রবিবার, ১১ জুন ২০২৩, ০৩:৪৩ পূর্বাহ্ন

বাবার চিকিৎসা হয়নি টাকার অভাবে, মেয়ে এখন মেডিকেল শিক্ষার্থী

  • আপডেট টাইম বুধবার, ২৭ জুলাই, ২০২২, ১২.৪৫ পিএম

ক্যাম্পাস টুডে ডেস্কঃ বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মরতে দেখেছেন বাবাকে। হারিয়েছেন বসতভিটাটুকুও। নবম শ্রেণি থেকে পরিবারের বোঝা কাঁধে নিতে হয়েছে। সংসার চালানোর পাশাপাশি টিউশনি করে ভাই-বোনকে পড়িয়েছেন। বহু ঝড়ের মধ্যেও নিজের স্বপ্ন ছোঁয়ার সংগ্রামে অটল ছিলেন।

এবার মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন আঁখি রানী তালুকদার। আগামী ১ আগস্ট ক্লাস শুরু হচ্ছে তাঁর। সুনামগঞ্জের অদম্য এই তরুণীর সংগ্রামের গল্প লিখেছেন পিন্টু রঞ্জন অর্ক

তিন ভাই-বোনের মধ্যে মেজো আঁখি। বাবা রমেন্দ্র তালুকদার ছোটখাটো ব্যবসা করতেন। একসময় ঋণে জর্জরিত হয়ে সব হারালেন। তিনি নিজে বেশি দূর পড়তে না পারলেও চাইতেন সন্তানরা যেন উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হোক। বোঝাতেন শিক্ষার মাধ্যমেই অভাবের অন্ধকার ঘুচে আলো আসবে পরিবারে। ছেলে-মেয়েদের বলতেন, ‘যত কষ্টই হোক, পড়াশোনা করতে হবে। অনেক বড় হতে হবে জীবনে!’

আঁখিও মন দিয়ে পড়তেন। ক্লাসে বরাবরই প্রথম হতেন। পিইসিতে জিপিএ ৫ পেয়ে উপজেলায়ও প্রথম হলেন তিনি। ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেলেন। খবরটা শুনে রমেন্দ্রের আনন্দ যেন আর ধরে না। কিন্তু এই সুখ কপালে সইল না বেশি দিন।

আঁখি তখন তাহিরপুরের বাদাঘাট পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছেন। স্কুলে থাকতেই হঠাৎ একদিন খবর পেলেন—বাবা গুরুতর অসুস্থ। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডাক্তার বললেন, ‘কিডনি অকেজো হয়ে গেছে। ’

টাকার অভাবে ঠিকঠাক চিকিৎসাও হচ্ছিল না মানুষটার। আঁখির মা মীনা রানী পাল তখন অনেকের দ্বারস্থ হয়েছেন, কিন্তু সাড়া মেলেনি। স্বামীর চিকিৎসার খরচ জোগাতে একসময় বাধ্য হলেন ভিটামাটি বিক্রি করতে। পরে সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি করা হলো রমেন্দ্রকে। তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আঁখির জেএসসি পরীক্ষার মাসখানেক আগে দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন তিনি। সঙ্গে পুরো পরিবারের স্বপ্নের যেন সমাধি হলো। বাবার জন্য বিলাপ করবেন, যেন সেই সময়টুকুও পেলেন না আঁখি। কয়েক দিন পরই বসতে হলো পরীক্ষার টেবিলে। পড়াশোনা করে বড় হতে হবে যে!

এদিকে বাবা নেই। বসতভিটাও নেই। থাকবেন কোথায়? বাড়িটা যাঁদের কাছে বিক্রি করেছেন, তাঁদের বলেকয়ে কয়েক মাস ছিলেন সেখানে। এত সব ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যেও জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেলেন আঁখি! নবম শ্রেণি থেকেই শুরু করলেন টিউশনি। হাজার তিনেক টাকার মতো পেতেন মাসে। তা দিয়ে নিজের এবং বড় বোন ও ছোট ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ, পরিবারের খরচ সবই চলত। আঁখির বড় বোন তখন সিলেটের একটি প্রতিষ্ঠানে ডিপ্লোমা পড়ছিলেন। ছোট ভাই প্রাইমারি স্কুলে।

এসবের মধ্যে এলো এসএসসি পরীক্ষা। একদিন পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফিরে দেখেন, তাঁদের থাকার ঘরটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। বইপত্র থেকে শুরু করে সব উঠানে ছড়ানো-ছিটানো। ছোট ভাইকে কোলে নিয়ে উঠানের এক কোণে বসে অঝোরে কাঁদছেন মা। শুধু বলছিলেন, ‘মেয়েটার পরীক্ষা শেষের সময়টাও দিলেন না। ’ পরদিন ছিল আঁখির পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষা। এক প্রতিবেশী তখন পরীক্ষা চালিয়ে নেওয়ার জন্য কিছুদিন আশ্রয় দিলেন তাঁকে। আর ছোট ভাইকে নিয়ে মা চলে গেলেন মামার বাড়ি। যা হোক, সেই প্রতিবেশীর বাড়িতে থেকেই বাকি পরীক্ষাগুলোয় অংশ নিলেন আঁখি। এভাবে পরীক্ষা দিয়েও পেলেন এ প্লাস।

