আইনত পিতামাতার ভরণপোষণ বাধ্যতামূলক

আইনত পিতামাতার ভরণপোষণ বাধ্যতামূলক

জিসান তাসফিক


একটি শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে তখন আশ্রয়স্থল হয় পিতা-মাতা। শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যুবক এবং প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত সম্পূর্ণ সময় পিতামাতার লালন পালনে থাকে। পিতা – মাতা‍ যে জীবনের কতটা মূল্যবান সেটা যেকোনো মানুষের জীবন পর্যালোচনা করলে জানা যায়।

কিন্তু বর্তমানে পৃথিবীর অবস্থান এমন একটি পর্যায় চলে গিয়েছে পরম প্রিয় পিতামাতার বৃদ্ধাবস্থায় থাকতে হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। এছাড়াও আরও অনেক সামাজিক ঘটনা ঘটতেছে যার পরিপ্রেক্ষিতে ২৭ শে অক্টোবর ২০১৩ সালে মহান জাতীয় সংসদে পিতামাতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩ পাশ করে বাধ্যতামূলক করা হয়।

আমাদের সমাজে পরিবার প্রথাটি অনেক পুরাতন প্রথা। এই পরিবার প্রথা মূল ভিত্তি হল স্বামী স্ত্রী। স্বামী স্ত্রীর জৈবিক সম্পর্কের ফলে যে সন্তান উৎপাদন হয় মূলত তারাই উক্ত সন্তানের পিতা-মাতা। এছাড়া অনেক নিঃসন্তান হওয়ার কারণ কিংবা ইচ্ছা কৃত ভাবে সন্তান দত্তক নিয়ে থাকেন। এই প্রথাটি মূলত হিন্দু ধর্ম থেকে আসা। সন্তানের লালন পালন পিতা-মাতাই করেন এবং পিতা-মাতার মৃত্যুর পরে সকল সম্পত্তির উত্তরাধিকার ঐ সন্তানই হয়ে থাকে।

এই ক্ষেত্রে ধর্ম ভেবে আলাদা আলাদা উত্তরাধিকার আইন রয়েছে। সন্তানের সাথে পিতা-মাতার রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। পিতামাতা ও সন্তানের সম্পর্ককে সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দিয়েছে বিভিন্ন ধর্মগুলোতে। একসময় সন্তানের নৈতিক দায়িত্ব ছিল কিন্তু বর্তমানে আইন করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর কারণ বৃদ্ধ পিতামাতাকে নির্যাতন এবং আর কোনো প্রতিকার না থাকায় ও বৃদ্ধাশ্রমে প্রেরণ করার ফলে।

৬০ এর বেশী বয়স্কদের সিনিয়র সিটিজেন বলা হয়। ২৭ নভেম্বর ২০১৪ বিশ্ব প্রবীণ দিবসে দেশের ১ কোটি ৩০ লাখ ষাটোর্ধ প্রবীণ নাগরিককে সিনিয়র সিটিজেন ঘোষণা করলেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি বিভাগে সরকারি ও বেসরকারী ভাবে বৃদ্ধাশ্রম আছে। এসব বৃদ্ধাশ্রমে প্রতিনিয়ত বৃদ্ধদের সংখ্যা বৃদ্ধই পাচ্ছে। যা আসলে আমাদের জন্য খারাপ সংকেত। আজকাল কাউকে আর ঠাকুরমার ঝুলি বলার জন্য বাসায় রাখতে চায় না।

অথচ একটি সময় ছিল যখন শিশুদের শৈশব আর কৈশোর পরিতৃপ্তি পেত দাদা ও নানা বাড়িতে বেড়াতে গেলে। চাকরির পরিসংখানের কথা বললে সাধারণত ষাট বয়সের বেশী কোনো চাকুরী নেই। চাকুরীহীন বৃদ্ধরা এসময়ই অসহায়। সরকারি চাকুরীর ক্ষেত্রে পেনশন সম্বল হয় কিন্তু বেসরকারি কিংবা প্রাইভেটে এমন সুবিধা নেই।

পিতামাতাকে ভরণপোষণের বিষয়টি আইনত বাধ্যতামূলক করার পূর্বে এটি ধর্মীয় ও নৈতিক বিষয় ছিল। সামাজিক রীতিনীতি ছিল। একসময় এই দেশে বৃদ্ধাশ্রম বলতে কিছুই ছিল না। আশ্রম ছিল যেখানে সন্যাসীরা থাকত। ইসলাম ধর্মে পিতামাতার মর্যাদা ও ভরণপোষণ দেওয়া আছে।

