“ আমি আমার জন্মদিনের উৎসব পালন করি না। এই দুঃখিনী বাংলায় আমার জন্মদিনই-বা কি আর মৃত্যুদিনই-বা কি ?” -বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বেঁচে থাকলে আজ তিনি শতবর্ষে পদার্পন করতেন। ১৭ই মার্চ ১৯২০ সালের এই দিনে বাংলার মুখ আলোকিত করে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় সম্ভ্রান্ত শেখ মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা, স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
পিতা শেখ লুৎফুর রহমান ও মাতা সায়েরা খাতুনের চার কন্যা এবং দুই পুত্রের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। তাঁর বাবা মায়ের দেয়া আদুরে নাম ছিল খোকা। কিশোর বয়স থেকেই শেখ মুজিবের প্রতিবাদী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ দেখা গিয়েছিল।
১৯৩৯ সালে স্কুল জীবনেই আন্দোলনের অংশগ্রহনের কারনে প্রথম জেলে যান। ১৯৪৬ সালে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমানে মওলানা আজাদ কলেজ) ছাত্র ইউনিয়নের সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সময় মুসলিম লীগ সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্যিধ্য ও লাভ করেছিলেন তিনি।
৪ঠা জানুয়ারি ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন “পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ” যা বর্তমানে “বাংলাদেশ ছাত্রলীগ” নামে পরিচিত। পঞ্চাশের দশকে মুসলিম লীগ ছেড়ে হোসেন সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাসানীর সাথে একাত্নতা পোষণ করে গঠন করেন “আওয়ামী মুসলিম লীগ”। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী নিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনে অংশ নেয়ার মাধ্যমেই শেখ মুজিবের রাজনৈতিক তৎপরতার সূচনা হয়।
১৯৫৩ সালের ১৬ই নভেম্বর প্রাদেশিক আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের সাধারন নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের হয়ে গোপালগঞ্জ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লাহোরে বিরোধী দলগুলোর সম্মেলনে ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন।
ঐতিহাসিক ছয় দফা ভিত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। ছয় দফা আন্দোলন এবং শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে পাকিস্তান সরকার গ্রেপ্তার করে শেখ মুজিবকে। ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুকে ১নম্বর আসামী করে ৩৫ জন বাঙ্গালির বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করে পাকিস্তান সরকার। ২২ই ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে তীব্র গনআন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নেয়।
১৯৬৯ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ রেসকোর্স ময়দানে গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমানকে “বঙ্গবন্ধু” উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর পাকিস্তানের সাধারন নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাঙালিদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু করে।
দফায় দফায় বৈঠকের নামে কালক্ষেপন করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসভায় তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার ডাক দেন। তিনি বলেন-
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
তাঁর ডাকে পুরো মার্চ মাস জুড়ে চলে অসহযোগ আন্দোলন। ১৯৭১ সালের ২৩শে মার্চ পাকিস্তানের পতাকার পরিবর্তে সব সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উত্তোলন করা হয় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। ২৫ মার্চ পাকিস্তানী বাহিনী পরিকল্পিত গণহত্যা শুরু করলে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। স্বাধীনতার ঘোষণার কিছুক্ষণ পরই তাঁকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তাঁকে মিনাওয়ালী কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়।
তাঁর ডাকে সাড়া দেয় বাংলার সর্বস্তরের জনসাধারন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ এবং গঠন করা হয় মুজিবনগর সরকার। প্রায় নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন করে। ১৯৭২ সালের ৮ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিয়ে লন্ডনে পাঠায় পাকিস্তান, সন্ধ্যায় জনাকীর্ন সংবাদ সম্মেলন বক্তব্য দেন তিনি।
১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি স্বাধীন বাংলার মাটিতে ফিরে আসেন বাংলার সূর্য সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, লাখো মানুষের ঢল নামে বিমানবন্দরে, জনসমুদ্রে হৃদয় কারা এক ভাষণ দেন তিনি। তিনি বলেন-
"আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে,
আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে,
আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে”।
কোনো বিশেষ ঘটনা বা আনন্দের দিনকে শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বাংলাদেশের মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি আনন্দের দিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু একজনই জন্মেছিলেন। যার জন্ম না হলে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হতো না। এজন্য ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আজীবন সোচ্চার এই অবিসংবাদিত নেতাকে রাজনৈতিক জীবনে বহুবার কারাবরণ করতে হয়। মৃত্যুকে তিনি ভয় পাননি। বলেছিলেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলাদেশ আমার দেশ।’
তাঁর সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বাঙালি জাতি আজ স্বাধীন। তিনি আমাদের দিয়েছেন স্বাধীনতা, দিয়েছেন একটা জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত আর একটা মানচিত্র। দিয়েছেন রাষ্ট্র, দিয়েছেন পরিচয়। আজ বাংলাদেশ যে বহু ক্ষেত্রে ভালো করছে, এগিয়ে যাচ্ছে, তার মূলে আছে আমাদের স্বাধীনতা; আর সেই স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু।
আমাদের দেশ যত দিন থাকবে, নদ-নদী যত দিন বইবে, তত দিনই কীর্তি থেকে যাবে বঙ্গবন্ধুর। কারণ তিনি হাজার বছরের বাঙালিকে প্রথম এনে দিয়েছিলেন রাষ্ট্র। তাঁর জীবনের একটাই ছিল সাধ, একটাই ছিল স্বপ্ন, একটাই ছিল লক্ষ্য—স্বাধীন বাংলাদেশ। তিনি আমাদের মধ্যে স্বাধীনতার স্বপ্ন সঞ্চারিত করেছিলেন। তিনি আমাদের ‘স্বাধীনতার অমর কাব্যের কবি’।
তিনি নেই, তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশ আছে। আর আছে তাঁর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের আদর্শ, তাঁর লেখা বইগুলো। তাঁর জন্মের শতবর্ষ আমরা সত্যিকার অর্থে উদ্যাপন করতে পারব, যদি তাঁর সেই কথাগুলো আজ আমরা কাজে লাগাতে পারি। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি এই মহান নেতার জন্মশতবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ এন্ড লিবারেশন ওয়ার স্টাডিজ বিভাগ,
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।