শনিবার, ১০ জুন ২০২৩, ১১:১৩ পূর্বাহ্ন

সত্যজিৎ রায়ের ‘গণশত্রু’ ও সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট

  • আপডেট টাইম শুক্রবার, ৮ মে, ২০২০, ৩.২৯ পিএম

এমদাদুল হক সরকার


বিখ্যাত নরওয়েজিয়ান নাট্যকার হেনরিক ইবসেনের “ An Enemy of the People” এর ওপর ভিত্তি করে “সত্যজিৎ রায় নির্মিত ১৯৮৯ সালে মুক্তি পাওয়া “গণশত্রু” চলচ্চিত্রের মূল গল্প একজন প্রগতিশীল ডাক্তারকে কেন্দ্র করে। ডাক্তার আশোক গুপ্ত তার এলাকার রোগীদের চিকিৎসা করতে গিয়ে এক পর্যায়ে অনুধাবন করেন যে অধিকাংশ রোগীই জন্ডিসে আক্রান্ত।

আর এরা বেশিরভাগই ডাক্তারের এলাকার মন্দিরের চরণামৃত পান করে রোগে আক্রান্ত হয়েছে। ডাক্তার এই রিসার্চ নিয়ে পরবর্তী সময়ে একটি প্রতিবেদন পত্রিকায় ছাপিয়ে দেন । চণ্ডীপুর মানে ডাক্তারের নিজ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ বিশেষ করে ডাক্তারের ভাই ও অন্যান্য ব্যক্তিগণ যখন বিষয়টি জানতে পারেন তখন ডাক্তারকে নানাভাবে বাঁধা দেন যাতে এ বিষয়ে আর কোন পদক্ষেপ না নেন। তার কারণ মন্দিরের পবিত্র জলে রোগের জীবাণু আছে এটা জানলে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের ধর্ম বিভ্রম তৈরি হতে পারে।

কিন্তু ডাক্তার বিভিন্নভাবে রিসার্চ করে এবং পত্রিকার সম্পাদক হরিদাস বাগচীর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন যে, ধর্মীয় বিভ্রম সৃষ্টিটা মুখ্য নয় বরং এই কাজে বাঁধা দেবার ব্যাপারে প্রত্যেকের ব্যক্তিস্বার্থ জড়িত। অতঃপর ডাক্তার একটি সাধারণ সভার আয়োজন করেন। কিন্তু সে সভায়ও তার ছোট ভাই ধর্মীয় বিভ্রান্তি তুলে দিয়ে সভা পণ্ড করে দেন। তার কারণ ডাক্তার হিন্দু ধর্মীয় অনেক বিধি-বিধান মানেন না। এভাবে মৌলিক বিষয়টাই এক পর্যায়ে সবার কাছে চাপা থেকে যায়। প্রগতিশীল ডাক্তার পরিণত হন গণশত্রুতে। এই চলচ্চিত্রটি যেন বর্তমান করোনা পরিস্থিতির বাস্তব প্রতিফলন।

গত ডিসেম্বরে চীনের উহান নগর হতে সৃষ্ট নোবেল করোনা ভাইরাস এক এক করে সীমানা প্রাচীর পেরিয়ে মানুষের দেহে প্রবেশ করে কেড়ে নিচ্ছে জীবনীশক্তি। তার সংক্রমণে সারা বিশ্ব আজ কাবু। রাজা-প্রজা, ধনী-গরিব, ধবল-কৃষ্ণ কেউ বাদ যায়নি । সবাইকে নাকানি চুবানি খাইয়েছে সে।

এমন পরিস্থিতিতেও সমাজের কতিপয় জনপ্রতিনিধি ডাক্তার অশোক গুপ্তের ভাই ও অন্যান্য গন্যমান্য ব্যক্তিদের ন্যায় দরিদ্র অসহায় মানুষকে সহযোগীতার পরিবর্তে ত্রাণ চুরিতে লিপ্ত। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’ বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের করোনা মোকাবিলার ক্ষেত্রে দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে সংবাদ প্রকাশ করেছে।

“A pandemic of corruption: $40 masks, questionable contracts, rice-stealing bureaucrats mar coronavirus response”

শিরোনামে এই প্রতিবেদনের মধ্যে বাংলাদেশের চাল কেলেঙ্কারি পরিস্থিতি তুলে ধরে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ প্রতিরোধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশে লক-ডাউনে ঘরে আটকা পড়া মানুষজনের জন্য খাদ্যসহায়তা কর্মসূচি হাতে নেওয়া হলেও ৬ লাখ পাউন্ড বা ৬ কোটি ৩০ লাখ টাকার (২ লাখ ৭২ হাজার কেজি) চালের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। প্রায় ৪০ জন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও কয়েকজন আমলার বিরুদ্ধে ত্রাণের চাল আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এদিকে বাংলাদেশে করোনার মধ্যে ‘বিতর্কিত’ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার বাড়ছে৷ আর এই আইনটি এই সময়ে সাংবাদিক, সমাজকর্মী ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয়দের বিরুদ্ধে ব্যবহার হচ্ছে৷ সম্প্রতি, সাংবাদিক, কার্টুনিস্ট, লেখকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে (ডিএসএ) মামলা এবং মামলার পরপর তাদের ১১ জন গ্রেপ্তার, কারাগারে পাঠানোর ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে আটককৃতদের মুক্তি ও আইনটি বাতিলের দাবি জানিয়ে সম্পাদক পরিষদ বিবৃতি দিয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রকাশ করা এবং প্রশাসনের ব্যর্থতা তুলে ধরা মিডিয়ার সহজাত কর্তব্য ও দায়িত্ব। মহামারি এবং এর বিপর্যয়কর পরিণতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে সরকার যখন হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে, তখন এটি আরও প্রয়োজনীয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা দমনে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে, এই ভয়ে সম্পাদক পরিষদ শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করছে। গণমাধ্যমের জন্য আমাদের সেই ভয় এখন দুঃস্বপ্নের মতো বাস্তবতা। সম্পাদকদের মতে ডিএসএ আইন সংবাদ মাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি প্রকাশ্য হুমকি।

অতএব বলা চলে এ আইনের মাধ্যমে সরকার গণশত্রু মুভির ন্যায় মানুষকে সত্য প্রকাশে ও সরকারের সমালোচনা বন্ধ করতে ব্যবহার করছে।

এদিকে করোনা মহামারিতেও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ছে। সাহায্যের পরিবর্তে অসদ ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চড়ামূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বিক্রি করছেন।

সমাজের কল্যান করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত ভালো মানুষগুলো বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। নিজের ও পরিবারের জীবনের ঝুকি নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিটাকেও আমরা ছাড় দেই না। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে সিভিল সার্জন অফিসে কর্মরত এক চিকিৎসকের পরিবারের ১৭ সদস্যের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর তাদের বাড়ি থেকে সরিয়ে হাসপাতালে স্থানান্তর করার দাবি জানিয়ে জনসাধারণের বিক্ষোভ করার ঘটনা ঘটেছে।

বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় বহু আগেই সমাজের অনিয়মগুলো তার চলচিত্রে চিত্রিত করেছেন। আসুন আমরা লকডাউনে সত্যজিৎ রায়ের চলচিত্র দেখি ও সমাজের অনিয়মগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়াই এবং দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ি।


লেখকঃ শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: [email protected]

The Campus Today YouTube Channel

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
themesbazar_creativenews_II7
All rights reserved © 2019-20 The Campus Today