অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা
কোভিড-১৯’র কারণে পৃথিবী অনেকটাই স্থবির। ১৯১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত স্প্যানিশ ফ্লু বিস্তার লাভ করে। এ সময়ের মধ্যে পৃথিবী থেকে ৫ কোটি মানুষকে বিদায় নিতে হয়।
১৯৫৭-৫৮ সালে এশিয়ান ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে ১০ লক্ষ লোক মারা যায়। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত মারা গিয়েছে ৪ লাখ ৮০ হাজার মানুষ। আরও কত মারা যাবে এটা আপাতত বলা সম্ভব নয়। স্প্যানিশ ফ্লু প্রায় ২ বছর এবং এশিয়ান ফ্লু ১ বছর স্থায়ী হয়েছিলো।
কোভিড-১৯ কতদিন স্থায়ী হবে নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। কেউ কেউ মনে করছেন এটি বেশি সময় ধরে স্থায়ী হতে পারে। কিন্তু বেশিদিন স্থায়ী হলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার কি হবে? ইতোমধ্যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আই.বি.এ অনলাইনে ক্লাস নেয়া শুরু করেছে। শতবর্ষী কলেজ যেমন রাজশাহী কলেজও অনলাইন ক্লাস শুরু করেছে।
আই.বি.এ (ইনস্টিটিউট অব বিজনেস এ্যাডমিনিস্ট্রেশন) স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ইনস্টিটিউট। এরা অন্যান্য বিভাগ বা ইনস্টিটিউট থেকে একটু ব্যতিক্রম। এখানে মেধাবী ছাত্ররা ভর্তি হয়। তবে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগের চেয়ে এর টিউশন ফি অনেকগুণ বেশি। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের বৈষম্য থাকা উচিত নয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আই.বি.এ নিজস্ব বিল্ডিং তৈরি করেছে। তাদের প্রত্যেকটি ক্লাসরুমে এসি লাগানো। এছাড়াও এখানকার শিক্ষার্থীরা সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে আবাসিক হলগুলোতে থাকে না। ভবিষ্যতে এই ইনস্টিটিউটের আলাদা হোস্টেল করবার পরিকল্পনা আছে বলে জানা যায়। শুরু থেকেই একটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে পরিচালিত হয় আই.বি.এ- যা হওয়া উচিত নয়।
একই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এ ধরনের বৈষম্যও থাকা উচিত নয়। এই বৈষম্যের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আই.বি.এ অনলাইনে ক্লাস নিতে পারছে। অন্যান্য বিভাগ এখনও অনলাইনে ক্লাস নেওয়া শুরু করতে পারেনি। অনলাইনে ক্লাস নেয়ার ব্যাপারে আমার কিছু ব্যক্তিগত মতামত তুলে ধরবার চেষ্টা করছি।
অনলাইন শিক্ষা কখনই ক্লাসরুমের বিকল্প পরিবেশ তৈরি করতে পারে না। মুখোমুখি ক্লাসে বসে শিক্ষাগ্রহণ ছাত্রদের জন্য যেমন কার্যকরী, তেমনি এতে তাদের কমিউনিকেশন স্কিলও বেড়ে যায়। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের মনের মধ্যে কোনো কৌতূহল জাগলে, তৎক্ষণাৎ তারা সেটার সুরাহা করতে পারে।
এবার নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলি- এখানে আছে বিশাল স্টেডিয়াম, অডিটোরিয়াম, সুইমিং পুল, টি.এস.সি.সি ইত্যাদি শিক্ষা অনুষঙ্গী নানান উপকরণ। প্রতি বছর আন্তঃবিভাগ ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন ইত্যাদি নানান ধরনের খেলাধূলার প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে।
ছাত্র-শিক্ষক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতি বছর সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে। ডিবেটিং ফোরাম আন্তঃকলেজ, আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। সাংস্কৃতিক জোটে রয়েছে ১০টি কালচারাল সংগঠন, যারা নিয়মিত সাংস্কৃতিক চর্চা করে থাকে। আবৃত্তি সংগঠন প্রতি বছর বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
সামাজিক সংগঠনের মধ্যে বাঁধন, স্বজন স্বেচ্ছায় রক্তদান প্রতিষ্ঠান প্রতিনিয়ত শত শত মানুষের জন্য এগিয়ে আসে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম আকর্ষণ কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি। বিভাগে এবং হলগুলোতে রয়েছে পড়াশুনার জন্য সেমিনার লাইব্রেরি। বিজ্ঞান শাখায় প্রতিটি বিভাগে রয়েছে ল্যাবরেটরি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় গবেষণার জন্য অনেক অর্থ বরাদ্দ করে থাকে। গবেষণা-ব্যবহারিক ক্লাস ইত্যাদি ব্যতিরেকে অনলাইন ক্লাস পরিপূর্ণ শিক্ষা দিতে পারবে কি-না সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ হয়।
