বৃহস্পতিবার, ০৮ জুন ২০২৩, ০৩:৩৯ অপরাহ্ন

বিশ্ব পর্যটন দিবস: পর্যটন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ভাবনা ও প্রত্যাশা

  • আপডেট টাইম সোমবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১১.৫২ এএম
বিশ্ব পর্যটন দিবস: পর্যটন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ভাবনা ও প্রত্যাশা

আজ বিশ্ব পর্যটন দিবস। প্রতি বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর তারিখে সারা বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে থাকে বিশ্ব পর্যটন দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যদিয়ে দিবসটি পালিত হবে। পর্যটনের ভূমিকা সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উপযোগিতাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া এ দিবসের লক্ষ্য। জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থার (ইউএনডব্লিউটিও) উদ্যোগে ১৯৮০ সাল থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর দিবসটি পালন করা হয়। বিশ্ব পর্যটন দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির জন্য পর্যটন’।

বিশ্ব পর্যটন দিবস উপলক্ষে পর্যটন নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পাঁচ শিক্ষার্থী লিখেছেন। তারা হলেন- মোঃ মিরাজ হোসেন, মোঃ আউয়াল হোসেন (আশিক), চন্দলা ত্রিপুরা, ফাতেমা আজমী এবং মাহাথির মোরসালিন (অংক)।

হিল ট্যুরিজমঃ পাহাড়ি জীবন ও সংস্কৃতিতে পর্যটনের সম্ভাবনাময় ধারা

মোঃ মিরাজ হোসেন
শিক্ষার্থী, ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

সংস্কৃতি বলতে সাধারণ অর্থে মানুষের বাহ্যিক আচার আচরণ, ব্যবহার, ধর্ম, জীবনযাপন ও পারিপার্শ্বিক কার্যক্রম কে বোঝায়। রাষ্ট্রের মানুষের মধ্যে বিচিত্রতা নিয়ে আসে সংস্কৃতি। সকল দেশের মানুষই তাদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে চায় বিশ্বের পর্দায়। তাদের উৎসব উদযাপনে আমন্ত্রণ জানায় অন্যদের, নিজেদের বৈচিত্র্যতার মাধ্যমে জানান দিতে চায় পুরো বিশ্বকে।

বাংলাদেশ ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর আয়তনের ক্ষেত্রে বঞ্চিত হলেও পেয়েছিল এক বিচিত্র সংস্কৃতি। বিচিত্র সংস্কৃতি দিয়েই ধীরে ধীরে পৃথিবীতে জানান দিয়েছিল নিজের অস্তিত্বের, বাঙালি জাতিসত্তার এবং আমাদের সোনার বাংলার। বারো মাসে তের পার্বণ উদযাপন করা বাঙালির জীবনে সংস্কৃতি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটারের এই দেশে সমতল ভূমি, পাহাড়, নদ-নদী এসবকে ঘিরে ঘড়ে উঠেছে নতুন জাতি, উপজাতি যাদের ভাষা, আচার আচরণ, ধর্ম, বর্ণ, খাবারে রয়েছে নিজস্বতা ও বিচিত্রতা।

বাংলাদেশ একটি সমতল ভূমির দেশ হলেও শুধুমাত্র দক্ষিণ পূর্বে চট্টগ্রামে পাহাড়, উত্তর পূর্বে সিলেটে নিচু পাহাড় এবং উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে উচ্চভূমি আছে। এসবের মধ্যে অন্যতম পাহাড় সমূহ হচ্ছে সাকা হাফং, তাজিংডং, মোদক মুয়াল, দুমলং, কেওক্রাডং ও জোগি হাফং। জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবে অনুসারে, বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যা ৪৫টি এবং এদের বেশিরভাগই পাহাড়ে বসবাস করে। তাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস ও উৎসব। এই পাহাড়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল আদিম সভ্যতা। তখন ছিল না ঘর, সবাই বাস করতো পাহাড়ের গুহায়। গায়ে ছিল না আজকালের আধুনিকতার ছোঁয়া। এই ধারা গুলো আজও রয়ে গেছে আমাদের দেশের পাহাড়ে বসবাসকারী ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর মানুষদের মধ্যে।

আমাদের দেশের পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, ম্রং, সাঁওতাল, রাখাইন, মনিপুরি এসব ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস। তাদের অতি সাধারণ জীবনযাপন, কাঠের ঘর, মসলা বিহীন খাবার, পোশাক, সমতলের মানুষদের মনে তৈরি করে কৌতূহল। তাদের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি ও উৎসব। প্রতিবছর বাঙালি বর্ষ বরণের সাথে তারাও তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির বৈসাবি উৎসব পালনের মাধ্যমে বছর শুরু করে। এছাড়াও চাকমাদের ৩ দিন ব্যাপী বিজু উৎসব, মারমাদের সাংগ্রাই, ত্রিপুরাদের বৈসুক, তঞ্চঙ্গ্যাদের বৈসুক, মুরংদের চাংক্রান, সাঁওতালদের সহরায় উৎসব জীবনে যুক্ত করে রোমাঞ্চিত ধারা।

মানুষের নতুনকে জানা ও ঘুরে দেখা, ব্যবসায় কিংবা ধার্মিক প্রয়োজনের ধারণা থেকেই সৃষ্টি পর্যটন শিল্পের। এই শিল্পের মোট ৪০% পর্যটক আসে কালচার বা সংস্কৃতি কে জানতে, ঘুরে দেখতে এবং নতুন কিছু শিখে নিতে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ যেমন স্পেন, ব্রাজিল, চায়না, মেক্সিকো সহ আমাদের পাশের দেশ ভারত, নেপাল ও ভুটান তাদের সংস্কৃতির মাধ্যমে প্রচুর পর্যটক আকর্ষণ করতে পারছে যেদিক থেকে বাংলাদেশেরও রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় পাহাড় ও পাহাড়ি সংস্কৃতি খুলে দিয়েছে এই বিপুল সম্ভাবনা দ্বার। একটি বা দুটি নয়, রয়েছে বহুমুখী সম্ভাবনা। বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে পশ্চিমা দেশের জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের মতন ধারা, জনপ্রিয় হতে পারে আদিম যুগের মতো তাঁবু গেড়ে রাত্রি যাপন করা, পাহাড়ি অতিসাধারণ জীবনযাপন হতে পারে মানুষের আকর্ষণের অন্যতম কারণ। গড়ে উঠতে পারে পাহাড়ের দুর্গম পথ ধরে বেয়ে উঠা ট্র্যাকিং, রাফটিং, জিপলাইনিং, বাইকিং, হাইকিং, সাইক্লিং ও পাহাড়ের ঢলে বেয়ে চলা নদীতে কায়াকিং এর মতন নতুন নতুন ট্রেন্ড বা ধারা।

