বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয় ভিত্তিক বিভাগ, কর্মক্ষেত্রে নেই বিষয় ভিত্তিক চাকরি

বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয় ভিত্তিক বিভাগ, কর্মক্ষেত্রে নেই বিষয় ভিত্তিক চাকরি

বিশ্ববিদ্যালয় হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে উচ্চশিক্ষা প্রদান করা সহ বিভিন্ন ধরনের গবেষণামূলক কাজকর্ম করা হয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষার্থীর স্বপ্ন পূরণের আশ্রয়স্থল বলা যায়। হাজারো শিক্ষার্থী হাজারো স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সেটা পাবলিক হোক, বা বেসরকারি হোক; বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে শিক্ষার্থীদের আবেগ জড়িয়ে থাকে। কারণ তাদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন পূরণের ধাপ এখান থেকেই শুরু হয়ে থাকে।সেক্ষেত্রে বিষয় নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিষয়ের অভাব নেই। শিক্ষার্থীরা হয়ত কেউ স্বেচ্ছায়, কেউ বা অনিচ্ছায় বিষয়গুলোতে ভর্তি হয়।বিষয়ের অভাব না থাকলেও শ্রমবাজারে রয়েছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের কর্মক্ষেত্রের অভাব।তাদের চাহিদা অনুযায়ী নেই সেই বিষয়ের গবেষণাকেন্দ্র, নেই বিষয়ভিত্তিক কর্মসংস্থান। ফলে দেশে তৈরি হচ্ছে উচ্চশিক্ষিত বেকার।

দেশের সর্বোচ্চ সম্মানের বিষয়ে পড়াশোনা করেও নেই নিজ দেশে এর বাস্তবিক প্রয়োগক্ষেত্র।এতে শিক্ষার্থীদের মনে একদিকে যেমন বিষয়ের প্রতি অনাগ্রহের সৃষ্টি হচ্ছে তেমনি বিষয়ভিত্তিক কর্মক্ষেত্রের অপ্রতুলতার কারণে তাদের মনে জন্ম সৃষ্টি হচ্ছে হীনমন্যতা। এ নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চিন্তা ভাবনা তুলে ধরেছেন – ইসরাত জাহান।


“বর্তমান সময়ে শিক্ষা এবং চাকুরী এ দুটি বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত৷ শিক্ষিত হওয়া ছাড়া ভালো চাকরি পাওয়া যায় না৷ তবে অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিও কর্মক্ষেত্রের অভাবে চাকরি পায় না৷ শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও দিনের পর দিন তারা বেকার থেকে যায়৷ এর জন্য আমাদের বর্তমান সময়ের শিক্ষা ও চাকরি পদ্ধতির ভিন্নতাই দায়ী৷

আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করি তাদের কথা চিন্তা করলে দেখা যায় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে অসংখ্য বিষয় রয়েছে৷ সকলে কিন্তু এক বিষয়ে পড়ে না৷ তারপরও সকলকে একটি নির্দিষ্ট সিলেবাসের আলোকে পরীক্ষার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চান্স পেতে হয়৷ অনুরূপভাবে আমাদের চাকরি ক্ষেত্রটাও এমন৷ প্রত্যেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা বিষয়ে পড়া সত্ত্বেও চাকরির ক্ষেত্রে একই রকম প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে হয়৷

যা বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার সাথে সম্পূর্ণ বিরোধী বলে আমি মনে করি৷ বাস্তবিকপক্ষে যে শিক্ষার্থী যে বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করছে তার চাকুরী ক্ষেত্রটাও তেমন হওয়া উচিত ছিল৷ কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ের সাথে চাকুরীর বাজারে নেই বিষয় সংশ্লিষ্ট কোনো চাকরি। আবার বিশেষায়িত বিষয়ে পড়ালেখা করে ও অনেকে চাকরি করছেন অন্য খাতে।

সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান,বাংলা, ইসলামের ইতিহাস বা দর্শনের মতো বিষয়ে লেখাপড়া করে নেই তাদের সঠিক কর্মসংস্থান। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া চুকিয়ে তারা দৌড়ে বিসিএস, ব্যাংকিং বা সাধারণ পেশার পিছনে।

প্রত্যেক বিষয়ের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে তাদের চাকরি করার চাহিদা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন কর্মসংস্থান থাকা দরকার ৷ কিন্তু আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন ধরনের বিষয় থাকলেও নেই সে অনুযায়ী কর্মক্ষেত্র। ফলে দিন দিন বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং কেউ তেমন উদ্যোক্তা হয়েও গড়ে উঠছে না। আর চাকরিক্ষেত্রে বিষয়ের সাথে চাকরির মিল না থাকার কারণে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বিষয়কে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না৷ বরং সকলে একই চাকরির পিছনে ছুটছে৷

আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে চাই, আমরা যে যেই বিষয়ে পড়াশুনা করছি সে বিষয়ে পরিপূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করে কর্মক্ষেত্রে সেটাকে কাজে লাগাতে ৷ আমাদের দেশে রয়েছে বিষয় সংশ্লিষ্ট কর্মসংস্থান অভাব।

এজন্য দেশের বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভালো ভালো বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেও সঠিক কর্মসংস্থানের অভাবে দেশে তৈরি হচ্ছে উচ্চ শিক্ষিত বেকার। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে ও ভবিষ্যৎ নিয়ে রয়েছে নানা দুশ্চিন্তা। এজন্য বেকারত্বের হার কমাতে, শিক্ষিত ও উদ্যোগী জনশক্তি তৈরি করতে চাই সঠিক কর্মসংস্থান ব্যবস্থা।

মোঃ নাদিম হাসনাইন, আরবি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।



উচ্চমাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে একরাশ স্বপ্ন ও বিস্তর ভর্তিযুদ্ধের মাধ্যমে লড়াই করে দেশের একটা স্বনামধন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাই।একজন দর্শনের শিক্ষার্থী হিসেবে খুঁজতে থাকি আমার উপযুক্ত কর্মক্ষেত্র কি হতে পারে।

কিন্তু, এ দেশের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে যতগুলো বিষয় পড়ানো হয় সে সমস্ত বিষয়ভিত্তিক চাকরির তেমন কোনো ক্ষেত্রই নেই এ দেশে।বরং চাকরির জন্য একাডেমিক পড়াশোনার বাইরে প্রস্তুতির আলাদা জগৎ তৈরি করতে হয়।এ ব্যাপারটি একদিকে নিজের বিষয়ের প্রতি মনোনিবেশ করতে বাঁধা দিচ্ছে অপরদিকে ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষার সাথে বিষয়সংশ্লিষ্ট কর্মক্ষেত্র বেকারত্ব কমাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখলেও বাংলাদেশের চিত্রটা অনেকটাই বিপরীত।

এমতাবস্থায় আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। নতুন নতুন বিভাগ খোলার ক্ষেত্রে শ্রমবাজারের বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে। এতে শিক্ষার্থীরা তাদের নিজ নিজ বিষয়ে মনোনিবেশ করতে পারবে।আর শিক্ষার্থীদের স্বপ্নেই তো রঙ্গিন হবে দেশ।

তনুশ্রী সাহা, দর্শন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।



বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হলেও বর্তমানে ৪৬ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিষয়ভিত্তিক পড়াশুনা করে; অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে তাদের ধারণাও বেশ স্বল্প হয়ে থাকে।

এতে শিক্ষার্থীদের চাকরির জন্য আলাদা পড়াশুনাও করতে হচ্ছে, এ জন্য তারা নিজস্ব বিষয়গুলো তেমন কোনো কাজে লাগতে পারছে না। তাছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এত এত বিষয় থাকা সত্ত্বেও বিষয়ভিত্তিক চাকরির ব্যবস্থা না থাকায় শিক্ষার্থীরা নিজেদের বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কোনো কাজে লাগাতে পারছে না।

ফলে তাদের অধিকাংশই বেকার থেকে যাচ্ছে।দেখা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থী যে বিষয়ে পড়াশোনা করছে, চাকরির বাজারে নেই সেই বিষয়ভিত্তিক চাকরি। এর দরুন, বেশিরভাগ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ৪/৫ বছর একটি বিষয়ের উপর পড়াশোনা করেও, শেষ পর্যায়ে চাকরির জন্য এসে তাদেরকে বিসিএস, ব্যাংকিং এসব কর্মের জন্য ছুটতে হয়।

এর কারণে একদিকে যেমন এসব ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা বাড়ছে, তেমনি দেখা দিয়েছে বেকার সমস্যা যা দেশের জন্য অর্থনৈতিক সংকটের কারণ হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের স্ব স্ব বিষয়ের বিভাগের মতো চাকরির বাজারে ও এই বিষয় গুলোর চাহিদা বাড়ানো দরকার। নয়ত ভবিষ্যতে এই উচ্চ শিক্ষিত বেকাররা দেশের অর্থনীতির জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে।

মো. নূরআলম সিদ্দিকী, বাংলা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।



বিশ্ববিদ্যালয় হলো শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন পূরণের জায়গা।।অনেক স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইইই বিভাগে ভর্তি হয়েছি।সবচেয়ে আভিজাত্যের একটি বিষয় হলেও সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে বাংলাদেশে আজও এই বিভাগে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের জন্য তাদের বিষয়ভিত্তিক চাহিদাসম্পন্ন কর্মসংস্থান গড়ে উঠেনি।

শিক্ষার্থীরা অনেক আশা নিয়ে এ বিভাগে পড়তে আসে ঠিকই কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে যখন তারা চাকরি বাজারে প্রবেশ করতে যায় তখনই যেন তাদের মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকার মতো অবস্থা তৈরি হয়। ফলে অধিকাংশ শিক্ষার্থী তখন দেশের বাইরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। দুঃখের বিষয় এই যে, আমাদের দেশে ইইই, কম্পিউটার সায়েন্স, মেকানিক্যাল ও বায়ো – মেডিকেল বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য নেই চাহিদামাফিক কর্মক্ষেত্র।দেশ ও জাতির প্রধান সম্পদ হলো দক্ষ জনশক্তি। তাত্ত্বিক জ্ঞানের সাথে ব্যবহারিক জ্ঞানের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমেই জনগণকে জনসম্পদে পরিণত করা সম্ভব হয়।

তাই দক্ষ জনসম্পদ তৈরি করতে হলে চাই নিজ দেশে স্ব স্ব বিষয়ের কর্মসংস্থান। এতে শিক্ষার্থীদের যেমন নিজ নিজ বিষয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়বে তেমনি নিজ দেশের জনসম্পদ নিজ দেশের জন্য কাজ করে যেতে পারবে।

নুরে আলম, ইইই বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *