ইসরাত জাহান ইতি
শিশুরাই জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ। শিশুদের ভবিষ্যত ভাল করতে হলে তাদের শিক্ষিত ও সুখি মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তারাই হবে দেশের সমাজপতি, রাষ্ট্রনায়ক, বিশ্ব নিয়ন্ত্রতা ও আদর্শবান মহাপুরুষ। ভবিষ্যত জাতি গঠনে তারাই গ্রহণ করবে কঠিন কঠিন চ্যালেঞ্চ।
এই সম্ভাবনাকে অবশ্যম্ভাবী করার জন্য একান্ত প্রয়োজন শিশুর সঠিক বিকাশ ও প্রয়োজন শিশুবান্ধব শিক্ষা। বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিশুর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঠিক বৃদ্ধি হলো শারীরিক বিকাশ। আর মানসিক বিকাশ হলো আচার-ব্যবহার, চিন্তা-চেতনা, কথা বলা, অনুভূতি ও ভাবের আদান-প্রদানের ক্ষমতা অর্জন।
শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ছাড়া শিশু তথা মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশ কখনই সম্ভব নয়।
শিশুর মনের আনন্দই তার দেহ ও মনের শক্তির মূল উৎস। আনন্দ ও শিশু বান্ধব পরিবেশ ছাড়া তার সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ কোন মতেই সম্ভব নয়। যে কোন শিক্ষাব্যবস্থা চারটি প্রধান স্তম্ভ নির্দেশ করে। যেমন জানতে শেখা, করতে শেখা, বাঁচতে শেখা ও মিলেমিশে বাস করতে শেখা। শিশুর গ্রহণ উপযোগী আনন্দঘন পরিবেশে শিক্ষা দানই হলো তার প্রকৃত শিক্ষা।
প্রখ্যাত ফরাসী দার্শনিক জ্যাঁ জ্যাঁক রুশো বলেছেন, “Education is the child’s development from with in ” অর্থাৎ শিক্ষা হলো শিশুর স্বতঃস্ফুর্ত আত্মবিকাশ।
পরিবার হলো শিশুর প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। একজন শিশুর শারীরিক , মানসিক , প্রক্ষোভিক, সামাজিক প্রভৃতি বিকাশগুলো ঘটতে শুরু করে পরিবারের মধ্যেই। শিশুরা তার মা-বাবা, পরিবার, পরিজন, সমাজ ইত্যাদি লক্ষ্য করে । তাদের কথা শুনে শুনে শিখতে শুরু করে। এ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখেন মা। কথা-বার্তা, কাজ-কর্ম, আচার-আচরণ, সাজ-পোশাক, চিন্তা-চেতনা, ভাবনাগুলো পর্যন্ত শিশু মায়ের কাছ থেকে শেখে।
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছেন, “তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দিবো ”।
ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে “One father is more than a hundred schoolmasters”।
বাবার সংস্পর্শে সন্তানের মস্তিষ্কে যৌক্তিক আচরণ, সামাজিক বিকাশ শেখার দক্ষতা তৈরি হয়। ফলে যে কোনো শিক্ষাদানে বাবা অনেক দ্রুত শিশুর আস্থা তৈরি করতে পারেন। বাবারা ছোটবেলা থেকেই বাইরের পরিবেশের সঙ্গে ভালোভাবে সম্পৃক্ত। তাই সন্তানের কোন কোন বিষয় ইতিবাচক ও নেতিবাচক সে সম্পর্কে ভালো ধারণা দিতে পারেন।
আবার পারিবারিক কলহের চাপে অনেক শিশুর স্বাভাবিক জীবনই অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের ঘটনা শিশুদের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যেসব শিশু মা-বাবার মনোমালিন্য দেখতে দেখতে বড় হয়, তারা হতাশ, অসামাজিক ও সহিংস হয়ে বেড়ে ওঠে। তারা নানা অনিশ্চয়তায় ভুগতে থাকে। তাদের মনের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়। ফলে মনঃসংযোগের ঘাটতি ,মানসিক রোগ ও ব্যক্তিত্বের অস্বাভাবিকতা ঘটতে পারে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ ২০১২ শীর্ষক এক জরিপে দেখা যায়, দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের ১৮.৩৫ শতাংশ মানসিক রোগে আক্রান্ত। এমন ঘটনা আবার মেয়ে শিশুর তুলনায় ছেলে শিশুর মধ্যে বেশি। মেয়ে শিশুর ১৭.৪৭ শতাংশের পাশাপাশি ১৯.২১ শতাংশ ছেলে শিশু মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে থাকে।
দেশের অধিকাংশ পরিবারের অভিভাবক সব সময় শিশুকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দেখতে চায়। কিন্তু কখনো বিবেচনা করে না একজন ভাল মানুষ হওয়া সমাজের জন্য তথা রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শিশু শিক্ষা ও আনন্দ একে অপরের সাথে গভীরভাবে জড়িত। আনন্দ ছাড়া কোমলমতি শিশুরা শিক্ষা লাভে উৎসাহ পায় না ।
শিশুরা শিখবে আনন্দের মাধ্যমে, নিজেদের ইচ্ছামতো, ঘুরে-ফিরে, কল্পনার ফানুস উড়িয়ে,খেলাধূলার মাধ্যমে, তাদের নিজেদের মনের অজান্তেই। এ বিষয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ থমসন বলেন, শিক্ষা হলো শিশুর ওপর পরিবেশের প্রভাব, যে প্রভাবের দ্বারা শিশুর বাহ্যিক আচরণ, চিন্তাধারা এবং দৃষ্টিভঙ্গির স্থায়ী পরিবর্তন হয়।
একজন শিক্ষক সুশিক্ষিত জাতি গড়ার কারিগর। শিক্ষক হচ্ছেন শিশু শিক্ষার একজন সুনিপুন মিস্ত্রি, যিনি গঠন করবেন শিশুর মানবাত্মা। শিশুরা মা-বাবা থেকে প্রাথমিক শিক্ষা পেলেও, প্রাতিষ্ঠানিক সকল শিক্ষা, আদব-কায়দা, আচার-আচরণ, রীতিনীতি সবকিছুই একজন ভালো শিক্ষক থেকে শেখে। একটি শিশুর জীবনের প্রথম চার /পাঁচ বছরের মধ্যেই মোটামুটি তার ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র গঠিত হয়ে থাকে। পারিপার্শ্বিক পরিবেশের ওপর ভিত্তি করে একটি শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠিত হয়।
শিশু যখন বেড়ে ওঠে, তখন তার মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য এবং উন্নত ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলার জন্য তার সামনে ইতিবাচক আবেগ, অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরা আমাদের সবার কর্তব্য। উন্নত দেশগুলোতে এই কাজ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাই করে থাকেন। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় সেটি তেমন করা হয় না। আমাদের দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিশুদের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শেখানোর চেয়ে পাঠ্যপুস্তকের উপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় । ফলে শিশুর ব্যক্তিত্বও ঠিকমতো গড়ে ওঠে না।
এই শিশুরা যখন বড় হয়, তখন তাদের মাঝে আদর্শ, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের মতো বিষয়গুলো তৈরি করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে সরকারিভাবে প্রাক প্রাথমিকে শিক্ষার স্তর একটি হলেও কয়েকটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা যায়, সেগুলোতে নার্সারী, প্লে, কেজি ওয়ান, কেজি টু’সহ তিন থেকে চার বছর ধরে পড়ানো হয় শিশুদের। আবার এ সময় শিশুদের খেলায় খেলায় মাতৃভাষা, অক্ষর ও সংখ্যার ধারণা দেয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে স্কুলগুলোতে শিশুদের গ্রামার এমনকি বিজ্ঞানও পড়ানো হয়, যা আসলেই কাম্য নয় ।
শিশুরাই আগামীর স্বপ্ন। তাই তাদেরকে ছোট থেকে ভাল মানুষ হিসেবে তৈরি করা স্কুল, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের সর্বোপরি আমাদের সকলের দায়িত্ব। সুস্থ ও সুন্দর সামাজিক পরিবেশ শিশুর মেধা এবং মননশীলতা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে থাকে। শিশুকে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার সুযোগ দিতে হবে। তা না হলে বড় হয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে তারা অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে।
শিশুর বিদ্যালয়ে যাতায়াতসহ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদেরই। আসুন আমরা আমাদের শিশুদেরকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বানানোর পূর্বে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করি।
লেখকঃ তরুণ নারী উদ্যোক্তা।