বর্তমানে আমাদের দেশে পাহাড় ভ্রমণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সমতলের মানুষ যান্ত্রিক কোলাহল ছেড়ে নিতে চায় মুক্ত আকাশের ছোঁয়া। এই স্বাদ নিতে প্রতি বছর হাজারো মানুষ ছুটে যাচ্ছে পাহাড়ে। এই সুযোগ কে কেন্দ্র করে পাহাড় হয়ে উঠতে পারে অর্থনৈতিক চালিকা শক্তির নতুন এক দিগন্ত, চাকা ঘুরে সবল হতে পারে পাহাড়ি মানুষদের জীবন। জীবনযাপনের জন্যে গতানুগতিক কৃষি কাজ বা জুম চাষ ছাড়াও তাদের জন্যে এই পর্যটন কে ঘিরে রয়েছে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনা। ঘুরতে যাওয়া পর্যটকদের তারা নিজেদের ঘর ভাড়া দিয়ে হোম স্টের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করতে পারে, এছাড়াও আদিবাসী খাবার কে তুলে ধরতে পারে উন্মুক্ত বিশ্বের কাছে। ক্লান্ত পর্যটক যখন সন্ধ্যায় তাদের ঘরে আসবে বিশ্রাম নিতে, তখন সুযোগ রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি তুলে ধরে বিনোদন দেওয়ার মাধ্যমে বাড়তি অর্থ আয়ের।

শিক্ষিত যুবকেরা হয়ে উঠতে পারে ট্যুর গাইড, দিতে পারবে পর্যটকদের ভ্রমণ সংক্রান্ত দিক নির্দেশনা এবং কথার ভাজে তুলে ধরতে পারবে তাদের জাতিসত্তার ইতিহাস কে। এছাড়াও ভ্রমণকারীদের ভ্রমণের সহায়তাকারী সরঞ্জাম ভাড়া দেয়ার মতন সুযোগ তো আছেই। হাজার বছরের এই মাটির স্তূপকে ঘিরেই রয়েছে হাজারো সুযোগ, রয়েছে অর্থনীতির চালিকা শক্তি, শুধু প্রয়োজন সঠিক দিক নির্দেশনার।

আমাদের দেশে যে পাহাড় কে ঘিরে পর্যটন গড়ে উঠেনি বিষয় টা এমন নয়। কিন্তু পাহাড়ে গিয়ে কেউ ফিরে এসেছে হাসি মুখে ভ্রমণ স্মৃতি নিয়ে কেউ বা অবসন্নতা ও ক্লান্তি নিয়ে। পাহাড়ি পর্যটন কে ঘিরে সুযোগ সম্ভাবনার চেয়ে সমস্যাই বোধ হয় বর্তমানে বেশি পাওয়া যাবে। পাহাড়ে ভ্রমণের মুল সমস্যা হল যাতায়াত ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ঘিরে। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা গগন চুম্বী পথ মেঘের দিকে টানলেও তার বাঁকে বাঁকে রয়েছে বিপদ, প্রতি বছর হাজারো দুর্ঘটনা হয় এই পথে। এছাড়াও কিছু অসাধু মানুষের পাহাড় কেটে ফেলার কারণে বর্ষার মৌসুমে হয় পাহাড় ধস, বন্ধ হয়ে যায় যোগাযোগ ব্যবস্থা। নিরাপত্তার ব্যবস্থার বাধার কারণে যাওয়া যায় না অনেক স্থানে। এরই মাঝে রয়েছে খাবার, নিরাপদ রাত্রিযাপন ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার অভাব। অপ্রতুল স্যানিটেশন ব্যবস্থার কারণেই নারী পর্যটকদের ভ্রমণ তালিকার বাইরে চলে যায় নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা এসব স্থান। এসব বহুমুখী সমস্যার কারণে শুধু মাত্র যুবক শ্রেণীর পর্যটকদের নিকট স্থান করে নিতে পেরেছে এই পাহাড় ভ্রমণ বা হিল ট্যুরিজম।

হিল ট্যুরিজমকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন সঠিক দিক নির্দেশনা ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার। প্রথমেই সুগম করতে হবে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে যার ফলে পর্যটকরা ছুটে আসতে পারে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের টানে। যান্ত্রিক ছোঁয়া শুধু শহরেই মানায়, পাহাড় কে রাখতে হবে সবুজ। বন্ধ করতে হবে পাহাড় কাটা। নিরাপত্তার চাদরকে বিস্তৃত করে আনতে হবে। তৈরি করতে হবে গণসচেতনতা, যাতে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা স্বাগত জানাতে পারে সমতলের মানুষদের। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে উৎকৃষ্ট উপায়ে করতে হবে প্রচার প্রচারণা।

ফেসবুক, ইউটিউব কিংবা টুইটারের মাধ্যমে পাহাড়ি সংস্কৃতির প্রচার হতে পারে পর্যটকদের জন্যে আমন্ত্রণ বার্তা। তাদের উৎসব কে কেন্দ্র করে ট্যুর অপারেটররা দিতে পারে আকর্ষণীয় প্যাকেজের অফার। নারী পর্যটকদের আকর্ষণে বাড়াতে হবে স্যানিটেশন ব্যবস্থার, দিতে হবে নিরাপদ রাত্রি যাপনের সুযোগ। নির্মূল করতে হবে পর্যাপ্ত সুপেয় পানির অভাব। পর্যটক ও ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী উভয়কেই উদ্বুদ্ধ করতে হবে হোম স্টে সম্পর্কে, যাতে চাঁদের নির্মল আলোতে জ্যোৎস্না রাতে আকাশের তারা গুনে ক্লান্তি দূর করা যায়। তবেই সম্ভব হবে হিল ট্যুরিজমের মাধ্যমে পর্যটনে সমৃদ্ধি ও বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি।

বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় হাওর পর্যটন

মোঃ আউয়াল হোসেন (আশিক)
শিক্ষার্থী, ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

