অনলাইন ক্লাস, সামথিং ইজ বেটার দেন নাথিং: উপাচার্য

ফজলুল হক পাভেল,
জাককানইবি প্রতিনিধি


করোনার করাল গ্রাসে বিপর্যস্ত পুরো বিশ্ব। থমকে গেছে জীবনের গতি। মৌলিক চাহিদার জোগান দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে রাষ্ট্র। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসাসহ সকল খাতেই দেখা দিয়েছে মন্দাভাব। প্রতিটি দেশের মত বাংলাদেশও তার নিজস্ব সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে করোনাকালে জীবনযাত্রা গতিশীল রাখতে চেষ্টা চালাচ্ছে। একাধিক খাতের মত শিক্ষাখাতেও দেখা দিয়েছে স্থবিরতা।

 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকার ফলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনাও থমকে গেছে। এমতাবস্থায় দেশের শিক্ষাবর্ষে সামঞ্জস্যতা আনতে শিক্ষাবর্ষের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হবে বলেও জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা চলমান রাখতে গিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাকেই আদর্শ বলে মানছে। তবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার এই অনলাইন মাধ্যমেও দেখা দিয়েছে কিছু সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা।

 

শিক্ষাবিদরা একদিকে যেমন দেখছেন সম্ভাবনা তেমনি অন্যদিকে সম্মুখীন হচ্ছেন বিভিন্ন সমস্যারও। অনলাইন ক্লাস নিয়ে ভাবনা গুলো তুলে ধরেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

 

সমস্যা সমাধানকল্পে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য প্রফেসর ড. এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান জানালেন বিভিন্ন পরিকল্পনা। সরেজমিনে শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে সেই সমস্যা সমাধানে করণীয় বিভিন্ন দিক সম্পর্কে নিয়ে কথা বলেছেন দ্যা ক্যাম্পাস টুডে।

 

ব্যবহারিক শিক্ষার জটিলতা নিয়ে মন্তব্য তুলে ধরে চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস সাম্মি বলেন, ‘আমাদের কাজগুলো প্র্যাক্টিক্যাল। আমাদের ক্লাসগুলো অনলাইনের মাধ্যমে করা যাবে। কিন্তু সমস্যা হলো সবার কাছে ভালো মোবাইল ফোন নেই। ভালো ক্যামেরা নেই। তাই আমরা যদি আমাদের কাজগুলো স্যারদের দেখাই তারা স্ক্রিনে দেখে সঠিকভাবে বুঝতে পারবেন না, মূল্যায়ন কিভাবে হবে সেটিও চিন্তার বিষয়। যদি কাজের মার্কিং করা হয়, তাহলে সঠিকভাবে সেটা করা সম্ভব নয়। থিউরি ক্লাসগুলো ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে করা যাবে। কিন্তু প্র্যাক্টিক্যাল কাজের ক্ষেত্রে সমস্যা হবে।

শিক্ষার্থীদের ক্লাসে যুক্ত না হতে পারার মতো একাধিক সমস্যা তুলে ধরে পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন এন্ড গভর্নেন্স স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী নিলয় মাহমুদ রুবেল বলেন, ‘অনলাইনে ক্লাস এক প্রকার অসম্ভব। যেখানে কোন অপারেটর তাদের ৬৪ জেলাতে নেটওয়ার্ক কাভারেজ করতে সক্ষম নয়। আর ২জি দিয়ে ফেসবুক চালাতেই কষ্ট হয়। তাতে ৩/৪জি নেট ছাড়া লাইভ ক্লাস সম্ভব না। সেই সাথে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে রয়েছে উচ্চমূল্যের ইন্টারনেট। অনেকের ভালো মানের মোবাইলও নেই।’

ফোকলোর বিভাগের শিক্ষার্থী নিপা পাল বলেন, ‘করোনাকালীন সময়ে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে পারাটা হবে নি:সন্দেহে ফলপ্রসূ একটি প্রক্রিয়া। তবে এখানে যে সীমাবদ্ধতাগুলো আছে যেমন: দুর্বল নেটওয়ার্কিং সিস্টেম, ব্যয়বহুল ইন্টারনেট ইত্যাদি। সেক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অল্প খরচে যথাযথ ইন্টারনেটের ব্যবস্থা করতে পারলেই শুধু এ মিশন বাস্তবায়ন করা সম্ভব। আমরাও দ্রুত শিক্ষা কার্যক্রমে যোগ দিতে চাই।’

ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষার্থী সোহেল আহমেদ রানা সম্ভাবনার দিকটিকে আমূলে নিয়ে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে অনলাইনে পাঠদান করার যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সেটা হাতের কাছে পাওয়া প্রথম মাধ্যম। শিক্ষা কার্যক্রমের বর্তমান স্থবিরতায় এ সিদ্ধান্ত কিছুটা গতি নিয়ে আসবে এবং সেশনজট নিরসনে কাজ করবে। অনলাইনে পাঠদানের ক্ষেত্রে ইন্টারনেট ব্যালেন্স, নেটওয়ার্ক এবং ইন্টারনেট ডিভাইসের প্রয়োজন অত্যাবশ্যকীয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগের ইন্টারনেট ডিভাইস (মোবাইল বা ল্যাপটপ) হয়তো থাকে। তবে নেটওয়ার্কের সহজলভ্যতা নিয়ে গ্রাম অঞ্চলে ঝামেলা রয়েছে। যাদের ইন্টারনেট ডিভাইস নেই তাদের জন্য ডিপার্টমেন্টভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে। একটা কমন শেয়ার ড্রাইভও জরুরি যেখান থেকে শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টগুলো ডাউনলোড করে নিতে পারবে। সবার কথাই চিন্তা করতে হবে। ইন্টারনেট ব্যালেন্স ক্রয় করাটাও এখন অনেকের জন্য কষ্টকর। সেদিকেও একটা ভাল সিদ্ধান্ত থাকা দরকার।’

ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী মেশকাতুল জিনান বলেন, ‘অনলাইন ক্লাস এখন আলোচিত একটি বিষয়, ১৭ই মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। কবে শিক্ষার্থীদের এই ছুটি শেষ হবে, কবে তারা ক্লাসে যেতে শুরু করবে তা এখন অনিশ্চিত। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা যেন গতিশীল থাকে তার বিকল্প পথ অনলাইন ক্লাস। তবে অনলাইন ক্লাসে জয়েন করার জন্য যে সকল সুবিধা প্রয়োজন সেই সকল সুবিধা অধিকাংশ শিক্ষার্থীর নেই (ইলেকট্রনিক ডিভাইস, নেটওয়ার্ক কভারেজ, অর্থনৈতিক সুবিধা)।আমাদের দেশে ইন্টারনেটের মূল্য ক্রমেই ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে, এই সংকটময় পরিস্থিতিতে ইন্টারনেট কিনে নিয়মিত অনলাইন ক্লাস করা অনেকের জন্য সম্ভব না। তবে নামমাত্র মূল্যে ইন্টারনেট এবং প্রয়োজনীয় সুবিধা পেলে শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করবে, সব শিক্ষার্থীই উন্মুখ হয়ে আছে ক্লাসে ফিরে যাওয়ার জন্য।’

ফোকলোর বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী অনিন্দিতা সেঁজুতি এই মাধ্যমের সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে বলেন, ‘ইউজিসি একটি গবেষণায় দেখেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শতকরা আশিভাগ শিক্ষার্থীর হাতে স্মার্টফোন আছে কিন্তু সেই স্মার্টফোন কি অবস্থায় আছে তা তো ইউজিসি জানে না। বেশিরভাগের হাতের স্মার্টফোনই অনলাইন ক্লাসে ব্যবহারের উপযোগী না, এইমুহূর্তে অনেকের পক্ষেই ফোন কেনা বিলাসিতা। সম্ভবত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি দেখে ইউজিসি কর্তৃপক্ষের এই ধারণা। কিন্তু বলা বাহুল্য বাংলাদেশে সামাজিক মাধ্যমকেই ফ্রি ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়েছে। কোনো শিক্ষামূলক অনলাইন প্লাটফর্মকে ফ্রি সেবার আওতায় আনেনি কেউ। অন্যদিকে ইন্টারনেট প্যাকেজের দাম বেশি, নেটওয়ার্ক কানেকশন খুবই দূর্বল। অধিকাংশ শিক্ষার্থী ৪জির আওতাধীন না। আবার ওয়াইফাই এর আওতায়ও না সবাই। সুতরাং এই অনলাইন কর্মসূচি শুধু ভোগান্তি বাড়াবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের।’

