ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু

অধ্যাপক ড. আনন্দ কুমার সাহা


১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ধর্মকে পুঁজি করে দেশ বিভাজিত হয়। তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা হাজারও বৈষম্যের শিকার হয়।

পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের পঞ্জিভূত ক্ষোভ আর আত্নমর্যাদা প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা হয় মহান ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। মাতৃভাষার এই অধিকার আদায়ের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন পরবর্তিতে রূপ নেয় স্বাধীনতার আন্দোলনে।

১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের গণপরিষদের অধিবেশনে খাজা নাজিমুদ্দিন উদুর্কে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। বিরোধী কংগ্রেস দলের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ঐতিহাসিক প্রস্তাব উপস্থাপন করেন এবং জোরালো ভাষায় এর পক্ষে বক্তব্য রাখেন।

তিনি বলেছিলেন, প্রায় ৭ কোটি মানুষের সাড়ে চারকোটি মানুষ বাংলায় কথা বলে- অতএব রাষ্ট্রের ভাষা বাংলা হওয়া উচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে পূর্ব পাকিস্তানের সকল স্কুল-কলেজে ধর্মঘটের ডাক দেয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক আবুল কাশেমের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। গণপরিষদের সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২ মার্চ ফজলুল হক হলে বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকমর্ীদের একটি সভা আহবান করা হয়। কমরুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয়। ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ ১১ মার্চ সমগ্র পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। খাজা নাজিমুদ্দিনের মুসলিম লীগ সরকার লাঠি, টিয়ার গ্যাস ও ফাঁকা গুলি বর্ষণে স্তব্ধ করতে ব্যর্থ হয়ে ব্যাপক ধরপাকড় করে।

১০ মার্চ রাতে ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সভা বসলো। সভায় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহবায়কসহ অনেকেই তখন দোদুল্যমানতায় ভুগছে, আপস করতে চাইছে সরকারের সঙ্গে। একটা বজ্রকণ্ঠ সচকিত হয়ে উঠলো সরকার কি আপস প্রস্তাব দিয়েছে?

নাজিমুুদ্দিন সরকার কি বাংলা ভাষার দাবি মেনে নিয়েছে? যদি তা না হয় তবে আগামীকাল ধর্মঘট হবে। সেক্রেটারিয়েটের সামনে পিকেটিং হবে। এই বজ্রকন্ঠ ছিলো শেখ মুজিবের। ছাত্রনেতা শেখ মুজিবকে সমর্থন দিলেন অলি আহাদ, তোয়াহা, শওকত সাহেব, শামসুল হক।

অলি আহাদ উল্লেখ করেছেন “সেদিন সন্ধ্যায় যদি মুজিব ভাই ঢাকায় না পৌঁছাতেন তা হলে ১১ মার্চের হরতাল, পিকেটিং কিছুই হতো না। তরুণ শেখ মুজিব সেই রাতে গোপালগঞ্জ থেকে এসে ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত সভায় যোগদান করেন। ১১ মার্চে সচিবালয়ের পিকেটিং করার সময় শেখ মুজিব গ্রেফতার হন। শেখ মুজিবসহ অন্য ছাত্রদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১৩ মার্চ ছাত্র ধর্মঘট এবং ১৪ মার্চ প্রদেশব্যাপী দ্বিতীয় হরতাল পালিত হয়। ১৫ মার্চ শেখ মুজিব এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ জেল থেকে মুক্তি লাভ করে। ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে পুকুর ধারে একটি ছাত্র সভা অনুষ্ঠিত হয়।

উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন সদস্য কারামুক্ত ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে অ্যাসেম্বলি হাউস অভিমুখে ছাত্রদের একটি বিক্ষোভ মিছিল পরিচালিত হলো এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করলো।

১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ ঢাকা সফরে আসেন। ২১ মার্চ ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় পাকিস্তানের প্রথম গভর্ণর জেনারেল পূর্ব বাংলার ছাত্র-জনতার অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন না করে “উদুর্ এবং উদুর্ই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা” ঘোষণা করলে জনগণ বিশেষ করে ছাত্ররা প্রচন্ড হতাশ হয়। ২৪ মার্চ জিন্নাহ্র সম্মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ে এক বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও রাষ্ট্রভাষা উদুর্ই হবে ঘোষণা দিলে- কিছু সংখ্যক ছাত্র ‘নো’ ‘নো’ বলে প্রতিবাদ করে।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বে অর্থাৎ ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে পল্টনে জনসভায় ঘোষণা করেন উদুর্ই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তবে এই ঘোষণার প্রতিক্রিয়া ১৯৪৮ সাালের চাইতেই ব্যাপকতর ছিলো।

খাজা নাজিমউদ্দীনের ঘোষণায় জেলের অভ্যন্তরে তরুণ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। শেখ মুজিব এবং মহিউদ্দিন আহমদ তখন ঢাকা জেলে বন্দি ছিলেন। মহিউদ্দিন আহমদের ভাষ্যমতে শেখ মুজিব অসুস্থতার ভান করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল ডেকে অ্যাসেম্বলি ঘেরাও কর্মসূচির পরামর্শ দেন শেখ মুজিব।

শেখ মুজিবকে ঢাকা মেডিক্যাল থেকে আবারও জেলে ফেরত পাঠানো হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ফরিদপুর জেলে পাঠানো হয়। নারায়গঞ্জ স্টিমার ঘাটে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ছাত্রনেতা শামসুদ্দোহাসহ কয়েকজন ছাত্রনেতার সঙ্গে কথা হয়। শেখ মুজিব পুনরায় অনুরোধ করলেন ২১ ফেব্রুয়ারিতে হরতাল মিশিল শেষে আইনসভা যেন ঘেরাও করা হয় এবং বাংলা ভাষার সমর্থনে আইনসভার সদস্যদের স্বাক্ষর আদায় করা হয়।

শেখ মুজিব কারাগারে থাকা অবস্থায় বাংলা ভাষার সমর্থনে ১৮ ফেব্রুয়ারি অনশন শুরু করেন এবং ২৫ ফেব্রুয়ারি অনশন ভঙ্গ করেন।
ইতোমধ্যে ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ তারিখ বিকেল ৪ টায় মাইকে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। বেলা দশটা থেকে ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জমায়েত হতে শুরু করে। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই- ১৪৪ ধারা মানি না- নাজিম-নূরুল নিপাত যাক- প্রভৃতি শ্লোগানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকম্পিত হয়। ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের ইট-পাটকেল এবং কঁাদুনে গ্যাস বিনিময় হয়। এক পর্যায়ে পুলিশ ছাত্রদের উপর গুলি চালায়। ঘটনা স্থলেই রফিক উদ্দিন আহমদ, আবদুল জব্বার শহীদ হন এবং ১৭ জনের মত গুরুতর আহত হয়। তাঁদের মধ্যে আবুল বরকত রাতে অপারেশন টেবিলে মারা যান।

গুলি চালানোর সাথে সাথেই পরিস্থিতি অচিন্তনীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়। গুলি চালানোর সংবাদ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। সারা বাংলা ফুঁসে উঠে। ঢাকা শহরের সমস্ত লোক তখন বিক্ষুব্ধ হয়ে মেডিকেল হোস্টেল প্রাঙ্গণে এসে হাজির হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি গায়েবী জানাজা ও শোক শোভাযাত্রার ওপর গুলিবর্ষণে অবস্থার আরো অবনতি ঘটে। ঢাকা শহরে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়।

ভাষা আন্দোলনে শহীদের স্মৃতিকে ভাস্বর করে রাখার জন্য তৈরী হয় “শহীদ মিনার”। বাঙ্গালি জাতির প্রেরণার উৎস শহীদ মিনার। আমরা যখন হোঁচট খায় ফিরে যায় শহীদ মিনারের কাছে। ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের রক্তস্নাত পথ বেয়েই এসেছিল ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ।

বাংলা ভাষা, মহান স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু একই সূত্রে গাঁথা। মুজিব বর্ষে শ্রদ্ধা জানাই আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে- যার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে- বিজয় অর্জন করেছি- স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছি।

তথ্য ঋণ : মোনায়েম সরকার: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: জীবন ও রাজনীতি (বাংলা একাডেমি প্রেস, ঢাকা, ২০১৪)

লেখক: উপ-উপাচার্য
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *