অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান: স্মৃতিচারণ, আদর্শ ও শিক্ষণীয়

আবু জাফর আহমেদ মুকুল


আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ক্লাসে আমাদের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন স্যার ক্লাসে একদিন তাঁর মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে গিয়ে অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান স্যারের নেতৃত্বে-গুনের কথা তুলে ধরেছিলেন।

তখন থেকে খুব আগ্রহ করে ক্লাসের ফাঁকে অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান স্যারের বক্তব্য শোনার জন্য বিভিন্ন প্রোগ্রামে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করতাম এবং স্যারের নিয়মিত কলাম ও বই পড়তাম।

তবে আমার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও সমসাময়িক বিষয়গুলোর বিষয়ে স্যারের বক্তব্য শোনা। তবে স্যারকে দেখার আগে ভেবেছিলাম স্যার যেহেতু মুক্তিযোদ্ধা মনে হয় খুব দাপুটে হবে। আমার চোখে বাস্তবে আনিস স্যার সাদা ঢোলা পায়জামা, খদ্দরের পাঞ্জাবি ও সাদা চাদর পরা খুবই সহজ-সরল দৃষ্টি ভঙ্গির এবং ভরাট কণ্ঠের একজন মানুষ।

কলাভবনে গেলে দোতলায় ২০১১ নম্বর কক্ষটির প্রতি আমার দৃষ্টি ছিল স্যারকে যেয়ে কখন সালাম দিব? কলাভবনের বন্ধুদের বিশেষ করে যারা সংগঠন করত তাদেরকে বলে রাখতাম আনিস স্যারের প্রোগ্রাম হলে বলিস। স্যারের একটি বিষয় খুবই ভাল লাগতো একটি বিষয়ে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই অবস্থানে থাকতেন, কোন নড়চড় করতেন না। যা বর্তমান শিক্ষক সমাজে খুবই বিরল ঘটনা।

তবে স্যার ভাষা ব্যবহার করতেন খুবই নরম স্বরে। স্যারের প্রোগ্রামের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি তথ্য দিত কলা ভবনের ব্যাচমেট সাজিদ ও বন্ধুদের সহযোগিতায় স্যারের কয়েকটি এফসি (ফাউন্ডেশন ক্লাস)-এ যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে। স্যারকে লক্ষ্য করলাম একটি বিষয়ে খুবই গভীরে আলোচনা করে। স্যার ক্লাসে প্রত্যেকটি শব্দের বুৎপত্তি, বানান রীতি ও উচ্চারন বিষয়ে খুব সহজে বোঝাতেন সকল ছাত্রকে। বিশাল ক্লাস রুমে ছাত্রদের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য বাঙলা ও বাঙালির ইতিহাস বিষয়ে ছাত্রদের কাছ থেকে জানতে চাইতেন ও অভিজ্ঞতা শেয়ার করতেন।

একটি বিষয় আমার স্পষ্ট মনে আছে, আগস্ট ১৭, ২০০৬ইং সালে কবি শামসুর রাহমানের জানাজার নামায পড়তে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের দিকে আমি যাচ্ছিলাম পথে কলা ভবনের সামনে দেখা প্রিয় আনিস স্যারের সাথে। স্যারকে সালাম দিতে ভারি কন্ঠে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, তুমি কী আমাদের বিভাগের ছাত্র? আমি ভয়ে বললাম না স্যার। তবে আপনার বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশগ্রহন করি ও আমার বন্ধু বাংলা বিভাগে থাকায় মাঝে মাঝে আপনার বিভাগে যাই, আমি কথা বলা শেষ করতে না করতে স্যার স্নেহ করে বাবা বলে আমার মাথা বুলিয়ে দিলেন।

সেই দিনের কী আনন্দ যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। স্যার বললো, “তুমি ব্যবসায়ের ছাত্র হয়েও বাঙলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে আগ্রহ, আমার খুবই ভাল লাগলো।”তবে আমিও রীতিমতো অবাক হলাম স্যারের স্মৃতিশক্তি দেখে আমার চেহারা আন্দাজ করে আমাকে প্রশ্ন করেছে। তবে আমার মাথা বুলানোর বিষয়টি আজও স্মৃতিতে ভাসে।

অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান স্যার একজন শিক্ষাবিদ, লেখক, ইমেরিটাস অধ্যাপক ও জাতীয় অধ্যাপক। তিনি ভাষা আন্দোলন (১৯৫২), উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান (১৯৬৯) ও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে তার গবেষণা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

আনিসুজ্জামান স্যার শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য একাধিক পুরস্কার লাভ করেছেন। প্রবন্ধ গবেষণায় অবদানের জন্য ১৯৭০ সালে তিনি বাংলা একাডেমি থেকে প্রদত্ত বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। শিক্ষায় অবদানের জন্য তাকে ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য তাকে ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণ পদক প্রদান করা হয়।

সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৫ সালে তাকে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়। এছাড়া তিনি ১৯৯৩ ও ২০১৭ সালে দুইবার আনন্দবাজার পত্রিকা কর্তৃক প্রদত্ত আনন্দ পুরস্কার, ২০০৫ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট. ডিগ্রি এবং ২০১৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী পদক লাভ করেন।

অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান স্যার ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ১৯৯১ সালে গঠিত গণ আদালতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে এবং অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে, বাংলায় সংবিধান প্রণয়ন, শিক্ষা, গবেষনা, সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্য—অসাধারন অবদান আমাদের আজকের তরুন প্রজন্মকে উৎসাহিত করে।

তবে কয়েক বছর আগে স্যার একটি অনুষ্ঠানে নিজেই বলেছিলেন, তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে ১৯৯১ এবং পরবর্তীতে ২০০২ সালে গঠিত গণ আদালতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কাজটা স্যারের জন্য খুবই চ্যালেঞ্জ ছিল। এজন্য স্যার অনেক ধরনের বাধা-বিপত্তি পাড়ি দিতে হয়েছিল।

গত মার্চ ৩১, ২০১৬ইং দুর্নীতি প্রতিরোধ সপ্তাহ উপলক্ষে ‘দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলনের ভূমিকা’ শীর্ষক এ সেমিনারে স্যারের সাথে আমিও অংশগ্রহন করার সুযোগ পাই। প্রধান অতিথি ছিলেন আনিস স্যার বলেছিলেন, ”দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে জনগণকেও সম্পৃক্ত করতে হবে। এটি একটি সহযোগিতামূলক ব্যবস্থা। অনেকটা আক্ষেপের সুরে স্যার বলেছিলেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নৈতিক বোধ সম্পন্ন মানুষ তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে। মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ না হলে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা কঠিন। স্যারের প্রতিটি কথা আমাদের সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করি।

বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে স্যার প্রায়ই বলতেন “বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হচ্ছে, এটি অতিমাত্রায় রাজনীতিনির্ভর হয়ে গেছে। দলীয় রাজনীতির মতো এখানেও পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি হয়েছে, যেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভালো নয়। যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদে রাজনীতির প্রভাব যত কম থাকবে, ততই তা মঙ্গলজনক।”

পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে স্যারের বক্তব্যটি একটি জাতীয় পত্রিকায় ২০১৬ সালের ১৮ অক্টোবর প্রকাশিত হয়েছিল। যা প্রকৃতপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলার দর্শন বলে আমি মনে করি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের ছিল আজীবনের ছাত্রী-শিক্ষক সম্পর্ক। আনিসুজ্জামান যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, তখন এই বাংলা বিভাগেরই ছাত্রী ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই শিক্ষকের প্রতি তার শ্রদ্ধার অনন্য নজির স্থাপন করেন।

প্রধানমন্ত্রীর জন্য অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে মেলায় প্রবেশের পথে বিছানো লালগালিচা। সেই লালগালিচা দিয়ে হাঁটার সময় ড. আনিসুজ্জামান স্যারকে ছেড়ে দিয়ে পাশে হাঁটা শুরু করেন তার ছাত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এমন সময় প্রিয় শিক্ষকের কাঁধ থেকে অসতর্কতায় খসে পড়ে চাদর। সেটি লক্ষ্য করে নিজেই আনিসুজ্জামান স্যারের কাঁধে গুছিয়ে দিলেন গভীর মমতায়। যেন তিনি প্রধানমন্ত্রী নন, শিক্ষাগুরুর সান্নিধ্যে বিনয়াবনত শিষ্য এক।

ছবিটি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে দেশব্যাপী সবার প্রশংসায় ভেসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী এবং তখনও স্যারকে নিয়ে আবারও আমরা সমগ্র দেশবাসী গর্বিত হয়েছিলাম। কেউ কেউ বলেন, শিক্ষাগুরুকে সম্মান জানানোর ইচ্ছেটাই মুখ্য। রাষ্ট্রীয় পদ-পদবী এতে বাধা নয় কখনই, যদি সে ইচ্ছে আন্তরিক হয়। আর আমাদের বিনয়ী প্রধানমন্ত্রী তার শিক্ষককে মর্যাদা দিয়ে জাতিকে সেটিই আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন কেমনে বিনয়ী হতে হয়। নিশ্চয়ই এটি দেশের সকলের কাছে অনুকরণীয় ও শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে।

গত জানুয়ারী মাসে স্যারের সাথে কথা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর জম্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধের গল্প নিয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে তরুন ছাত্রদের সাথে একটি সেমিনার করার পরিকল্পনা নিয়ে। স্যার প্রোগ্রামে থাকবেন বলে রাজী ছিলেন। তাঁর বনানীর বাসায় যেতে আমাকে বলেছিলেন কিন্তু করোনার জন্য প্রোগ্রাম বাতিল হওয়ায় আর স্যারের বাসায় যাওয়া হয়নি। জাতির বাতিঘর আনিস স্যার যেখানে থাক ভাল থাকবেন এবং বিশ্বাস করি পরকালে একজন দেশপ্রেমিক লোক হিসেবে মহান আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাতবাসী করবেন।


লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, ম্যানেজমেন্ট এন্ড ফাইন্যান্স বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *