আইন অনুষদের ব্যতিক্রমী আয়োজন ‘স্পোর্টস উইক’

আহসান হাবীব


‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’ একটি বাংলা প্রবাদ। ছোটবেলা থেকেই সবারই এই প্রবাদটি জানা। স্বাস্থ্য বলতে শারীরিক ও মানসিক দুই ধরণের স্বাস্থ্যকেই বোঝানো হয়েছে এই প্রবাদবাক্যটিতে। বর্তমান একঘেয়ে সমাজব্যবস্থায় এটি মেনে চলাও কষ্টকর। সমাজব্যবস্থাকে একঘেয়ে বলার কারণটি খুব স্পষ্ট। এই শিক্ষাক্ষেত্রেই দেখা যাক না কেন!

একটা চার বছরের শিশুর কাঁধে বইভর্তি একটি ব্যাগ চাপিয়ে দিলেই যেন অভিভাবকের শান্তি। অথচ এই বয়সে একটি শিশুকে তার মস্তিষ্ক বিকাশের সুযোগ দেয়া উচিৎ। তাকে পর্যাপ্ত খেলাধুলা এবং পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার অবকাশ দেয়ার সময় এটি৷ একবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই যেটি আর লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব তথা সমাজব্যবস্থাই যার মূল কারণ।

সেই চার-পাঁচ বছর বয়স থেকে একটি শিশুর ওপর যে বোঝা চাপিয়ে দেয়া শুরু হয়েছে তার শেষ হওয়ার নাম নেই। শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবন পার হয়ে গেলেও শিক্ষার্থীরা পাচ্ছেনা একটুও অবকাশ। কাজেই এ সমাজব্যবস্থাকে একঘেয়ে সমাজব্যবস্থা বলার বিকল্প নেই।

তবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শিক্ষার্থীরা আমোদ-আহ্লাদ, গল্পগুজব, খেলাধুলা করার পর্যাপ্ত সুযোগ পায়। কিন্তু তারপরেও ক্লাস,পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন, ভাইভা, পড়াশোনা মিলিয়ে তেমন একটা প্রাণ খুলে হাওয়া খাওয়ার সুযোগ খুবই কম। কিন্তু যদি এমন হতো যে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের প্রাণ খুলে খেলাধুলা, আমোদ-প্রমোদ করার সুযোগ দেয়া হলো, তাহলে কেমন হতো? অনেক ভালো, তাই না? আসলেই তাই। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাঝেমধ্যেই এধরণের আন্তঃবিভাগ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয়। এতে শিক্ষার্থীদের একে অপরের মধ্যকার বোঝাপড়াটা জোড়ালো হয়ে ওঠে।

এমনই একটি আয়োজন করেছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের আইন ও বিচার বিভাগ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রায় এক দশক অতিবাহিত হওয়ার পর ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে এই বিভাগের যাত্রা শুরু হয়। এরপর থেকে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি নানাবিধ আয়োজন ও খেলাধুলাসহ সব দিক দিয়ে আইন বিভাগ ক্যাম্পাসে সমাদৃত। আইন বিভাগের এবারের আয়োজনটি হল ‘স্পোর্টস উইক’। সপ্তাহব্যাপী এ আয়োজনটি শুরু হয়েছে গত ২৩শে ফেব্রুয়ারি।

আইন বিভাগের এই ব্যতিক্রমী আয়োজনটিতে রয়েছে নানা বিচিত্রতা। স্বাভাবিকভাবে দেখা যায় কোনো নির্দিষ্ট খেলাকে কেন্দ্র করে আয়োজিত হয় একটি টূর্ণামেন্ট অথবা এরকম কোনো আয়োজন। কিন্তু ‘স্পোর্টস উইক’-এ রয়েছে বেশ কিছু খেলার আয়োজন। ব্যাতিক্রমী এ ‘স্পোর্টস উইক’-এ দলীয় খেলা হিসেবে রয়েছে ক্রিকেট,ফুটবল,ভলিবল এবং কাবাডি। আর একক খেলা হিসেবে আছে (ছেলেদের) ব্যাডমিন্টন, দৌড় প্রতিযোগিতা, ক্যারম, দাবা, দীর্ঘলাফ, মোরগ লড়াই এবং স্মৃতি পরীক্ষা। মেয়েদের একক খেলা হিসেবে রয়েছে মিউজিক্যাল চেয়ার, মার্বেল চামচ দৌড়, বল নিক্ষেপ এবং স্মৃতি পরীক্ষা।