হিসাববিজ্ঞান ও তথ্যপদ্ধতি বিভাগের শিক্ষার্থী চৌধুরী নিশাত আনজুম অনলাইন ক্লাস নিয়ে প্রতিবন্ধকতার বলতে গিয়ে বলেন, আমরা শিক্ষার্থীরা সবসময়ই চাই যে আমরা মাল্টিমিডিয়া টেকনোলজি বেইস ক্লাসরুম পাই। যা সাধারণত বিদেশি ক্লাসরুমগুলো কিংবা বাংলাদেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রদান করে থাকে। কিন্তু আমরা এটাও ভুলতে পারবো না পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষাপট কি! আমার ব্যক্তিগতভাবে এই অনলাইন ক্লাস পছন্দ না। বিভিন্ন এসাইনমেন্ট আর রিসার্চ কাজ দিয়ে সবাইকে ব্যস্ত রাখা যেতেই পারে। আমরা স্যারদের সাথে সংযুক্ত থাকতে পারি। কিন্তু যেভাবে আমরা ক্লাসরুমে বসে বা খোলা স্থানে বসেও শিক্ষা নিতে পারতাম তার মত তথ্যমূলক হবে না। আসলে বিশ্ববিদ্যালয় এ ক্লাস মানেই মনে হয় সবকিছু মিলিয়ে শিক্ষা নেয়া। গুগল ক্লাস বা জুম ক্লাস সেক্ষেত্রে একটা বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা মাত্র। বিদেশের যেসব ভার্সিটি রেগুলার অনলাইন ডিগ্রি অফার করে তাদের অনলাইনের ক্রেডিট ফি রেগুলার ফি থেকে অনেক কম থাকে। আর অনলাইনে ক্লাস করাতে একটা প্রিপারেশান টাইম থাকা দরকার ছিল। ক্লাস বন্ধ হওয়াতে বেশিরভাগ স্টুডেন্ট বাড়িতে চলে গিয়েছে, হুট করে বললে স্টুডেন্টরা কিভাবে ম্যানেজ করবে? আমরা কেনো ধরেই নিয়েছি সব স্টুডেন্টদের বাসায় কম্পিউটার আছে, অনলাইন ক্লাস করার মতো নেট স্পিড আছে! সংখ্যাটা যতই কম হোক (১ জন হলেও) তাদের সাথে আনফেয়ার হলে পুরা ব্যাপারটাই আনইথিক্যাল।

শিক্ষার্থীদের মাঝে দেখা দেয়া এই সমস্যাগুলোর প্রসঙ্গ টেনে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য প্রফেসর ড. এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান দ্যা ক্যাম্পাস টুডে কে বলেন,অনলাইন ক্লাস শুরু করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে জুম অ্যাপসের মতোই নিজস্ব একটি অনলাইন প্লাটফর্ম তৈরির চেষ্টা চলছে। যাতে করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমকে সেই অ্যাপসের মাধম্যে যুক্ত করা যায়। এতে করে সকল বিশ্ববিদ্যালয়কে এই অনলাইন পাঠদান প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা যাবে। আপাতত বিচ্ছিন্নভাবে শিক্ষকরা যে পাঠদান করছেন তাতে একটা রিপোর্ট পেয়েছি যে ৩০-৪০ ভাগ শিক্ষার্থীরা সেখানে এক্সেস পাচ্ছে না। এমনটি হলে শিক্ষাগ্রহণে সমস্যা হবে। এটির আরেকটি প্রতিবন্ধকতা হলো এই অনলাইন সিস্টেমে তো পরীক্ষাও দেয়া সম্ভব না।

আরও বলেন, আপাতত অনলাইন ক্লাস নিয়ে পড়াশোনাটুকু চলমান রাখা যাবে। পরিস্থিতিটুকু স্বাভাবিক হলে তারপরই পরীক্ষার চিন্তা। অনলাইন ক্লাসের জন্য সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেই আমরা পাঠদানে যাবো। “একটি কথা আছে না? Something is better than nothing?” এরকম আরকি। আমরা আমাদের সেরা চেষ্টাটুকু করছি। অ্যাপসটি এজন্যই তৈরি করা হচ্ছে যাতে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে টাকা দিতে না হয়। আমি আশাবাদী যদি এরকম হয় যে আমার কোনো শিক্ষার্থী এই মাধ্যমে বাদ পড়বে না তবে এই অনলাইন ক্লাস শুরু করা যেতেই পারে।

শেষে বলেন, পরবর্তীতে করোনামুক্তির পর আমরা পরীক্ষা নিয়ে ভাববো। এর বড় সুবিধাটি হলো অন্তত শিক্ষার্থীদের কোর্সটি সম্পন্ন হয়ে গেল।শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হারও সহজেই মূল্যায়ন করা যাবে। তবে করোনার কারণে যদি শিক্ষার্থীরা এরপরেও নানা প্রতিবন্ধকতায় যৌক্তিকভাবেই এই ক্লাসে যুক্ত হতে না পারেন তবুও শিক্ষকরা তাদের প্রতি নমনীয় দৃষ্টি দেবেন বলে আমার বিশ্বাস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *