অনলাইন ক্লাস করে কি আসলেই উপকৃত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা?

ফারহান আহমেদ রাফি, জবি


মহামারী করোনা ভাইরাসের কারণে পুরো পৃথিবী স্থবির হয়ে আছে, সেই সাথে স্থবির হয়ে আছে পুরো পৃথিবীর শিক্ষা ব্যাবস্থা। শিক্ষা ব্যাবস্থা কে সচল রাখতে পৃথিবীর প্রায় সকল দেশ ই বিকল্প হিসেবে বেছে নিচ্ছে অনলাইন শিক্ষা ব্যাবস্থা কে।

তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও বেশ কয়েকটি পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়েছে অনলাইন ক্লাস । তারই ধারাবাহিকতায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটি বিভাগে বেশকদিন ধরে শুরু চলছে অনলাইন ক্লাস । জবির সে সকল বিভাগের মধ্যে থেকে কিছু বিভাগের শিক্ষার্থীদের কে তাদের অনলাইন ক্লাস নিয়ে মতামত জিজ্ঞেস করা হলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় ।

তারা তাদের মতামত জানায় আমাদের প্রতিনিধি ফারহান আহমেদ রাফি কে। পাঠকদের উদ্দেশ্যে তাদের মতামত গুলো তুলে ধরা হলো:-


নওশীন আশরাফি জয়িতা
১৪ তম ব্যাচ 
দর্শন বিভাগ

করোনা মহামারীর জন্য দীর্ঘসময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশোনা থেকে মূলত অনেকটাই দূরে রয়েছে।এ সময় অনলাইন ক্লাস শুরুর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা আবার পড়াশোনার ক্ষেত্রে মনোযোগ ফিরে পাচ্ছে। অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে সেশন জট এড়ানো, শিক্ষার্থীদের তাদের মূল কার্যক্রমে ফেরা এসব সুবিধার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা নানাবিধ অসুবিধারও সম্মুখীন হচ্ছে। প্রথমত, মহামারীর এই সময়ে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটি গুরুত্বের সাথে বিবাচনা করা উচিত।

কারো পরিবারের সদস্য করোনা আক্রান্ত হলে তার পক্ষে অনলাইন ক্লাসে মনোনিবেশ করা কতটুকু সম্ভব? দ্বিতীয়ত, অধিকাংশ শিক্ষার্থী গ্রামে অবস্থান করায় পর্যাপ্ত নেটওয়ার্ক সুবিধা পাচ্ছে না।অনেকের কাছে প্রয়োজনীয় ডিভাইস না থাকার কারণে তারা ক্লাসে অংশগ্রহন করতে পারছে না। এতে শিক্ষার্থীদের ওপর মানসিক চাপ আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং একপ্রকার বৈষম্যের সৃষ্টি হচ্ছে। সম্প্রতি মেগাবাইট এর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় অনলাইন ক্লাসের প্রতি শিক্ষার্থীদের নেতিবাচক মনোভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে।সম্প্রতি বিভিন্ন নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ২২ টি জেলা ভয়াবহ বন্যার কবলে রয়েছে।

এমতাবস্থায় শিক্ষার্থীদের সমস্যা গুলো পর্যবেক্ষন করে তা স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠান থেকে সমাধান করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহন করলে করলে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার পদক্ষেপটি আরও ফলপ্রসূ হবে বলে আমি মনে করি।


মোঃ রিয়াজ হোসেন 
১৩ তম ব্যাচ
ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ

অনলাইন ক্লাসকে ব্যক্তিগত ভাবে আমার প্রহশন বলেই মনে হয়।পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কেবল ধনীদের জন্য নয়,সেখানে গ্রাম-গঞ্জ থেকে উঠে আসা হাজারো ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে।তাদের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত না করে অনলাইন ক্লাস করাটা প্রহসনই বটে।ইন্টারনেটের উচ্চমূল্য আর কচ্ছপ গতির নেটওয়ার্ক নিয়ে অনেকেই ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারছে না।

পাশাপাশি ক্লাসের এ্যাটেনডেন্স নেওয়া,টিচারদের যখন তখন ক্লাস নেওয়া, ক্লাস গুলো আপলোড না করার ফলে সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে।আমি অনলাইন ক্লাস এর বিপক্ষে নয়,বরং আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের ডিপার্টমেন্ট থেকে মাসিক ইন্টারনেট খরচ,টিচারদের সময় মত ক্লাস নেওয়া,ক্লাসগুলো আপলোড করার মধ্যে দিয়েই এই সমস্যার সমাধান করা যাবে বলে আমার মনে হয়।