এসএসসি পরীক্ষা শেষে তাঁরা একটি ভাড়া বাসায় উঠলেন। বাসা ভাড়া, মাসিক খরচ, বড় বোন ও ছোট ভাইয়ের পড়াশোনা—সব কিছুর দায়িত্ব তখন কিশোরী আঁখির কাঁধে! প্রতিদিন ১০ থেকে ১১ ঘণ্টা করে টিউশনি করতেন। মাস শেষে কেউ ৫০০ টাকা, কেউ বা এক হাজার টাকা দিতেন। তবু সংসার তো চলছে! আঁখি বললেন, ‘পড়াশোনা শেষেই দিদির চাকরি হওয়ার কথা। তাই চেয়েছিলাম, যত কষ্টই হোক আমি করব। ’

এ জন্য খেয়ে না খেয়ে দিন পার করেছেন। এক শাক কিংবা আলুভর্তা কত দিন ভালো লাগে? খেতে বসলেই মন খারাপ হয়ে যেত। মনে মনে নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিতেন—‘দিদির চাকরি হলে প্রতিদিন মাছ-মাংস দিয়ে ভাত খাব আমরা। ’

এ সময় অনেকেই আঁখির মাকে বলত মেয়েটাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য, কিন্তু মীনা রানী সেসবে কান দিতেন না। আঁখিকে বলতেন, ‘লোকের কথায় কান দিবি না। আর কয়েকটা দিন পরই তো সব কিছু হই যাইব। বড় মেয়ে চাকরি করব। আমাদের দিন ফিরব। ’

এসএসসিতে ভালো ফলের কারণে সিলেট সরকারি কলেজে ভর্তির সুযোগ পেলেন আঁখি, কিন্তু টানা আট মাস কলেজে যেতে পারেননি। ‘কেন?’ আঁখির পাল্টা প্রশ্ন, ‘কলেজে গেলে পরিবার চালাবে কে? নতুন জায়গায় টিউশনি পাওয়ারও নিশ্চয়তা নেই। সিলেটে গিয়ে থাকবই বা কোথায়?’

এই আট মাসে শুধু পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। বললেন, ‘দিদির পড়ালেখা তখন শেষের দিকে। পাস করলেই চাকরি হওয়ার কথা তার। তাই কষ্ট হলেও টিউশনি করে গেছি। ’ ২০১৯ সালে আঁখির বড় বোনের চাকরি হলো চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে; ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে। এর পর থেকে আঁখির ভার কিছুটা কমল। তিনি নামলেন নিজের স্বপ্ন পূরণের সংগ্রামে। আট মাস পরে ক্লাসে গিয়েও টেস্ট পরীক্ষায় কলেজে সেরাদের মধ্যে স্থান করে নিলেন! এইচএসসিতে পেলেন জিপিএ ৫।

এরপর এলো ভর্তিযুদ্ধ
বাবা এক প্রকার বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। তখন থেকেই আঁখি সংকল্প করেছিলেন চিকিৎসক হবেন। ‘ওই সময় আসলে আমাদের কিছু করার ছিল না। প্রথম থেকেই যদি বাবাকে ভালো ট্রিটমেন্ট করাতে পারতাম, তাহলে হয়তো অকালে চলে যেতে হতো না তাঁকে। তাই ঠিক করলাম, আমাকে লড়তে হবে, যেভাবেই হোক চিকিৎসক হতে হবে! রাতে বাবার পাশে বসে পড়ার অভ্যাস ছিল আমার। তাঁর মৃত্যুর পর যখনই পড়তে বসেছি, চোখে জল এসে গেছে!’

এইচএসসির পর মেডিক্যাল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিলেন, কিন্তু কপাল মন্দ। প্রথমবার অপেক্ষমাণ তালিকায় ছিলেন। দ্বিতীয়বার আটঘাট বেঁধে নামলেন। যে করেই হোক ভর্তি পরীক্ষায় টিকতে হবে। চিকিৎসক যে হতে হবে। কোচিং করেননি। বাসায় পড়েছেন। পরিশ্রমের ফলও পেলেন হাতেনাতে। ২০২১-২২ সেশনের ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় স্থান করে নিয়ে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেলেন। মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সহায়তায় এরই মধ্যে ভর্তিও হয়ে গেছেন।

আগামী ১ আগস্ট থেকে মেডিক্যালের জীবন শুরু হবে আঁখির। চিকিৎসক হয়ে গরিব রোগীদের বিনা ফিতে সেবা দেবেন তিনি। বললেন, ‘একেবারে কাছ থেকে দেখেছি, চিকিৎসার অভাবে মানুষ কিভাবে মারা যায়। গরিব রোগীদের কাছ থেকে ফি নেব না আমি। ’

পুরো পরিবার নিয়ে সিলেটেই থাকেন আঁখি। এখনো টিউশনি করেন। তাঁর ভাইটি এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী। বড় বোন সিলেটের একটি হাসপাতালের ফিজিওথেরাপিস্ট। এত দিন পরিবারের জন্য করেছেন। এবার চিকিৎসক হয়ে দেশের মানুষের জন্য কিছু করার সংকল্প নিয়েছেন আঁখি। সৌজন্যেঃ কালের কন্ঠ।

The Campus Today YouTube Channel

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
themesbazar_creativenews_II7
All rights reserved © 2019-20 The Campus Today