মাতা-পিতার হক সম্পর্কে পবিত্র কুরআন শরীফে আল্লাহ বলেন : ‘ আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তার সঙ্গে কোন বস্তুকে শরীক করো না এবং মাতা-পিতার প্রতি উত্তম আচরণ কর।’ (নিসা ৩৬)

হজরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত। এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল ‘ইয়া রসুলুল্লাহ! আমি সর্বাগ্রে কার সঙ্গে সদাচরণ করব? রসুল (সা.) বলেন, তোমার মায়ের সঙ্গে। লোকটি প্রশ্ন করল, তারপর? উত্তর এলো তোমার মা। লোকটি আবার জানতে চাইল অতঃপর কে? রসুল (সা.) এবারও জবাব দিলেন তোমার মা। ওই লোক চতুর্থবার একই প্রশ্ন করলে রসুল (সা.) বলেন, তোমার পিতা।’ (বোখারি ও মুসলিম)।

এছাড়াও বিখ্যাত পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী ও তার মায়ের বিষয়টি আমরা সবাই জানি। হিন্দু ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ আছে ‘জননী স্বর্গ অপেক্ষা গরীয়সী। পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাই পরম তপস্যার ব্যক্তি।’ খ্রিস্টান ধর্মে জিসু খৃীস্ট ( কুরআন অনুযায়ী ইসা আ: ) উনার মাতা মরিয়া ( মরিয়ম আঃ ) পবিত্রতার কথা আজীবন বলেছেন। বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটকে বলা হয়েছে ‘মাতাপিতার সেবা করাই সবচেয়ে উত্তম’।

কিন্তু বর্তমানে সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষা ভুলে মানুষ পিতামাতাকে ভুলে গিয়েছেন। মানুষ অকৃজ্ঞত ও কৃতঘ্ন না হলে এমন পর্যায় আসে না। যার ফলে বাংলাদেশের সরকার পিতামাতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩ প্রণয়ন করেছে।

উক্ত আইনের ২ ধারা অনুযায়ী জন্মদাতা পিতা ও মাতা এই আইনের আওতাভুক্ত হবেন। ভরণপোষণের বিষয়ে উক্ত আইনের ৩ ধারা স্পষ্ট বলা হয়েছে যে পিতামাতার ভরণপোষণের বিষয় সন্তান নিশ্চিত করবে এবং একাধিক সন্তান থাকলে আলাপ আলোচনা করে নিশ্চিত করবে। পিতামাতার সকল খেদমতের বিষয়ে সন্তান পরস্পরের সাথে আলোচনা করে পরস্পরের স্থানে থেকে কাজ করবেন।

৪ ধারা অনুযায়ী দাদা-দাদী ও নানা নানী থাকলে পিতামাতার অবর্তমানে তাদের ও ৩ ধারা অনুযায়ী খেদমত করতে হবে। কেউ যদি উক্ত আইন অমান্য করে তবে তাকে এক লক্ষ টাকার অর্থ দণ্ড এবং অনাদায়ে তিন মাসের জেলের বিধান করা হয়েছে। একটি আমলযোগ্য, জামিন যোগ্য ও আপোষ যোগ্য মামলা করা হয়েছে। উক্ত আইনের আট ধারা অনুযায়ী আপোষ নিষ্পত্তির ক্ষমতা স্থানীয় সরকার পরিষদগুলোকে দেওয়া হয়েছে। তবে উক্ত মামলার ক্ষেত্রে পিতা অথবা মাতাকেই বাদী হয়ে মামলা করতে হবে।

যেখানে বৃদ্ধ পিতামাতাই সন্তানের কাছে জিম্মি হয়ে থাকে সেখানে থানায় কিংবা আদালতে মামলা করা অনেক সাহস ও সামর্থ্যের ব্যাপার। যার ফলে বাংলাদেশে এমন আইনের বাস্তবায়ন তেমন নজির নেই। কিন্তু গনমাধ্যমে প্রকাশ হবার পরে প্রশাসনের উদ্যোগে অনেক অত্যাচারী সন্তানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে।

লেখকঃ শিক্ষার্থী , আইন বিভাগ,
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ

Leave a Comment