পর্যটনের অপার সম্ভাবনায় ভরপুর আমাদের এই বাংলাদেশ। কি নেই আমাদের এই সোনার বাংলাদেশে! আমাদের আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা অপরূপ লীলাভূমি সমুদ্র সৈকত, সুন্দরবন, পাহাড়। এছাড়াও, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে যেমন অসংখ্য নদ নদী, তেমনি আছে অসংখ্য হাওর-বাঁওড় খাল-বিল। এক দশক আগেও বাংলাদেশের পর্যটন সম্পদগুলো মানুষের কাছে অজানা ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে বিভিন্ন পর্যটন স্থানের মতো বাংলাদেশের হাওর পর্যটন ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বাংলাদেশের যে অগভীর জলা ভূমি, যার আকৃতি সুবিশাল থালা বা গামলার মতো তাকেই হাওর বলা হয়।

এই বিশাল আকৃতির থালা বা গামলা প্রতি বছর বর্ষার পানিতে প্লাবিত হয়ে সাগরের আকার ধারণ করে। বছরে সাত মাস হাওরগুলো পানিতে ডুবে থাকে। আবার শীত ও গ্রীষ্মে এগুলোকে মনে হয়ে সীমাহীন প্রান্তর। পানি কমে গেলে হাওরের মধ্যে থাকা বিলগুলো জেগে ওঠে। আর সেখানে গজিয়ে ওঠা সবুজ কচি ঘাসে রুপান্তরিত হয় সুবিশাল চারণভূমিতে যা বাংলাদেশের এক একটি সবুজ সোনার খণ্ড। প্লাবনের ফলে জমে থাকা উর্বর পলি মাটিতে কৃষকেরা ফলান সোনা সমতুল্য রবি শস্য ও বোরো ধান।

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সুবিশাল কিছু হাওর দেখতে পাওয়া যায়। কাওয়া দীঘি হাওর, ছাইয়ার হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, ডাকের হাওর, তল্লার হাওর, নলুয়ার হাওর, পচাশোল হাওর, মইয়ার হাওর, মাকার হাওর, মাহমুদপুর হাওর, রায়ের গাঁও হাওর, সুরমা বাউলার হাওর, হাকালুকি হাওরের মতো আরো কত হাওর! এসবের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হাওর হলো টাঙ্গুয়ার হাওর ও হাকালুকি হাওর। এছাড়াও পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, রাজশাহী অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য বিল। সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার ৫টি উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত হাকালুকি হাওর, ২৩৮ টি বিল ও ১০ টি নদীর সমন্বয়ে গঠিত। শীত মৌসুমে বাংলাদেশের বৃহত্তম মিঠাপানির এ জলাভূমির অতিথি পাখিদের আগমন ও কলতান ভ্রমণ প্রিয় মানুষের ভ্রমণ আকর্ষণ বৃদ্ধি করে।

এছাড়া মেঘালয় থেকে উৎপন্ন ৩০ টি ঝর্নার মিলনে গঠিত সুনামগঞ্জ জেলার টাঙ্গুয়ার হাওর বর্তমানে পর্যটকদের কাছে একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। রামসার কনভেনশন অনুযায়ী ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ স্বীকৃত ১২০ টি বিল ও ১৮০ টি নিম্নাঞ্চল নিয়ে গঠিত এ হাওর “নয়কুড়ি কাঁদার ছয়কুড়ি বিল” নামেও পরিচিত। স্বচ্ছ পানির এ হাওর অসংখ্য প্রজাতির মাছ, ব্যাঙ, সরীসৃপ প্রাণী ও অতিথি পাখির বিচরণ ক্ষেত্র। টিলা, নীল পানি আর পাহাড়ের সমন্বয়ে গঠিত টাঙ্গুয়ার হাওরের অপরূপ সৌন্দর্য ও জীব-বৈচিত্র্য পর্যটকদের কাছে এ স্থানকে শুধু আকর্ষণীয়ই করে তোলেনি, বরং “বাংলার কাশ্মীর” নামেও সুপরিচিত করে তুলেছে।

বাংলাদেশে মূলত তরুণ পর্যটকদের হাত ধরে হাওর পর্যটনের যাত্রা শুরু। তরুণ পর্যটকরা নিজ উদ্যোগে হাওর অঞ্চলে বিভিন্ন ভ্রমণ প্যাকেজের আয়োজন করেন এবং হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করেন। তারপর ধীরে ধীরে এর ব্যাপকতা ও বিস্তার লাভ শুরু হয়। হাওর অঞ্চলের প্রধান আকর্ষণ নৌকা ভ্রমণ। মূলত পর্যটকরা এখানে নৌকা ভ্রমণের মাধ্যমে হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করেন। জোছনা রাতে চাঁদের আলোয় হাওর দেখার মধ্যেও রয়েছে অন্য ধরনের রোমাঞ্চকর অনুভূতি। এছাড়াও, শীত মৌসুমে হাওরাঞ্চলে অনেক অতিথি পাখির আগমন ঘটে যা হাওরের সৌন্দর্য অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়। অতিথি পাখি রক্ষার মাধ্যমে হাওরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।

হাওরাঞ্চলে রয়েছে নির্দিষ্ট সংস্কৃতি, যার ফলে এ অঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছে জারি সারি গান, যা হাওর অঞ্চলের মহিমা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। হাওরের সুপ্রাচীন সাংস্কৃতিক জাগরণ আমাদের বাংলার সংস্কৃতিকে করেছে সমৃদ্ধ, সৃষ্টি করেছে হাছন রাজা, উকিল মুন্সী, বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের মতো সঙ্গীতজ্ঞ। এ অঞ্চলের নিজস্ব খেলাধুলা, উৎসব, নৌকা বাইচ, ষাঁড়ের লড়াই, বাইদ উৎসব পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। হাওর অঞ্চলের অনবদ্য সকল সংস্কৃতি, উৎসব ও গানগুলো পর্যটকদের সামনে উপস্থাপনের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে আমরা দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের হাওর ভ্রমণে আরো বেশি উৎসাহিত করতে পারি।