২৩শে ফেব্রুয়ারী (রবিবার) সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গাহি সাম্যের গান মুক্তমঞ্চ’ সংলগ্ন খেলার মাঠে পায়রা উড়িয়ে স্পোর্টস উইকের উদ্বোধন ঘোষণা করেন আইন ও বিচার বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক ইরফান আজিজ। এসময় উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্যাল ইন্সট্রাক্টর মাসুদ রানা ও আইন ও বিচার বিভাগের প্রভাষক আসাদুজ্জামান নিউটন। এসময় বিভাগীয় প্রধান ইরফান আজিজ বলেন, এবার তৃতীয়বারের মতো আয়োজিত হচ্ছে স্পোর্টস উইক। এ আয়োজন মূলত বিভাগের শিক্ষার্থীদের মাঝে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। যাতে করে বিভাগের সকল সিনিয়র-জুনিয়রের সম্পর্ক আরো দৃঢ় হয় এ লক্ষ্যেই এ আয়োজন।

সবেমাত্র ক্যাম্পাসে পা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪তম ব্যাচ৷ র‍্যাগিং নামক অসুস্থ সংস্কৃতির কবলে যখন পুরো ক্যাম্পাস তখন আইন ও বিচার বিভাগের এ চমকপ্রদ আয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। ১৪ তম ব্যাচের আইন ও বিচার বিভাগের শিক্ষার্থীরাও ক্যাম্পাসে আসা মাত্র এধরণের একটি আয়োজন পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত৷ নবীন শিক্ষার্থীরা বলছে, আইন বিভাগে ভর্তি হতে পেরে আমরা গর্বিত, আমরা ক্যাম্পাসে নতুন, ক্যাম্পাসে আসতে না আসতেই এমন একটা আয়োজন পাব কখনোই ভাবতে পারিনি। আইন বিভাগের প্রতি ভালোবাসা বেড়ে গেল, বড় ভাইয়া আপুদের প্রতি ভালোবাসা,শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। আইন বিভাগের শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ সবার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।

২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ মিলিয়ে সর্বমোট পাঁচটি ব্যাচের পাঁচটি দল গঠন করা হয়েছে। প্রত্যেক ব্যাচ থেকে প্রত্যেকটি ইভেন্টের জন্য আলাদা আলাদা দল। তবে একটি ব্যাচের দলীয় নাম একই। এই পাঁচটি দলের নামেও রয়েছে চমক। আইনের ভাষায় প্রত্যেকটি দলের নামকরণ করেছে শিক্ষার্থীরা। শেষদিন অর্থ্যাৎ বৃহস্পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারী) বিকাল সাড়ে ৪ টায় পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই ব্যতিক্রমী আয়োজনটির সমাপ্তি ঘটেছে।

দলীয় খেলাগুলোর মধ্যে ভলিবলে ২য় ব্যাচ, ছেলেদের ক্রিকেটে ১ম ব্যাচ, মেয়েদের ক্রিকেটে ৪র্থ ব্যাচ, কাবাডিতে ১ম ব্যাচ ও ফুটবলে ৪র্থ ব্যাচ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, প্রক্টর ও আইন বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের উপস্থিতিতে চ্যাম্পিচ্যাম্পিয়ম

