকস্ সমৃদ্ধ জ্ঞান তাদের বি ফার্ম/এম ফার্ম ক্লাসে শিখে আসেন এবং পরবর্তী সময়ে ইন্টার্নি/ইনপ্যাল্ট ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন করে রোগীর স্বাস্থ্যসেবায় নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। রোগীর ওষুধবিষয়ক জিজ্ঞাসা যেমন ডোজ বা মাত্রা, মাত্রার সমন্বয়, ওষুধ সেবনের নিয়মাবলি, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসহ ওষুধের যাবতীয় নির্দেশাবলি রোগীকে দিয়ে থাকেন।

সরকারি হাসপাতালগুলোতেও যদি গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের ‘হসপিটাল ফার্মাসিস্ট’ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়, তাহলে আমাদের দেশের সর্বস্তরের রোগীদের জন্য পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার এক বিশেষ দিক উন্মোচিত হবে। আশা করি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ স্বাস্থ্যবিষয়ক নীতিনির্ধারকরা গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের ভূমিকার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেবেন। বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসেবা ছড়িয়ে দিতে এবং একটি পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিশ্চিত করতে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের মূল্যায়ন করতে হবে। তাদের জ্ঞান, শিক্ষা ও দক্ষতা এ দেশের ওষুধশিল্প খাতকে যেমন উন্নতির শীর্ষে নিয়ে যাবে, তেমনি বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসেবা সর্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হবে।

হসপিটাল ফার্মেসির ইতিহাস সপিটাল ফার্মাসিস্ট এর দায়িত্ব

যুক্তরাষ্ট্রে যখন থেকে হাসপাতালের অস্তিত্ব ছিল তখন থেকে হাসপাতালে ফার্মাসিস্টের অবস্থানও ছিল। পেনসিলভেনিয়া হাসপাতাল ১৭৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরাঞ্চলের প্রথম হাসপাতাল। জনাথন রবার্টসকে এ হাসপাতালে একজন ওষুধ প্রস্তুতকারক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। তিনিই ছিলেন প্রথম হসপিটাল ফার্মাসিস্ট। আঠারো শতকে হসপিটাল ফার্মাসিস্টরা ছিলেন খুবই দুর্লভ, কারণ তখন হাসপাতালের সংখ্যা নগণ্য ছিল। আঠারো শতকের শুরু থেকে মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ঔষধি চিকিৎসায় বিভিন্ন বিশোধক পদার্থ, যেমন- ক্যাথারটিকস, ইমেটিকস এবং ডায়াফোরেটিকস ব্যবহার করা হত। হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য তখন ওষুধের চেয়ে বিশুদ্ধ বাতাস এবং ভালো খাবারকে গুরুত্ব দেওয়া হত। মেডিকেল অভিজাতরা তখন কোনো ওষুধ ব্যবহার করতেন না কিংবা নতুন এলকালয়েড ওষুধ, যেমন- মরফিন, স্ট্রাইকনিন এবং কুইনাইন ব্যবহার করতেন। তখন হাসপাতালে ফার্মেসি সেবাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হত না।

এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া শুরু করে যখন গৃহযুদ্ধের সময় হাসপাতালের পরিচালকেরা ওষুধ প্রস্তুত এবং মেডিকেল পণ্য ক্রয়ে ফার্মাসিস্টদের অভিজ্ঞতার জন্য ফার্মাসিস্ট খোঁজা শুরু করেন।১৮৭০ থেকে ১৮৮০ সালের মধ্যে অভিবাসীদের সংখ্যা বাড়ার সাথে হাসপাতালের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। বেশিরভাগ অভিবাসী ছিল রোমান ক্যাথলিক এবং তারা ক্যাথলিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে। ক্যাথলিক হাসপাতালে নানদের ফার্মেসি বিষয়ক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল।বিশ শতকের শুরুতে হসপিটাল ফরমুলারির আবির্ভাব হওয়ার ফলে হাসপাতালে ফার্মাসিস্টদের চাহিদা বাড়তে শুরু করে। ১৯২০ সালে অ্যালকোহল ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর হাসপাতালে ফার্মাসিস্টের চাহিদা বহুগুণ বেড়ে যায়। কারণ অ্যালকোহলযুক্ত যেসব ওষুধ রয়েছে সেসব বাণিজ্যিকভাবে ক্রয় করতে হত অনেক দাম দিয়ে, যা হসপিটাল ফার্মাসিস্টরা সহজে কম খরচে তৈরি করতে পারতেন।

১৯৩০ সালে ‘আমেরিকান হসপিটাল অ্যাসোসিয়েশান’ একটি কমিটি গঠন করে যা ফার্মেসির সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যা নির্ণয়ে কাজ করে এবং সমস্যা উত্তরণে বিভিন্ন পরামর্শ প্রদান করে। এডওয়ার্ড স্পিএস হসপিটাল ফার্মেসি স্ট্যান্ডার্ডের জনক হিসেবে পরিচিত। তিনি এবং রবার্ট পোর্টার ফার্মেসি এন্ড থেরাপিউটিক কমিটির ধারণা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫০ সালের শেষ দিকে ১০টি হাসপাতালের মধ্যে মাত্র ৪টিতে সার্বক্ষণিক ফার্মাসিস্ট ছিল। তখন ফার্মাসিস্টদের প্রধান কাজ ছিল বাল্ক কম্পাউন্ডিং এবং স্টেরাইল সল্যুশন তৈরি। তখন ফার্মাসিস্টদের কাছ থেকে ওষুধ বিষয়ক বিভিন্ন ব্যাপারে খুব কম পরামর্শই চাওয়া হত, যেমন- ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, ডোজেস ফর্ম ইত্যাদি। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত হাসপাতালে বিভিন্ন ফার্মাসিউটিক্যাল সেবার উপর চালানো অডিটের ফলে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে ‘মিরর টু হসপিটাল ফার্মেসি’ নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করা হয়। সময়ের সাথে সাথে যখন হাসপাতালের সংখ্যা বাড়তে থাকে তখন সেখানে ফার্মাসিস্টের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে থাকে। সেই সাথে বাড়তে থাকে হাসপাতালে ফার্মাসিস্টদের দায়িত্বও। বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের ক্রমবিকাশের মাধ্যমে আজকের অবস্থানে এসেছে হসপিটাল ফার্মেসি।

ফার্মাসিস্টরা অনেক সেটিংসে কাজ করতে পারেন

একজন ফার্মাসিস্ট কোনও খুচরা ফার্মাসিতে কাউন্টারের পিছনে কাজ করার চেয়ে অনেক বেশি কাজ করতে পারে। কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি প্রোগ্রামে পড়ান। হাসপাতালের কিছু কাজ করে রোগীদের জন্য সর্বোত্তম ক্রিয়াকলাপটি নির্ধারণে সহায়তা করে। অন্যরা ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পের জন্য কাজ করে, যেখানে তারা তাদের দক্ষতা এবং জ্ঞানকে নতুন ওষুধ বিকাশ, উন্নত ও ওষুধগুলি সংশোধন করতে সহায়তা করে। সরকারী সংস্থা পছন্দ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ (এনআইএইচ) এবং খাদ্য এবং ঔষধ প্রশাসন (এফডিএ) ফার্মাসিস্টদের নিয়োগ দেয়, স্বাস্থ্য বীমা সংস্থা এবং পরিচালিত যত্ন সংস্থাগুলির মতো। ডাক্তারদের মতোই ফার্মাসিস্টরা নির্দিষ্ট কিছু শাখার বিশেষজ্ঞ হিসাবে বোর্ড সার্টিফাইড হয়ে উঠতে পারেন। আমেরিকান ফার্মাসিস্টরা দ্য বোর্ড অফ ফার্মাসি সার্টিফিকেশন  সরবরাহ করে ১১ বিশেষত্ব ফার্মাসিটি অনুশীলনে: অ্যাম্বুলেটরি কেয়ার, কার্ডিওলজি, যৌগিক জীবাণুমুক্ত প্রস্তুতি, সমালোচনামূলক যত্ন, জেরিয়াট্রিক, সংক্রামক রোগ, পারমাণবিক ফার্মেসী, পুষ্টি সহায়তা, অনকোলজি, ফার্মাকোথেরাপি, সাইকিয়াট্রিক ফার্মাসি এবং অঙ্গ প্রতিস্থাপন। দ্য আমেরিকান কলেজ অফ ক্লিনিকাল ফার্মাসি এবং অন্যান্য সংস্থাগুলিও সার্টিফিকেশন প্রদানের মাধ্যমে ফার্মাসিস্টদেরকে মূল্যায়ন করে থাকেন।বিশেষায়িতকরণ ফার্মাসিস্ট রোগীর যত্নে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে দেয়  বিশেষত জটিল চিকিৎসায় বিশেষ অবদান রাখতে পারে।

শিল্প বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এ খাতে কর্মসংস্থানের হারও বাড়ছে। বর্তমানে প্রত্যক্ষভাবে এই শিল্পে লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে। পরোক্ষভাবে এ শিল্পের সঙ্গে আরও পাঁচ লক্ষাধিক লোক জড়িত। এ খাতের ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির বর্তমান ধারাটি অব্যাহত থাকলে আগামী পাঁচ বছরে এ খাতে নতুন করে আরও দুই লাখ লোকের কর্মসংস্থান সম্ভব। আর পরোক্ষভাবে জড়িত শিল্পের হিসাব ধরা হলে এটি ৫ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে।

ফার্মাসিস্টরা সাধারণভাবে কি করেন?

ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, সিরাপ, সাসপেনশন, ইমালশনসহ বিভিন্ন প্রকারের ওষুধ পাওয়া যায়। কোন রোগীর জন্য কোন প্রকারের ওষুধ ভালো হবে তা নির্ধারণ করা হসপিটাল ফার্মাসিস্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। ওষুধ প্রয়োগের জন্য বিভিন্ন পথ রয়েছে, যেমন মুখ, রক্তনালী, শ্বাসতন্ত্র, পায়ু ইত্যাদি। কোন পথে ওষুধ প্রয়োগ করলে রোগীর জন্য ভালো হবে তা রোগীর অবস্থা বিবেচনা করে ঠিক করেন হসপিটাল ফার্মাসিস্টরা।

  • কোন ওষুধ কী মাত্রায় খেতে হবে, দিনে কতবার খেতে হবে এবং কত দিন খেতে হবে এই সম্পর্কে রোগীকে তথ্য প্রদান করা।
  • রোগীর উপর প্রয়োগকৃত ওষুধের কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করা এবং ওষুধের কার্যকারিতা সম্পর্কে রোগীকে পরামর্শ প্রদান করা।
  • ড্রাগ ইন্টারঅ্যাকশন অর্থাৎ  একটি ওষুধের সাথে অন্য কোনো ওষুধ খাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে রোগীদের পরামর্শ দেওয়া। দুই বা ততোধিক ওষুধ একসাথে খেলে যদি কোনো প্রতিক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সেই সম্পর্কেও রোগীদের ধারণা প্রদান করে থাকেন হসপিটাল ফার্মাসিস্টরা।
  • বিভিন্ন ওষুধের বিভিন্ন ধরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে, যেমন- জ্বর, বমি, ঝিমানো ইত্যাদি। কোন ওষুধ খেলে কী ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে তা নিয়ে রোগীদের তথ্য প্রদান করাও হসপিটাল ফার্মাসিস্টদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
  • কিছু ফার্মাসিস্ট, যেমন- ক্লিনিক্যাল ফার্মাসিস্ট রোগীদের কিছু ওষুধ প্রেসক্রাইবও করতে পারেন।
  • প্রয়োজনীয় চিকিৎসার পর যেসব রোগীকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করা হয় তাদের তথ্য লিপিবদ্ধ করা এবং রিলিজের  সময় দেওয়া তথ্যের সাথে মিল রেখে সঠিক ওষুধ প্রেসক্রাইব করা হয়েছে কি না তা নিশ্চিত করা।
  • হাসপাতালের প্রয়োজনীয় ওষুধ সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়া।
  • জিএমপ, ISO  গাইডলাইন অনুযায়ী নির্ভরযোগ্য ওষুধ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পর্যবেক্ষণ করা।
  • ক্রয়কৃত ওষুধের গুণগত মান পর্যবেক্ষণ ও নিশ্চিত করা।
  • সঠিক তাপমাত্রায় ওষুধ সংরক্ষণ নিশ্চিত করা।
  • সঠিক ওষুধ বিতরণ করা।
  • প্রস্তুতকৃত ওষুধ পাওয়া না গেলে রোগীর জন্য ওষুধ প্রস্তুত করা।
  • প্রস্তুতকৃত এবং বিতরণকৃত ওষুধের তথ্য লিপিবদ্ধ করা।
  • বিভিন্ন ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালনা করা।
  • ডাক্তার, নার্স এবং রোগীর মাঝে সমন্বয় সাধন করা।
  • ডাক্তার, নার্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের ওষুধ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ও হালনাগাদ তথ্য প্রদান করা।
  • ফার্মাসিউটিক্যাল তথ্য সরবরাহ।

সাধারণ রোগ এবং রোগের অবস্থার পরামর্শসহ স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ এবং পরামর্শ সহ রোগীদের সরবরাহ করা।

  • ফার্মেসী প্রযুক্তিবিদ এবং অন্যান্য কর্মীরা প্রেসক্রিপশনে ওষুধ সরবরাহের তদারকি।
  • রোগীদের এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহকারীদের ওষুধের সর্বোত্তম ব্যবহার (যেমন, সঠিক ব্যবহার, এড়ানো) সম্পর্কিত শিক্ষা এবং পরামর্শ অতিমাত্রায.।
  • ওষুধেরর ফার্মাকোকিনেটিক গুনাগুনমূল্যায়ন
  • ড্রাগের মাত্রা নির্ধারণ সূত্রগুলি তৈরি করা।
  • ড্রাগ উন্নয়নের জন্য ক্লিনিকাল ট্রায়াল ডিজাইন করা।
  • নিরাপদ ওষুধ নীতিগুলি বিকাশের জন্য স্থানীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির সাথে কাজ করাসহ সমস্ত ওষুধের লেবেলের নির্ভুলতা নিশ্চিত করা।

বাংলাদেশের অভিজাত কয়েকটি হাসপাতাল ছাড়া অন্য হাসপাতালগুলোতে এখনও হসপিটাল ফার্মাসিস্টদের তেমন উপস্থিতি নেই। তবে দেশের সব সরকারি হাসপাতালে ফার্মাসিস্ট নিয়োগের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশাপাশি হসপিটাল ফার্মাসিস্টরা মানবসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন- এই আশাবাদ সবার।

যদি ওষুধটি ভুলভাবে ব্যবহার করা হয় তবে রোগীর শরীরে এই জাতীয় সমস্যা দেখা দিতে পারে। ডোজ সংখ্যা, ডোজ পরিমাণ, এবং ওষুধের প্রকৃতি সবই রোগীর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনুভব করতে অবদান রাখতে পারে। এই ধরনের সমস্যাগুলি এড়াতে, রোগীকে ওষুধ দেওয়া উচিত এবং ফার্মাসিস্টের সাথে কথা বলা উচিত।  বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যমান স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাগুলি সমস্ত স্বাস্থ্য পেশাদারদের অনুশীলনকে অপ্টিমাইজ করে না এবং গুণমান এবং অ্যাক্সেসযোগ্যতার তুলনামূলক বৃদ্ধি ছাড়াই ক্রমবর্ধমান পরিমাণ খরচ করে। এই ত্রুটিগুলি কীভাবে সমাধান করা যায় সে সম্পর্কে অসংখ্য প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।ফার্মাসিস্টদের রোগীর যত্নে অবদান রাখতে আরও ভালভাবে সক্ষম করার জন্য কিছু অগ্রগতি করা হয়েছে, তবে এই পরিবর্তনগুলির সম্ভাব্যতা অপ্টিমাইজ করার জন্য আরও বেশি প্রয়োজন। আমি ব্যক্তিগতভাবে নিম্নলিখিত স্বাস্থসেবা ব্যবস্থাপনায় ব্যবহারিক এবং অর্জনযোগ্য ক্রিয়াগুলির সুপারিশ  করছি-

  • সরকারকে ফার্মাসিস্টদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওষুধ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
  • ওষুধ রেগুলেটরির সমস্ত জায়গায় ফার্মাসিস্টদের বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসর প্রাপ্ত ফার্মেসির শিক্ষকগণদের নিয়োগ   নিশ্চিত করতে হবে।
  • স্বাস্থ্য ব্যবস্থাগুলি কেয়ার ডেলিভারি মডেলগুলির মধ্যে এবং ড্রাগ থেরাপি ব্যবস্থাপনার সমন্বয়কারী হিসাবে ফার্মাসিস্টদের নিয়োগ ব্যবস্থা করতে হবে।
  • ইন্টিগ্রেটেড ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমগুলি প্রয়োগ করা হয় যা ফার্মাসিস্টদের অন্যান্য স্বাস্থ্য পেশাদারদের সাথে সহযোগিতায় ড্রাগ থেরাপির সমন্বয় ও পরিচালনা ফার্মাসিস্টদের নিয়ন্ত্রনে দিতে হবে।

পরিশেষে, স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় ফার্মাসিস্টদের আরও ভালভাবে সংহত করার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে, তবেই তো বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা হিসেবে  বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। আমি বিশ্বাস করি সেসময় আর বেশি দেরি নয়। প্রতি বছর উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের মানুষ যেভাবে বিদেশ গমন করেন ও টাকা ব্যায় করে তাতে আমি মনে করি, দেশের মানুষ আমাদের চিকিৎসা সেবা উপর পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারছেনা অথবা যথাযথ সেবা আমরা দিতে পারছিনা।  সুতরাং স্বাস্থ্য সেবা খাতকে চিকিৎসক ও ফার্মাসিস্টদের সমন্বয়ে আমাদের এমন ভাবে ঢেলে সাজাতে হবে যেন তা দেশ ও বিদেশের মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারে।তবেই তো হসপিটাল ট্যুরিজম হতে পারে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের নতুন এক উৎস।

লেখক- সহকারী অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ,  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ-৮১০০।   

The Campus Today YouTube Channel

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
themesbazar_creativenews_II7
All rights reserved © 2019-20 The Campus Today