হাওর অঞ্চলের পর্যটন সম্ভাবনার মতো বেশ কিছু পর্যটন সমস্যাও রয়েছে, যেগুলো সমাধানে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। এ অঞ্চলে পর্যটকদের জন্য নিরাপত্তা ও অবকাঠামো ব্যবস্থা এখনো সঠিকভাবে গড়ে ওঠেনি। নিরাপত্তা অভাব, পর্যাপ্ত বাসস্থান, বিশ্রামাগার কিংবা আবাসিক হোটেল, স্বাস্থ্যকর খাবার ও রেস্তোরাঁ সংকট, বিনোদন উপকরণ এবং স্থানীয় মানুষের সচেতনতার অভাব হাওর অঞ্চলের পর্যটন বিকাশের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। কিন্তু এসব সমস্যা সমাধানের জন্য শুধু প্রয়োজন সরকার ও পর্যটন সংস্থাগুলোর যথাযথ উদ্যোগ ও কার্যকরী হাওর পর্যটন পরিকল্পনা গ্রহণ। তবে, হাওর এলাকায় পর্যটন বিকাশ ঘটাতে সবচেয়ে বেশি যেটি প্রয়োজন, তা হলো জনমনে সচেতনতা সৃষ্টি করে হাওর পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনাকে সকলের কাছে তুলে ধরা।

পাশাপাশি, পর্যটকদের স্বাভাবিক যোগাযোগ সুবিধা দিতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা। হাওরের পর্যটন সম্ভাবনাকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে বিভিন্ন অনলাইনভিত্তিক মাধ্যমসমূহের ব্যবহার, পর্যটন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে নিয়মিতভাবে আলোচনা, হাওর জেলাগুলিতে পর্যটকদের জন্য স্যানিটেশনের সকল সুবিধা নিশ্চিত করা ও সেই সাথে হাওর পর্যটন টাওয়ার কিংবা কেন্দ্র স্থাপন করে পর্যটকদের সেবার ব্যবস্থা করা, নিয়মিত বিরতিতে হাওর এলাকায় সচেতনতা বাড়াতে বার্ষিক উৎসবের আয়োজন করা ও সর্বোপরি হাওর অঞ্চলে পর্যটন সমস্যা এবং সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা ও পাঠ পরিক্রমা চালু করা হাওর অঞ্চলের পর্যটন শিল্পকে সমৃদ্ধ করতে পারে।

হাওরের পর্যটন সমৃদ্ধ স্থানগুলো নিয়ে বাস্তবমুখী, দীর্ঘমেয়াদী সুচিন্তিত পরিকল্পনা, হাওর বেষ্টিত জেলা সমূহকে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরিত করে পর্যটন শিল্প বিকাশে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। পাশাপাশি হাওরবাসীর জন্য বিকল্প আয় সৃষ্টি, হাওরের পরিবেশ উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণে অনন্য ভূমিকা রাখতে পারে। এতে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের ধারক ও বাহক বাংলাদেশ হাওর পর্যটনে বিশ্বের বুকে পর্যটন শিল্পে নতুন মাত্রা যোগ করবে। পাশাপাশি, পর্যটন এলাকার পারিপার্শ্বিক ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটিয়ে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমঃ বাংলাদেশের পর্যটন খাতের উদীয়মান সূর্য

চন্দলা ত্রিপুরা
শিক্ষার্থী, ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

আদিম যুগ থেকে মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়ায় খাদ্যের সন্ধানে, বাণিজ্যের জন্য অথবা নতুন স্থান অনুসন্ধানে। তখন থেকে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের শুরু। মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। নতুন কোনো স্থানে, দেশে ভ্রমণ করতে সবসময় পছন্দ করে। সাধারণভাবে, অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম বলতে ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়-পর্বত, জঙ্গল পাড়ি দেয়া, অজানাকে জানার চেষ্টা করা, নতুন পথ খোঁজাকে বোঝায়। হাইকিং, বাইকিং, মাউন্টেনিয়ারিং, ট্র্যাকিং, স্কাই ডাইভিং, সার্ফিং, জিপলাইনিং, রাফটিং, প্যারাগ্লাইডিং, সমুদ্রে সাতার কাটা, সমুদ্র তলদেশ দেখা ইত্যাদি সবই অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের অন্তর্ভুক্ত। এই ট্যুরিজমকে অন্যভাবে রোমাঞ্চকর পর্যটনও বলা হয়ে থাকে।

পাহাড়, সমুদ্র, নদী, ঝর্ণা ও রুপ লাবণ্যে ভরা দেশ বাংলাদেশ। ভ্রমণ পিপাসু তরুণ প্রজন্ম সবসময় এগুলো দেখা, নতুন নতুন ঝর্ণা সন্ধান করা, পাহাড়-চূড়ায় পাড়ি দেওয়ার জন্য কৌতূহলী হয়ে থাকে। সুন্দরবন, সিলেট ও তিন পার্বত্য জেলাতে মূলত অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের সম্ভাবনা বেশি। দিন দিন এই ট্যুরিজমের চাহিদা বেড়ে চলেছে। বর্তমানে দেশের ভেতরে ভ্রমণকারী মানুষের মধ্যে ৪০ শতাংশ তরুণ। আর তরুণরা সবসময়ই অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় হয়। কেউ সাগরে সাঁতার কাটতে চায়, কেউবা পাহাড়ে ভ্রমণ করতে যান, আবার কেউবা গুহা, বন জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন। সুতরাং এটা সহজেই বলা যায় যে, আগামীতে বাংলাদেশে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হবে।

বাংলাদেশে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের সম্ভাবনাময় স্থানগুলো হলো-

  • পাহাড়-পর্বতে ট্র্যাকিং: সাধারণত দলবেঁধে লাঠি নিয়ে উঁচু-নিচু পাহাড় পাড়ি দেওয়াই হলো ট্র্যাকিং। বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলা; বান্দরবন, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি পাহাড়ে ভরপুর। বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ এসব দুর্গম পাহাড়ে দলবেঁধে ঘুরে বেড়ান। বর্তমানে, মারায়ন তং, কেওক্রাডং, তাজিনডং, সাকা হাফং, আলুটিলা পাহাড়, সীতাকুণ্ড পাহাড়, সাজেক পাহাড় ইত্যাদি এসকল জায়গায় বেশিরভাগ ট্র্যাকিং এর আয়োজন চলে।
  • বাইকিং, হাইকিং ও সাইক্লিং: প্রাকৃতিক পরিবেশে অনেক সময় পাহাড়ি বা সমতল দৃষ্টি নন্দন জায়গায় বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর হলো বাইকিং, দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দেওয়ায় হলো হাইকিং, সাইকেল নিয়ে ঘোরাকে সাইক্লিং বলে। বাংলাদেশে অনেক জায়গা রয়েছে যা বাইক, সাইকেল বা পায়ে হেঁটে ঘোরা বেশ রোমাঞ্চকর ও উপভোগ্য। উদাহরণসরূপঃ কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ রোড, সাজেক রোড, বান্দরবন থানচি রোড, কিশোরগঞ্জের মিঠামইন রোড, মহালছড়ি থেকে সিন্দুকছড়ি, সিলেটের মালনিছড়া উঁচু নিচু টিলা ইত্যাদি বেশ জনপ্রিয়।

 

  • সমুদ্রে প্যারা গ্লাইডিং ও সার্ফিং: বাংলাদেশের দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। এই সমুদ্র তীর নিয়ে গঠিত কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, পতেঙ্গা সি বিচ, লাবনী সি বিচ ইত্যাদি জায়গায় সার্ফিং বা প্যারাগ্লাইডিং করা বেশ রোমাঞ্চকর হয়ে উঠেছে। সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে ভারসাম্য রেখে ভেসে চলাকে সাধারণ ভাষায় সার্ফিং বলে। প্যারাসুটের মাধ্যমে উপরে ভেসে থাকায় হলো প্যারাগ্লাইডিং। তরুণরা এসব রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চার উপভোগ করেন।
  • স্কুবা ডাইভিংঃ থাইল্যান্ড, গিলি আইল্যান্ড পানির নিচে ভাস্কর্য, মালয়েশিয়ার সিপাডান, অস্ট্রেলিয়া গ্রেট বেরিয়ার রিফ, হাওয়াই প্রভৃতি স্কুবাডাইভিংয়ের জন্য বিখ্যাত। বাংলাদেশেও সেন্ট মার্টিন তলদেশ দেখা বেশ কৌতূহল তৈরি করে। মানুষ সেখানে স্কুবাডাইভিংএ অংশগ্রহণ করছে। প্রতিনিয়ত মানুষ সেন্ট মার্টিন সি বিচে স্বচ্ছ সমুদ্রের নিচে বিভিন্ন কোরাল এবং জলে থাকা জীব বৈচিত্র, উদ্ভিদ দেখতে আগ্রহী হয়ে উঠছে।
  • রাফটিং ও জিপলাইনিংঃ দড়ি বেয়ে উঁচু পাহাড় চূড়া থেকে নিচু ভূমিতে নেমে আসায় হলো জিপলাইনিং আর পাহাড়-পর্বতের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা বিভিন্ন নদী বা ঝর্ণায় নৌকা বয়ে বেড়ানোকে রাফটিং বলে। বাংলাদেশে বান্দরবন নাফাখুম, মুনলাইপাড়া রাফটিং ও জিপলাইনিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। তাছাড়া আরও বিভিন্ন জায়গায় এসব এডভেঞ্চারের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।

 

  • সমুদ্রে সাঁতার কাটাঃ উন্নত দেশের মত বাংলাদেশেও সাঁতার কেটে সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত থেকে সেন্ট মার্টিন পর্যন্ত সাঁতার কেটে পাড়ি দেওয়া মূলত বাংলা চ্যানেল পাড়ি নামে পরিচিত। প্রায় ১৭ কিলোমিটার সাঁতার কেটে নিজের ভেতরে থাকা ভয়ভীতিকে দূর ও সমুদ্রের ঢেউ উপভোগ করা যায়।
    পাহাড়ের চূড়ায় ক্যাম্পিংঃ রাতের বেলা উঁচু পাহাড় থেকে শহরগুলো দেখা, আকাশের তারা দেখা বেশ কৌতূহল ও রোমাঞ্চকর। দল বেঁধে পাহাড়ের চূড়ায় রান্না করে খাওয়া, তাঁবু গেঁথে রাত কাটানো মুহূর্ত ও সুযোগ তরুণ প্রজন্মের কেউ হারাতে চায় না। তাই এই রোমাঞ্চকর মুহূর্ত উপভোগ করতে বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীরা দেশের বান্দরবন মারায়ন তং পাহাড়, তাজিনডং পাহাড়, সাজেককে বেছে নেয়।
  • কক্সবাজার স্কাই ডাইভিংঃ সাউথ আফ্রিকা, দুবাই, অস্ট্রেলিয়ার ইত্যাদি আরও অন্যান্য দেশের মতন বাংলাদেশের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে স্কাই ডাইভিংয়ের সুবিধা রয়েছে। তরুণ পর্যটকদের মধ্যে স্কাই ডাইভিং বেশ চ্যালেঞ্জিং এবং লোমহর্ষক ব্যাপার। সব ধরনের এডভেঞ্চারের মধ্যে এটি বেশ জনপ্রিয়।
    তরুণ সমাজের হাত ধরে বাংলাদেশে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের শুরু। দল বেঁধে তারা পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়, সমুদ্রে সাঁতার কাটে, গুহায় যায়, নতুন নতুন জায়গায় পাড়ি জমে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের চাহিদা বাড়বে। তাই অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম গঠন ও উন্নয়নে জরুরী ভিত্তিতে নিম্ললিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী।

সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ: কোনো কিছু করার আগে আগাম পরিকল্পনা অবশ্যই দরকার। বাংলাদেশে কোন জেলায় কি কি পর্যটনের সম্ভাবনা ও চাহিদা রয়েছে তা বিবেচনা করে পর্যটন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে পরিকল্পনা গ্রহণ করার এখনই যুক্তিযুক্ত সময়। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড এরই মধ্যে এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছে। সামগ্রিক পরিকল্পনার পাশাপাশি অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম নিয়েও সঠিক, কার্যকর ও যুগোপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ, অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমকে আরো সমৃদ্ধ করবে।

সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ: ভবিষ্যতে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম খাতকে এগিয়ে নিতে হলে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ জরুরী। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান/কোম্পানিগুলো একজোট হয়ে এ খাতে কাজ করা দরকার। তাহলে দেশের ভিতরে ও বাইরের পর্যটকরা অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমে আকৃষ্ট হবে।