রেজোয়ানা সুলতানা তৃণা
১৫ তম ব্যাচ
প্রাণিবিদ্যা বিভাগ

জীবনের প্রায় সকল অধ্যায়েই ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব থাকে। কখনো হয়তো ইতিবাচকের ভাগটা বেশি থাকে কখনো হয়তো বা নেতিবাচকের । করোনা মহামারীর মতো করূন এক সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটির সময় যেখানে দীর্ঘায়িত হচ্ছে সেখানে অনলাইন ক্লাস নেয়াটা আমি খুব যথার্থই অনুভব করি।যেসব শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট সংযোগ সবল তাদেরক্ষেত্রে অনলাইন ক্লাস ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেই আমি মনে করি কারন শিক্ষক মণ্ডলী উনাদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে আমাদের সহযোগিতা করছেন, পড়াচ্ছেন এবং ক্লাসের রেকর্ডিং, পিডিএফ, স্লাইড সবই আমরা খুব সহজেই উনাদের সহযোগিতায় পেয়ে যাচ্ছি এবং পাশাপাশি প্রশ্ন করারও সুযোগ রয়েছে।

যার ফলে আমাদের কনফিউশনের জায়গা গুলো ক্লিয়ার হয়ে যায় ।প্রাতিষ্ঠানিক ক্লাস গুলোতে শিক্ষক মণ্ডলী যেরকম ইফোর্ট দিতেন অনলাইন ক্লাসেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। সুতরাং যদি ইতিবাচক মনোভাব এবং মনোযোগ দিয়ে অনলাইন ক্লাস করা হয় তাহলে আশা করি অবশ্যই শিক্ষার্থীদের উপকার হবে।আর যেসব শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট সংযোগ দুর্বল তারা যদি পরবতীর্তে রেকর্ডেড ক্লাস গুলো দেখে তাহলে তারাও কিছুটা উপকৃত হবে বলে আমি মনে করি।তবে এক্ষেত্রে তাদের যদি কোনো কনফিউশন থাকে তবে তাদের প্রশ্ন গুলো রয়েই যাবে ।


সাইদুল ইসলাম।
১৩ তম ব্যাচ
হিসাববিজ্ঞান বিভাগ

ঘরে বসে ক্লাস করার অভিজ্ঞতা একেবারে নতুন। আগে কখনো এমনটি হয় নি। নি:সন্দেহে অনলাইন ক্লাস বাংলাদেশের জন্য যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসের কারনে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। এখনো নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না কবে নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।

এদিকে সেশনজটের শঙ্কায় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। মূলত শিক্ষা কার্যক্রম সচল রেখে সেশনজট এড়াতে ও শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ইতিমধ্যে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাস নেওয়া শুরু করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে অনলাইন ক্লাস থেকে শিক্ষার্থীরা কতটুকু উপকৃত হচ্ছে? উল্লেখ্য অনলাইন ক্লাসের সুবিধার চাইতে সমস্যাই বেশি। দুর্বল নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট ডেটার উর্ধ্বমুখী মূল্য, ডিভাইস সমস্যা ইত্যাদি সমস্যা পোহাতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অধিকাংশ শিক্ষার্থী মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিবার নিয়ে খেয়ে বেচে থাকাটা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। সেখানে ইন্টারনেট খরচ বহন বিলাসিতা ছাড়া কিছুই নয়। আবার অনেকের উপযুক্ত ডিভাইস নেই যা দ্বারা সে অনলাইন ক্লাসে যুক্ত হতে পারবে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের নেটওয়ার্ক সম্পর্কে আমাদের সকলেরই ধারনা আছে ।

সামান্য বৃষ্টি হলে কিংবা ঝড়ের পূর্বাভাস দেখা দিলে বৃষ্টি চলে যায়। উল্লেখ্য বর্তমানে সিংহভাগ শিক্ষার্থী পরিবারের সাথে গ্রামে অবস্থান করছে। যার কারনে অনেকেই অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারছে না। বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম থেকে। যা একধরনের বৈষম্য তৈরি করছে। আবার যারা ক্লাসে অংশ নিচ্ছে তাদের অনেকেই দুর্বল নেটওয়ার্কের কারনে ভালোভাবে ক্লাস বুঝতে পারছে না। আবার শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ক্লাস রেকর্ডিংয়ের অসম্মতির কারনে পরবর্তীতে ক্লাসের পড়া পুষিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না। উদাহরণস্বরূপ আমার নিজের কথাই যদি বলি।

আমি বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমাদের ক্লাসের প্রতিদিন প্রায় ৫০-৫৫ জনের উপস্তিতি দেখা যায়। যা মোট শিক্ষার্থীর ৬৫-৭০ শতাংশ। তাহলে অনেকেই অনলাইন ক্লাস সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আবার দুর্বল নেটওয়ার্কের কারনে আমাকে বাড়ির বাইরে কোথাও দাঁড়িয়ে ক্লাস করতে হচ্ছে। কিন্তু বৃষ্টি হলে কিংবা প্রচন্ড রোদের কারনে বাইরে দাঁড়িয়ে সকল ক্লাস করা সম্ভব হচ্ছে না। এভাবে অধিকাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাস থেকে বাদ পড়ছে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। পিছিয়ে পড়ছে কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী।

উক্ত বৈষম্য এড়াতে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অতি শীঘ্রই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। বিনামূল্যে ইন্টারনেট সেবা, নেটওয়ার্কের মান বৃদ্ধিসহ শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় ডিভাইস প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। পরিকল্পিতভাবে নীতিমালা তৈরি করে দেশের সকল শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

Scroll to Top