রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু ও একজন নীরব মুক্তিযোদ্ধা
ড. আনন্দ কুমার সাহা
বীর মুক্তিযোদ্ধা বদরুল আলম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সম্মানিত প্রাক্তন কর্মকর্তা। জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৪ সালে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ থানায় বেলকা ইউনিয়নে। পিতা বদিউদ্দিন আহমেদ।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচনের (১৯৭০) সময় সুন্দরগঞ্জ থানার বেলকা ইউনিয়নে গিয়েছিলেন। বেলকা ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিলেন বাবু নেপাল চন্দ্র সাহা।
বঙ্গবন্ধু বদরুল সাহেবকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন: তোমার নাম কি? উত্তরে বলেছিলেন: বদরুল আলম খোকা। বঙ্গবন্ধু প্রত্তুতরে বলেছিলেন আমার নামও খোকা। বদরুল আলম বলেছিলেন আমি রাজনীতি করবো। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন তুমি পড়াশুনা করো, আগে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করো, তারপর রাজনীতিতে এসো এবং এও জানালেন পরবর্তিতে আমার সঙ্গে দেখা করো।
১৯৬১ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে ভর্তি হন। তখন অধ্যক্ষ ছিলেন অধ্যাপক ইলিয়াছ হোসেন। পারিবারিক আর্থিক তেমন স্বচ্ছলতা না থাকার কারণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬৩ সালে ওয়ার্ক এ্যাসিসটেন্ট হিসেবে যোগদান করেন। উল্লেখ্য, সে সময় তিনি রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একই সময় চাকরি পেয়েছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতন মাত্র ৩ টাকা বেশী হওয়ায় (১১৩ টাকা) বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন।
রংপুরে বাবা-মাকে দেখতে যেতে হবে গাড়ী ভাড়া লাগবে সে কারণে ৩ টাকা বেশী পাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন কন্সট্রাকশান কাজ চলছে, প্রশাসন ভবনটি পাকিস্তানের আযহার এ্যাসোসিয়েট- ৭ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করে। বিল্ডিংয়ের উপরে একটি ঘড়ি বসানোর পরিকল্পনা ছিলো যেমন ঢাকার ডি আই টি ভবনে আছে, কিন্তু প্রশাসন ভবনের বিল্ডিংয়ে আজও কোন ঘড়ি লাগানো হয়নি। তবে পরিকল্পনা চলছে। একটি কোম্পানি ঘড়িটি লাগানোর ব্যবস্থা করবে, মূল্য নির্ধারণ করেছে ৭ লক্ষ টাকা। ’৬৩ সালে বিল্ডিং নির্মাণ করতে খরচ হয়েছিলো ৭ লক্ষ টাকা বা কিছু বেশী।
প্রথম চাকরি, কাজের চাপ বেশী- রংপুর কারমাইকেল কলেজে ক্লাস না করলে পরীক্ষা দেয়া যাবে না বিধায় ট্রান্সফার নিয়ে ভর্তি হন রংপুর কলেজে। সে সময় কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন অধ্যাপক এমাজউদ্দিন। ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে বি.কম. ক্লাসে। তখন রাজশাহী কলেজে অধ্যক্ষ ছিলেন আব্দুল হাই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজের চাপে প্রতিদিন ক্লাস করা হয়না। অবশেষে ভর্তি হন রাজশাহী সিটি কলেজে বি.এ. ক্লাসে।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ অন্ত:সত্ত্বা স্ত্রী ও মামাতো বোনকে সাথে নিয়ে ভারতে গমন করেন। বহরমপুরে গিয়ে উঠলেন। সাময়িক আশ্রয় নিলেন বহরমপুর ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের বাসায়। কাছে ছিলো মাত্র ৭৫ টাকা। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে বললেন আমার বাবা-মা বাংলাদেশে আছেন আমি তাদের খবর জানিনা। দীনহাটা সাহেবগঞ্জ বর্ডারে যেতে হবে। গাড়ী ভাড়াও লাগবে। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বললেন- সেখানেই গাড়ী ভাড়া লাগবে, সেখানেই বলবে- ‘জয় বাংলা’।
এভাবেই পৌঁছেছিলেন সাহেবগঞ্জ বর্ডারে। অন্ত:সত্ত্বা স্ত্রী এবং মামাতো বোনকে স্বামী বিবেকান্দ আশ্রমে রেখে চলে এলেন কুড়িগ্রামে বাবা-মায়ের খোঁজ নিতে। ফিরে আসার পথে দেখা হলো শিলিগুড়িতে জনাব কামারুজ্জামান সাহেবের সঙ্গে। সঙ্গে ছিলেন ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতা কমলগুহ। শিলিগুড়ি ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যোগদান করলেন। ট্রেনিংয়ের একসময় মাজায় প্রচন্ড ব্যথা পেয়ে ভর্তি হয়েছিলেন শিলিগুড়ি হাসপাতালে।
চিকিৎসার পর জনাব এ এইচ এম কামারুজ্জামান সাহেব নিয়ে গিয়েছিলেন কুচবিহার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। তথন নর্থবেঙ্গল জোনাল এ্যাডমিনিস্ট্রেটর ছিলেন জনাব দেবী দাস। শপথ বাক্য পাঠ করার পর অফিসিয়াল কাজে যোগদান করলেন। ইতোমধ্যে বদরুল আলম ১১ মে ১৯৭১ সালে কন্যা সন্তানের পিতা হলেন। তখনকার ক্যাম্প প্রধান ছিলেন জনাব জয়ন্ত দাস-গুপ্ত। তিনি মেয়ের নাম রেখেছিলেন ভারতী।
১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পর ফিরে এলেন বাংলাদেশে। যোগদান করলেন কর্মস্থল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ৯ মাসের বেতন পেলেন ১৪০০ টাকা।
১৯৭২ সালে ৯ মে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আসলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করলেন শহীদ মিনারের। জিজ্ঞাসা করেছিলেন এখানে কেউ মুক্তিযোদ্ধা আছে কি-না? প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন জনাব মোজাহার হোসেন। তিনি বলেছিলেন জনাব বদরুল আলম আছেন। বঙ্গবন্ধু কাছে ডেকে নিলেন। জনাব আলম বললেন: আমি সেই আপনার খোকা, দেখা হয়েছিলো সুন্দরগঞ্জ থানার বেলকা ইউনিয়নে। বঙ্গবন্ধু বললেন: তুই আমার পাশে থাক।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের যে ছবিটা দেখা যাচ্ছে, অর্থাৎ পিছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর খান সরোয়ার মোর্শেদ মাঝখানে জনাব তোফায়েল আহমেদ এবং বঙ্গবন্ধুর বামে বীরমুক্তিযোদ্ধা জনাব বদরুল আলম। যিনি কথা বলেন কম, থাকার চেষ্টা করেন নীরবে-গোপনে।
বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে মনে পড়ে- যে চারটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে বাঙালি জাতি মহান মুক্তিযুদ্ধ করেছিলো- অর্থাৎ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ- ঠিক সেই চারটি স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার। বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় হোক আজকের জন্ম শতবার্ষিকীর অঙ্গীকার।
লেখক: প্রফেসর ড. আনন্দ কুমার সাহা
উপ-উপাচার্য
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।