উপরন্তু আমাদের মতো স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরাই বেশি ভর্তি হয়। তাদের অনেককেই পরিবার পড়াশুনার খরচ পুরোপুরি দিতে পারে না। আমাদের অনেক শিক্ষার্থী নিজে টিউশনি করে পড়াশুনার ব্যয় নির্বাহ করে। তাদের অনেকেই করোনাকালীন বাড়িতে বসে আছে।
নিম্ন আয়ের অনেক শিক্ষার্থীকে তাদের আবেদনের ভিত্তিতে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকেরা স্বপ্রণোদিত হয়ে অর্থ সাহায্য করেছেন এবং করে যাচ্ছেন। নিম্ন আয়ের এসব শিক্ষার্থীদের বাদ নিয়ে অনলাইন ক্লাস চালু করার যৌক্তিকতা ভেবে দেখতে হবে।
এছাড়াও হলগুলোতে অবস্থান করার কারণে বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। যার মাধ্যমে প্রতিটি অঞ্চলের কৃষ্টি-কালচার সম্পর্কে জানার সুযোগ ঘটে। সবকিছু মিলিয়ে বলা যায় অনলাইনের মাধ্যমে ক্লাসের পরিপূর্ণ সফলতা অর্জন সম্ভব নয়। তা’হলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কেন অনলাইনে ক্লাস শুরু করেছে? প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বেতন কোথা থেকে আসে? শিক্ষার্থীদের অর্থেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় চলে।
বিশ্ববিদ্যালয় যদি বন্ধ থাকে তবে এ পরিমাণ অর্থ আসবে কোত্থেকে? তাই বাধ্য হয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে অনলাইনে ক্লাস নিতে হয়। তবে এই আপদকালীন কি করা যেতে পারে? হ্যাঁ অনলাইনে জীবন সম্পর্কে যুব সম্প্রদায়ের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করা বা শিক্ষকদের পঠন-পাঠনে বা গবেষণায় কিভাবে নিবেদিত হওয়া যায়; এ রকম প্রতিদিন একটা কিংবা দুইটা ক্লাস নেওয়া যেতে পারে। প্রথিতযশা ব্যক্তিদের মাধ্যমে তরুণ শিক্ষার্থীদের দেশপ্রেম-অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা, মহান মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি বিষয়ে অনলাইনে ক্লাস নেয়া যেতে পারে।
যারা এ মুহূর্তে অনলাইন ক্লাস নিতে ভীষণ আগ্রহ দেখাচ্ছেন, বিশেষ করে আমাদের কোন কোন সহকর্মী- আমি তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই তাদের আগ্রহের জন্য। কিন্তু একবার ভাবুনতো আপনার প্রতিবেশী দু’জন ডাক্তার তাঁদের ৮ বছরের ছোট্ট একটা বাচ্চাকে ঘরে রেখে কোভিড-১৯ রোগীদের জীবন বাঁচানোর জন্য প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছেন। ডাক্তার-নার্স, পুলিশ, সিভিল প্রশাসন, সামরিক বাহিনীর সদস্যরা জীবনকে বাজি রেখে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। আমরা তাঁদেরকে জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
আই.সি.ইউ-তে এবং হাসপাতালে সার্ভিস দিতে গিয়ে অনেক ডাক্তার জীবন দিয়েছেন। অনেক পুলিশও জীবন দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের আমরা হারিয়েছি। হারিয়েছি আমাদের একজন জাতীয় অধ্যাপককে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখতে হবে। তা না হলে আমরা চলতে পারবো না। কিন্তু এ মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনলাইন ক্লাসের কি খুবই প্রয়োজন?
প্রায় এক লক্ষ লোক আক্রান্ত, তাদের পরিবার-আত্মীয়-স্বজন যে কি দুঃশ্চিন্তায় আছে, একবার ভাবুন তাদের কথা। আমরা কি করতে পারছি এ মুহূর্তে? হয়ত অন্যদের মতো আমাদের সরাসরি কিছু করার সুযোগ নেই, কিন্তু তাদের প্রতি আমাদের সহানুভূতি, শ্রদ্ধা-ভালোবাসা তো জানাতে পারি।
আশাকরি করোনা ভাইরাস বেশিদিন থাকবে না। তখন আমরা আবার ফিরে যাবো আমাদের ক্লাসরুমে, ল্যাবরেটরিতে। অতীতে আমরাই সেশন জট কমাতে পেরেছি, ভবিষ্যতেও পারবো বলে আশা রাখি।
লেখকঃ অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা
উপ-উপাচার্য
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।