অদূরদর্শীতা আর সেচ্ছাচারিতার পরিণাম: তৈরি পোশাক শিল্প

ফখরুল ইসলাম হিমেল
আবু জাফর আহমেদ মুকুল


গার্মেন্টস অনেকটা আবেগীয় জায়গায়, তাই এই ব্যাপার নিয়া জাতির সামনে আলোচনা করা ঝুঁকিপূর্ণ। তবে,ব্যবসায়ের ছাত্র হিসেবে আমরা বিষয়টিকে একটু ক্রিটিক্যালি দেখি।

আচ্ছা, ৪০ বছর পুরনো শিল্পের অবস্থা এই যে, বন্ধ হবার প্রথমেই তাহারা ৫ হাজার কোটি টাকা প্রোণোদনা নিলেন,তখন এর রুগ্ন দশা আর লুকানোর কিছুই থাকে না!

অর্ডার নাই এই অসহায়ত্ব দেখিয়ে শ্রমিকের বেতন দেয়ার জন্য সরকারের নিকট থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা মাত্র ২% সুদে পেয়ে তারপর ফ্যাক্টরি খোলার তোড়জোড় শুরু হলো । এর মাঝে শ্রমিকদের নিয়ে আনা-নেওয়ার নির্মম অনেক নাটক দেখেছে এ জাতি।বহু মানুষ লিখেছে, কথা বলেছে, তারপরও মেনে নিয়েছে এই ভেবে যে দেখি দেশের যদি কিছু হয়,এই গরিব শ্রমিকদের যদি পেট বাঁচে!

বর্তমানে আমাদের দেশের পোশাক কারখানার বেশিরভাগ শ্রমিক কাজ করে ৪ থেকে ৭ নং গ্রেডে। ফলে গড়ে একজন শ্রমিকের মূল বেতন দাঁড়ায় মাসে ৮৯০০ টাকার মতো। সরকারের প্রণোদনা পাওয়ার পরেও অনেক ফ্যাক্টরি ঠিকমতো বেতন দেয়নি, আবার ঘোষণা দিয়ে এপ্রিল মাসের বেতন ৬০% দেয়া হয়েছে।

এখন বিজিএমইএ সভাপতি বলছেন জুন মাস থেকে শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হবে, মালিকদের নাকি কিছুই করার নাই (সূত্র: বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক)। সাথে একটা মোটিভেশনাল স্পিচ মেরে দিলেন,গরিবদের একটা আলাদা শক্তি আছে,যার ফলে তাদের আক্রান্তের হার কম!!বাহ! বাহ!

সরকারের প্রণোদনার অর্থ শেষ তো আপনাদের সব পথ বন্ধ?গত ৪০ বছর যখন এই শিল্পে শীর্ষে ছিলেন, তখনকার অর্থ কই গেলো? টেকসই উন্নয়নের কথা বলতে দেখছি আপনাদের বিভিন্ন সভায়!এই নমুনা টেকসই উন্নয়নের?

এবার একটু ভিন্ন আলোচনাই যাই,থিওরি অফ কন্সপাইরেসি তে বলা হয় একটা গ্রুপ আপনার চিন্তাভাবনা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করবে তাদের কন্সপাইরেসি বাস্তবায়ন করতে।আমিও এটা এই শিল্পের পাইরেটস’দের ক্ষেত্রে!পাইরেটস বলছি বেশিরভাগ ব্যবসায়ী দ্বিতীয়,তৃতীয় হোম বানিয়েছেন দেশে দেশে,তাদের সম্পত্তির খোঁজ নেন তারা কি বানিয়েছে শ্রমিকদের ঘামকে শুকিয়ে! আমার কাছে এটাকে রাবার শিল্পের মত মনে হয়।রাবার শিল্পে ঠিক রাবার গাছকে কেটে তার আঠা বের করে তাকে রুপান্তর করা হয় অর্থকরী ফসল হিসেবে,তেমনি শ্রমিকদের ঘাম শুকিয়ে এক শ্রেণী গড়ে তুলেছেন অঢেল সম্পদ!

আমাদেরকে মুখস্থ করানো হয়েছে,উন্নয়নের হাতিয়ার আমাদের এই গার্মেন্টস, তারা পূজনীয়। আমাদের দেশটাই দাঁড়িয়েছে এই গার্মেন্টস শিল্পের উপর। আসলে কি তাই? এই একটা শিল্পেই আমাদের উন্নয়নের জয়যাত্রা চালু রেখেছে? আর, এই ধরনের শিল্প কি উন্নয়নকে টেকসই করে?

আচ্ছা, এবারের সাধারন প্রশ্ন করি,ইউরোপ-আমেরিকা পৃথিবীর এত কিছু আবিষ্কার করতে পারে বা বানাতে পারে,তারা প্যান্ট-শার্ট বানাতে পারে না? হ্যাঁ, আপনারা আবার তোতা পাখি হয়ে গেছেন,বলবেন শ্রম সস্তা আমাদের এখানে, তাই এরা এখানে এগুলো তৈরি করে!

এইতো আপনার প্রশ্নের মাঝেই আমার উত্তরটি লুকিয়ে আছে! আপনি সস্তা জিনিস করলে আপনার দামটা সস্তায় হবে তাই নয় কি?একটা মানুষ সারাদিন মাটি কাটলে,সে পায় ৪০০ টাকা,আর এই একটা দিন যদি একটা ডাক্তার শ্রম দেয়,সে কত পাবে? অবশ্যই বেশি!তারা কেন আপনাকে প্যান্ট শার্ট আর জাঙ্গিয়া বানাইতে দেয়?

কেন তারা আপনাকে বিমান শিল্প,গাড়ি শিল্পের মত ভারী শিল্পগুলো করিয়ে নেয় না? আসলে তারা বুঝে ওগুলো টেকসই উন্নয়নের মাধ্যম!এগুলোর মাধ্যমে তারা দক্ষ শ্রমিক তৈরি করে,আর দাম পায় সেই শ্রমিকরা, আর এভাবেই তাদের শ্রম দামী হয়!

অর্থনৈতিক মন্দায় হয়তো তারা আমাদের গার্মেন্টসগুলোয় অর্ডার দিবেন না? তবে তারা কি উলঙ্গ থাকবে আপনার সহযোগীতা ছাড়া! নাহ্,আপনার এই সেবা তারা ঘরে একটা সেলাই মেশিন এনে ইউটিউবে টিউটোরিয়াল দেখে প্যান্ট-শার্ট বানাতে পারবে,অবশ্য আপনার ওই ট্যাগটি ছাড়া ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’। তাতে অবশ্য তার শরমের কোন কিছু নেই!

তাই, আপনার ‘দক্ষ’ শ্রমিকেরা যেখান থেকে এসেছিলো সেইখানেই ফিরে যাবেন! সাথে তাদের বায়বীয় দক্ষতা!যে ক্ষেতমজুর থেকে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি শ্রমিক হয়েছিলো, সে আবার ক্ষেত-মজুরি করবে,যে গৃহপরিচারিকা ছিলো সে আবার তার আগের শ্রমেই ফিরে যাবে!!

কিন্তু আপনি কি তাদের গাড়ি ইউটিউবে ভিডিও টিউটোরিয়াল দেখে বানাতে পারবেন? নাহ্,তাহলে তাদের শ্রমের দাম কমবে? আপনিই বললেন,কারা এগুলো বানায়? আমরা না ওরা! ওদের প্রয়োজনেই! এখন করোনা পরিস্থিতিতে ওদের ডিমান্ড নেই,ওরাপ বানাবে না,কেল্লা ফতে! আপনার হাতে আর কি করার আছে! ক্রেতা কিনবে না, আপনি আপনার মেশিন,মানুষ আর ফ্যাক্টরি নিয়া যাদুঘর বানান!

ছোটবেলায়, আমরা যখন দামি কিছু হাতে নিয়ে খেলতাম,তখন আমাদের বড়রা হাতে সামান্য লজেন্স বা অর্থহীন কিছু দিয়ে ওই দামী জিনিসটি আমাদের বুঝিয়ে নিয়ে নিতেন তাদের হাতে! আপনার হাতে তখন শুধুই লজেন্স!


লেখক


ফখরুল ইসলাম হিমেল
সহকারী অধ্যাপক
ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ।



আবু জাফর আহমেদ মুকুল
সহকারী অধ্যাপক
ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ফাইন্যান্স বিভাগ
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

Scroll to Top