নিরাপত্তাসহ নানা সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি: নিরাপত্তা না থাকলে পর্যটকরা কোন স্থান ভ্রমণে আগ্রহ হারায়। যেহেতু অ্যাডভেঞ্চার মানে ঝুঁকিপূর্ণ তাই কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন সার্ফিং বা স্কুবাডাইভিংয়ের সময় পর্যটকদের সতর্কতা অবলম্বনের জন্য যথেষ্ট দক্ষ ও প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক ও ট্যুরিষ্ট পুলিশ প্রয়োজন। পাশাপাশি, পাহাড় গুলোতে নির্দিষ্ট দূরত্বে পাহাড়ি পরিবেশের সাথে ভারসাম্য রেখে পর্যটকদের জন্য বিশ্রামের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

প্রচার প্রচারণার বৃদ্ধি: প্রচার প্রচারণার অভাবে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমসহ দেশের পর্যটন স্থানগুলো সম্পর্কে বিদেশি পর্যটকরা জানতে পারেনা। ফলে আমরা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারছি না। বিদেশী টিবি চ্যানেল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং বিদেশী দূতাবাসের মাধ্যমে দেশের সকল পর্যটন কেন্দ্রকে উপস্থাপন ও তুলে ধরে, দেশী ও বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করা যেতে পারে।

বর্তমান বিশ্বে তরুণ প্রজন্মের কাছে অ্যাডভেঞ্চার একটি বেশ কৌতূহল ও রোমাঞ্চকর বিষয়। সুযোগ পেলেই তরুণরা রোমাঞ্চকর নতুন কোনো কিছুর সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। হাতে গোনা কয়েকটি হলেও বাংলাদেশেও অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম ডেসটিনেশন/কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশে এ পর্যটন খাতে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে । তাই এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে পর্যটকদের অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমে উৎসাহিত করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলার ব্যাক ওয়াটার ট্যুরিজম

ফাতেমা আজমী
শিক্ষার্থী, ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

……নদীর পরে নদী গেছে নদীর নাহি শেষ,
কত অজান গাঁ পেরিয়ে কত না-জান দেশ।
…কত নায়ের ভাটিয়ালীর গানে উদাস হয়ে,
নদীর পরে নদী চলে কোন অজানায় বয়ে।

……কবি জসীমউদ্দিন (মাটির কান্না)

আমাদের এই দেশ মাতৃকা বাংলাদেশ অপার সৌন্দর্য আর সম্পদের ভাণ্ডার। এ বাংলার বুকে অলংকারের ন্যায় সজ্জিত আঁকাবাঁকা নকশি আঁকা নদী। এসব নদী বাঙালীর জীবন আর প্রাণের উৎস, যা কিনা বাঙালির দেহে জুগিয়েছে প্রাণ। তাই নদীর ঠাই হয়েছে পল্লী কবি জসীমউদ্দিনের মতো অনেক কবি সাহিত্যিকের রচনায়। কৃষি সেচ, আমিষের উৎস থেকে শুরু করে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যমও এই নদী। নদী যেন সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভালোবাসার অলংকার। সেই অলংকারের একটি ছোট্ট অংশ হচ্ছে ধীর স্রোতা খাল বা নদী বা ব্যাক ওয়াটার। ব্যাক ওয়াটার সাধারণত প্রধান নদীর শাখা হয়ে হয়ে থাকে।

যার স্রোত তুলনামূলক প্রধান নদীর চেয়ে কম । নদীর উৎপত্তি স্থল হতে নদী একাধিক গতিপথ বা শাখা তৈরি করে। তাই এ সকল শাখা নদীর গতি প্রধান নদীর মতো হয় না। তুলনামূলক কম গতিধারা ও অগভীরতাই ব্যাক ওয়াটারের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এসব শাখা নদীই ব্যাক ওয়াটার, যা ধীরগতিতে এক পর্যায়ে প্রধান নদীর সাথে মিশে যায়। এই ব্যাক ওয়াটার পর্যটকেদের কাছে বর্তমানে বিশেষ আকর্ষণ। থাইল্যান্ডের ভাসমান বাজার বা কেরালার ব্যাকওয়াটার ট্যুরিজম বিশ্বজুড়ে খুবই প্রসিদ্ধ। খাল বা নদীর ধারের প্রাকৃতিক পরিবেশ, জীবনযাত্রা প্রণালী মনোমুগ্ধ করে ভ্রমণ পিপাসুদের।

আমাদের দেশ নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় সারাদেশের মধ্যে এক নৌ-রুট তৈরি হয়েছে। জীবিকার তাগিদে জেলেদের এক মাত্র ভরসা এই নদী বা খাল। গ্রামের ছেলেদের মাছ ধরা, বাচ্চাদের পানিতে খেলা করা, মেয়েদের দৈনন্দিন গৃহ কার্যসাধনে এই ছোট ছোট নদী গুলির কোন জুড়ি নেই। এক কথায় বলতে গেলে এই নদী জুড়ে আছে বাঙালীর শরীরের শিরার মতো। আর এই নদীর ওপর নির্ভর করেই কৃষি প্রধান দেশের ব্যবসা বাণিজ্য টিকে রয়েছে।

আমাদের এই দেশে রয়েছে এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম পেয়ারা বাগান যা ঝালকাঠি, পিরোজপুর এবং বরিশালের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত। ঝালকাঠি জেলার সদর উপজেলার ডুমুরিয়া, কাপড়-কাঠি, কাঁচাবালিয়া, ভীমরুলি, হিমানন্দকাঠি, শতদশকাঠি, রামপুর, মীরাকাঠি, শাওরাকাঠি, জগদীশপুর, আদমকাঠি এবং পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার আটগড়, কুরিয়ানা, বংকুরাসহ আরও কিছু গ্রামের প্রায় ২৪ হাজার একর জমিতে পেয়ারার চাষ হয়। দেশে উৎপাদিত মোট পেয়ারার প্রায় ৮০ শতাংশই উৎপাদিত হয় এই অঞ্চলে।

এই বৃহত্তম পেয়ারা বাগানকে ঘিরে, পিরোজপুর জেলা হতে ১৫ কিলোমিটার দুরে ভিমরুলিতে গড়ে উঠেছে দেশের সবচেয়ে বড় ভাসমান পেয়ারা বাজার যা হতে পারে বাংলাদেশের ব্যাক ওয়াটার ট্যুরিজমের একটি অন্যতম কেন্দ্র। তিন দিক থেকে আসা খালের মোহনায় বসে ভিমরুলির এই ভাসমান পেয়ারা বাজার। এই বাজার বছরের জুলাই -আগস্ট হতে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত চলে। এই বাজারের সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, খালের নৌকায় চড়ে হাত বাড়ালেই টাটকা ঝুলন্ত পেয়ারা ধরা যায় নিমেষেই।

খাল গুলোতে একসঙ্গে অনেক নৌকা আর নৌকাভর্তি পেয়ারা, এ দৃশ্য দেখলে মন জুড়িয়ে যায়। বর্ষার পানিতে টইটম্বুর খাল, খালের পাড়ে সবুজ প্রকৃতি আর নৌকায় সবুজ-হলুদ পেয়ারা। ছোট্ট নৌকা কিংবা ট্রলারে দুই পাশে পেয়ারা বাগানের মাঝখান দিয়ে খালে ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্যটাও বেশ মনোরম।

এছাড়াও এই ভাসমাম বাজারে দেখা মিলবে বাহারি রকমের সবজির পসরা। সবজি বাবসায়ীরা তাদের উৎপাদিত পণ্যর পসরা নিজস্ব নৌকায় সাজিয়ে চলে আসে ভাসমান বাজারে। পাইকারি দরে বিক্রি হয়ে থাকে এসব পণ্য। নারকেল, আমড়া, পেপে, কাঁঠাল, কন্দ, আদা, কলা এবং আরো রয়েছে বাহারি রকমের সবজি। এমনকি এসব খাল দিয়ে আস্ত বাঁশের গোছা ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় শহরে। সারি সারি নৌকা নিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় বসে থাকেন নৌকার কারিগররা। বরিশাল শহর থেকে ট্রলার ভাড়া করে যাওয়া যায় ভিমরুলির পেয়ারা বাজারে। সড়কপথেও যাওয়া যায় সেখানে। তবে ট্রলার যোগে গেলে গ্রামের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া আঁকাবাঁকা সরু খাল ও পেয়ারার বাগানের চমৎকার আবহ খুবই উপভোগ্য।

এ দৃশ্য উপভোগের পাশাপাশি, রসনা প্রিয় পর্যটকরা খেতে পারেন, পিরোজপুর জেলার ভীমরুলি বাজারের সাদা মিষ্টি, লাল মিষ্টি, কুড়িয়ানা বাজারের বৌদির হোটেলে দুপুরের খাবার এবং ঋতুপর্ণা দোকানের গরম মিষ্টি আর গুঠিয়ার সন্দেশ। বরিশাল শহরেও রয়েছে হকের রসমালাই, রসগোল্লা, ছানা, পুরান বাজার এলাকার শশীর রসমালাই, বটতলা এলাকার নিতাইয়ের মিষ্টি, নতুন বাজার এলাকার ঘোরের দই, ঘোল, ঘোল-মুড়ি মিক্সড, বিবির পুকুর পাড় থেকে একটু সামনে বিবির পুকুর পাড়ের চটপটি।

বাংলাদেশে এমন অনেক খাল রয়েছে যেগুলো পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ব্যাক ওয়াটার ট্যুরিজমের এক একটি অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। এসব নৌ রুটকে কেন্দ্র করে ভ্রমণ প্যাকেজ তৈরি করা প্রয়োজন। ব্যাক ওয়াটার জোন তৈরি করে, নান্দনিক ও আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মিশ্রনে তৈরি নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যাক ওয়াটার ট্যুরিজমের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। এ সব স্থানে থাকবে ভাসমান হোটেলের ব্যবস্থা। আর তার সাথে আমাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহ রচনা করবে সৌন্দর্যের অনন্য ধারা।

যে কোনো পর্যটন কেন্দ্রের অবকাঠামোগত সুবিধা যেমনঃ আবাসন সুবিধা, যাতায়াত সুবিধা এবং নিরাপত্তা প্রধান বিষয় গুলোর মধ্যে অন্যতম। তাই ব্যাক ওয়াটার ট্যুরিজম বিকাশে আবাসন সুবিধার পাশাপাশি নিরাপত্তার বিষটি নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাক ওয়াটার ট্যুরিজম নদী কেন্দ্রিক হওয়ায় পর্যটকদের ঝুঁকি থেকেই যায় বিশেষ করে যারা সাঁতারের সাথে অভ্যস্ত নয়। সেক্ষেত্রে লাইফ জ্যাকেটের বিষয়টির ওপর জোর দিতে হবে। সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে, ব্যাক ওয়াটার ট্যুরিজম বিষয়ক একটি কার্যকরী নীতিমালা ও পরিকল্পনা প্রবর্তন করা জরুরী।

ভ্রমণ পিপাসু মানুষেরা সব সময় নতুন কিছুর খোঁজে ভ্রমণ করে থাকে। নতুনত্ব যে কাউকে আকৃষ্ট করে। থাইল্যান্ডের ভাসমান বাজার দেখার জন্য ভ্রমণ পিপাসু মানুষেরা আকুল হয়ে থাকে। তবে আমাদের দেশে প্রাকৃতিক ভাবেই ব্যাক ওয়াটার ট্যুরিজমের সেই আবহ, সেই পরিবেশ রয়েছে সেটা আমাদেরকে তুলে ধরতে হবে। বাংলাদেশে ইতিমধ্যে বরিশাল ব্যাক ওয়াটার অ্যান্ড ভিলেজ ট্যুরিজমকে ইভেন্ট ক্যালেন্ডারে নিয়ে আসা হয়েছে।

পর্যটকদের ভ্রমণে উৎসাহিত করে নতুন এ পর্যটন ধারাকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন সরকারি বেসরকারি উদ্যোগ ও পরিকল্পনা। কার্যকরী উদ্যোগ ও পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ব্যাক ওয়াটার ট্যুরিজমের প্রতি দেশীয় পর্যটকদের আকৃষ্ট করার পাশাপাশি বিদেশী পর্যটকদেরও ভ্রমণে উৎসাহিত করবে। এর ফলে সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থানের, অর্জিত হবে বৈদেশিক মুদ্রা যা বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও সমৃদ্ধিকে তরান্বিত করবে।