“সামনের বার আবারও এই আয়োজন হবে, যার রেশ থাকবে আরো এক বছর। মানে, আমাদের সতেজতা চলে যাওয়ার আগেই আবারও রিচার্জ করার জন্য আয়োজিত হবে স্পোর্টস উইক”, কথাগুলো বলছিলেন আইন বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আতোয়ার রহমান। অবশ্য শুধু ‘স্পোর্টস উইক’ই নয়, কিছুদিন আগেই আইন বিভাগ আয়োজন করেছে অন্তঃবিভাগ বিতর্ক প্রতিযোগিতা যেখানে পুরো বিভাগ থেকে ৩০ টিরও বেশি দল অংশগ্রহণ করেছিল। প্রত্যেক দলে ৩ জন সদস্য ছিলেন। এছাড়াও নানা ধরণের সাংস্কৃতিক, সামাজিক কর্মকাণ্ডে আইন বিভাগ সার্বক্ষণিক সক্রিয় থাকে৷

স্পোর্টস উইক ২০২০ এর তত্বাবধানে থাকা আইন ও বিচার বিভাগের প্রভাষক আসাদুজ্জামান নিউটন সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন পুরো আয়োজন। সকাল থেকে সারাদিন শিক্ষার্থীদের সাথে কাটাচ্ছেন এই ছাত্রবান্ধব শিক্ষক। সপ্তাহব্যাপী এই আয়োজনকে সাফল্যমণ্ডিত করে তোলার পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা ছিল তাঁর দিনব্যাপী অক্লান্ত পরিশ্রম ও দিকনির্দেশনা। অল্পদিনেই শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছেন তিনি। স্পোর্টস উইক সম্পর্কে তিনি বলেন, “আইন বিভাগ একটি পরিবার। এই পরিবারে সবকিছু আছে। আছে পড়াশোনা, আছে খেলাধুলা, আছে আনন্দ-উৎসব। স্পোর্টস উইক এরকমই একটি আয়োজন। এর মাধ্যমে নতুন শিক্ষার্থীদের সাথে সিনিয়রদের মেলবন্ধনের সৃষ্টি হয়েছে। পুরো ডিপার্টমেন্টে একটি আমেজের সৃষ্টি হয়েছে। সবার কার্যকর ভূমিকায় স্পোর্টস উইক সাফল্য পেয়েছে। এভাবেই এগিয়ে যাক আইন বিভাগ এই প্রত্যাশা থাকবে সবসময়।”

আইন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর এ মেলবন্ধনের অর্ধ-দশক পার হয়ে গিয়েছে। সম্প্রতি এই বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের স্নাতক জীবনের ইতি ঘটেছে। যাদের হাত ধরে এই বিভাগের পথচলা তারা চান যেন ঘনঘন এরকম শিক্ষার্থীসুলভ আয়োজন করে শিক্ষার্থীদের চিত্তবিনোদনের সুযোগ করে দেয় আইন বিভাগ। প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী মমিনুল হাসান বলেন, আমরা কিছুদিন পরেই হয়তো ক্যাম্পাসে থাকবো না, জীবনের চাকা ঘুরতে ঘুরতে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষে নিয়ে এসেছে। আমি চাই আইন ও বিচার বিভাগের এই গৌরব, এই এগিয়ে চলা অব্যাহত থাকুক আজীবন।

আসাদুজ্জামান নিউটনের মতে যেটি ‘পুরো ডিপার্টমেন্টে আমেজের সৃষ্টি করেছে’ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে তা ‘পুরো ক্যাম্পাসে এক অনন্য নজর স্থাপন করেছে আইন অনুষদ’। বলছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী রাশেদুজ্জামান রনি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, “এই সময়টাতে ক্যাম্পাসে জুনিয়রদের আগমন ঘটেছে। নবীন শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে এসে নানা চিন্তায় থাকে, র‍্যাগিংয়ের চিন্তা আর ভয়ের কথা বলছি। ঠিক এই মুহূর্তে আইন অনুষদের এই আয়োজন থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। এতে শিক্ষার্থীদের সংকোচ-সংশয় কেটে যাবে। অনেক ভালো উদ্যোগ এটি।”


লেখকঃ শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ (৩য় বর্ষ),
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন
fb-share-icon
Tweet

এই বিভাগের আরও সংবাদ

Leave a Comment