বাংলাদেশে সম্ভাবনাময় অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম

মাহাথির মোরসালিন (অংক)
শিক্ষার্থী, ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপার লীলাভূমি বাংলাদেশ। বাংলাদেশে রয়েছে অসংখ্য জানা অজানা পর্যটন আকর্ষণীয় স্থান, যেগুলো যুগ যুগ ধরে মুগ্ধ করছে হাজারও পর্যটককে। তাই ইতিহাসের পাতায় ও বিভিন্ন কবি সাহিত্যিকের বর্ণনায় বার বার উঠে এসেছে বাংলার সৌন্দর্য আর প্রাণ-প্রকৃতির কথা। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের ভ্রমণ চাহিদা বৃদ্ধির ফলে এবং ভ্রমণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবদানের কারণে পর্যটন শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি পর্যটন খাত। বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, ছয় ঋতুর প্রকৃতির খেলা, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, পাহাড়, অরণ্যকে ঘিরেও রয়েছে পর্যটনের এক বিশাল সম্ভাবনাময় ভাণ্ডার।

তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশ স্বল্প আয়তনের দেশ হলেও বিদ্যমান পর্যটক আকর্ষণে যে বৈচিত্র্য, তা সহজেই পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারে। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরণের পর্যটন বিকাশের সুযোগ রয়েছে। যার মাঝে ইকো ট্যুরিজম, আর্কিওলজিক্যাল ট্যুরিজম, রিলিজিয়াস ট্যুরিজম এবং বিচ ট্যুরিজম এখন অনেকটাই সমৃদ্ধ। প্রতিবছর অসংখ্য বেশি-বিদেশি পর্যটক এই সকল স্থানে ভ্রমণ করছে। ২০১০ সালের পর থেকে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপের ফলে পর্যটন খাত দিনে দিনে আরও সমৃদ্ধশালী হচ্ছে। পর্যটন খাতের এই বিকাশের ফলে তৈরি হচ্ছে অসংখ্য কর্মসংস্থানের সুযোগ, যা বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা আরো দৃঢ় করছে।

বাংলাদেশের পর্যটন বিকাশের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য খাতের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হলো অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম, যা বাংলাদেশের পর্যটন খাতকে বিকশিত করার পাশাপাশি বাংলার পাহাড়, নদী, সাগর আর প্রকৃতিকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে পারে। যদিও এই খাতটি বাংলাদেশে এখনও সে ভাবে বিকশিত নয় তবুও এই খাতে রয়েছে অপার সম্ভাবনা। বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চল, সমুদ্র, হাওড় ও গ্রাম গুলোকে ঘিরে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম বিকাশের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশের দুরন্ত তরুণ সমাজকে ঘিরে এই পর্যটন খাতটি খুব দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। এই খাতকে ঘিরে এরই মধ্যে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে প্রকৃত পর্যটক শ্রেণী (Niche Tourist Group) তৈরি হয়েছে। ২০২০ সালে সারা বিশ্বে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের ১,১২,২২৭ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যর বাজার ছিল। ধারণা করা হয়, ২০২৮ সালে এই খাতের অর্থনৈতিক মূল্য দাঁড়াবে ১১,৬৯,০৯৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২০-২০২৮ সালে যার প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ২০.১%। উক্ত তথ্য থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম বর্তমান সময়ে ব্যাপক সম্ভাবনাময় একটি খাত।

রহস্য আর রোমাঞ্চ চিরকালই মানুষের ব্যাপক আগ্রহের জায়গা। বাংলাদেশে রহস্যময় আর রোমাঞ্চকর ভ্রমণ অভিজ্ঞতার জন্য রয়েছে পাহাড়ি এলাকা ও সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। এছাড়াও প্রাণ প্রকৃতি আর নির্মল বাতাসে ভরপুর আদর্শ গ্রাম ও হাওড়-বাঁওড়কে কেন্দ্র করেও এই খাতটিকে বিকশিত করা সম্ভব। বাংলাদেশে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের অন্যতম মাধ্যম হতে পারে সাফারি পার্ক ভ্রমণ, হিল ক্লাইমিং, ট্রাকিং, প্যারা গ্লাইডিং, সার্ফিং, স্কুবা ডাইভিং, রাফটিং ও জিপলাইনিং। দক্ষিণের সুন্দরবন আর উত্তরের পার্বত্য এলাকা হতে পারে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের অন্যতম কেন্দ্র।

পার্বত্য এলাকাগুলোতে হিল ক্লাইমিং এবং ট্র্যাকিঙয়ের বড় সুযোগ রয়েছে। পাহাড়ি এলাকার বাঞ্জি জাম্পের মত বিভিন্ন রোমাঞ্চকর আয়োজনও করা সম্ভব। এছাড়াও নদীমাতৃক এদেশে বোর্ডিং এবং ফিসিং এর সুব্যবস্থা করার মাধ্যমেও পর্যটক আকৃষ্ট করা সম্ভব। এছাড়া আমাদের সামুদ্রিক বিচগুলোতে প্যারা গ্লাইডিং, সার্ফিং, স্কুবা ডাইভিং, রাফটিং ও জিপলাইনিং এর মত রোমাঞ্চকর কার্যক্রমগুলো গ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশে নির্মল বাতাসে ভরপুর অনেক সুন্দর সুন্দর গ্রাম রয়েছে, যেগুলো ট্রাকিং এবং ক্যাম্পিং করার জন্য বিদেশী পর্যটকদের কাছে অনেক বেশী আকর্ষণীয়।

বাংলাদেশে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যাও আছে। সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম সমস্যা হলো, নিরাপত্তার অভাব, বিভিন্ন দুর্গম স্থানে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এবং স্থানীয় জনগণের নেতিবাচক মনোভাব। এছাড়াও এই খাতে বেসরকারি বিনিয়োগের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। বাংলাদেশে সম্ভাবনাময় অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইলে সবার আগে প্রয়োজন সরকারের বিশেষ পদক্ষেপ। এই পর্যটন খাতের উন্নয়নের জন্য অন্যান্য খাতের তুলনায় খুবই কম পরিমাণ বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়। কারণ রোমাঞ্চ প্রিয় ভ্রমণ পিপাসুরা কৃত্রিমত্তার থেকে প্রকৃতিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে যার ফলে অন্যান্য খাতের থেকে এই খাতে কম বিনিয়োগ করেও সরকার বেশি লাভবান হতে পারে।

তাই সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে উল্লেখিত সমস্যাগুলো সমাধান করে বাংলাদেশে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম সম্ভাবনার সবটুকুকে কাজে লাগাতে পারলে, বাংলাদেশ হয়ে উঠবে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে পর্যটনের রোল মডেল এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম হয়ে উঠবে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জনে পর্যটনের নতুন উৎস।

The Campus Today YouTube Channel

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
themesbazar_creativenews_II7
All rights reserved © 2019-20 The Campus Today