আবু জাফর আহমেদ মুকুল
মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম
একটি গল্প বলা যাক। জার্মানির বার্লিনে একটি দেয়াল টপকানোর প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হল। বিশ্বের প্রত্যেক দেশের ৪ জন নাগরিক আমন্ত্রণ পেল। ঐ প্রতিযোগিতায় ৪জন বাঙালিও উপস্থিত হলো। প্রতিযোগিতা শুরু হল। বিশ্বের অন্যান্য দেশের নাগরিকগণ একজন আর একজনকে সহযোগিতার মাধ্যমে দেয়াল অতিক্রম করে ফেলল। রয়ে গেল ৪ জন বাঙালি।
কারণ বুঝতে পারলাম, একজন বাঙালি যখন অতিক্রম করছিল অন্য আর একজন বাঙালি পিছন থেকে তার পা টেনে ধরেছিল যাতে সে অতিক্রম করতে না পারে। সুতরাং বাঙালির স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের কারনে বাঙালিরা এগিয়ে যেতে পারে না ।
গতকাল সোস্যাল মিডিয়া ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানতে পারলাম যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক প্রবাসী বাংলাদেশি চিকিৎসক ডাঃ ফেরদৌস খন্দকার নিয়ে বাংলাদেশে তুমুল আলচনা।
বাংলাদেশে করোনার শুরুর আগ থেকে এতোদিন ইউটিউব এর মাধ্যমে অসাধারণ উপস্থাপনার মাধ্যমে ডাঃ ফেরদৌস খন্দকার এর করোনার বিভিন্ন বিষয়ে আমাদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করতেন।
এখন উনি ফ্যামিলির সকল মেম্বার রেখে বাংলাদেশে চিকিৎসা দিতে আসছেন। সে এমন কোনো অন্যায়,অপরাধ করিনি। সে দেশের মন্ত্রী এমপি কিংবা উচ্চপদে আসীন হতে চাননি। সে কোভিড-১৯ নিয়ে গত তিনমাস যুক্তরাষ্ট্রে অমানুষিক পরিশ্রম করেছে। দেশেও এসেছে দেশের মানুষের কোনো কাজে নিজেকে লাগানো যায় কিনা সেই উদ্দেশ্য নিয়ে। এই দেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় সে ডাক্তার হয়েছে। দায়িত্ববোধ থেকেই বার বার বাংলাদেশে মানুষের জন্য কাজ করে। কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে সে কখনোই আসে নাই। তাকে দেশের সবাই অভিনন্দন জানানো উচিত ছিল ।
কিন্তু এই যে, বাঙালির স্বভাব নিজে কাজটি না করতে পারলেও অন্য মানুষের পা টেনে ধরে নামাতে খুব পটু। আমরা দুঃখিত এবং লজ্জিত ডাঃ ফেরদৌসের কাছে। ডাক্তার হিসেবে তাকে আমরা প্রাপ্য সম্মান দিতে পারলাম না। কিন্তু উনি যদি ঠিকই বিদেশি ডাক্তার হতেন ঠিকই অনেকে পা চেটে বিমান বন্দর থেকে ফুলের মালা গলায় দিয়ে আসতেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিকই বলেছেন, “যদি সমাজের কাজ করতে চাও, তবে গায়ের চামড়াকে এতখানি পুরু করিয়া লইতে হইবে যেন ঝড়-ঝঞ্ঝা, নিন্দা গ্লানি, বজ্র-বিদ্যুৎ সকলই প্রতিহত হইয়া ফিরিয়া আসে”।
এর আগেও দেখেছি নোবেল বিজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনুস ও ডাঃ জাফর উল্লাহ অবদান নিয়ে টানাটানি করতে যা দুর্ভাগ্যজনক। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর কি বাংলাদেশে সকল মানুষ মারা যাবার পর কী ডাঃ জাফর উল্লাহ এর করোনা কিট অনুমোদন দিবে?এর কার্যকারীতা পরীক্ষার জন্য এতো কাল ক্ষেপণ কেনো করছে? একজন ডাক্তারকে যদি রাজনৈতিক পরিচয় দিতে হয় তা দেশ ও জাতির জন্য দুঃখজনক। এই ক্রান্তিলগ্নে করোনার প্রথম সারির যোদ্ধাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা উচিত।
ডাক্তারদের পেশাজীবি সংগঠনগুলো অতিরিক্ত রাজনীতিকরনের জন্য বাংলাদেশে ডাক্তারগণ মর্যাদা পাচ্ছে না। করোনাকালে দেখলাম আর কোন ক্যাডারের চাকুরি না গেলেও ২ জন ডাক্তারদের চাকুরি গেল। এই সব দেখেও ডাক্তারদের পেশাজীবি সংগঠনগুলো নীরব ভূমিকা পালন করছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় জানলাম, তার নামের সাথে খন্দকার থাকায় বঙ্গবন্ধুর খুনি খন্দকার মোস্তাক খন্দকার মোশতাকের ভাতিজা উপাধি দেয়া হয়েছে। আরেক খুনি রশিদের খালাতো ভাই বানানো হয়েছে। আরো বলা হয়েছে, তিনি নাকি পলাতক তারেক রহমানকে নিয়মিত টাকা পয়সা দেয়। যা শুনে আমি নিজেও ব্যথিত হয়েছি। বাংলাদেশে লাখ লাখ খন্দকার আছে তাই বলে কি লাখ লাখ খন্দকার টাইটেলধারী মানুষ কী বঙ্গবন্ধুর খুনি? পরিহাসের একটি মাত্রা থাকা উচিত। একটা স্বনামধন্য ডাক্তারকে তার পরিবার নিয়েও আমরা টানাটানি করি।
একটি বিষয় সকলের মনে রাখা উচিত ডাঃ ফেরদৌস খন্দকার ১৯৯১ সালে বিএনপি এর আমলে চট্রগ্রাম মেডিকেল কলেজে ছাত্র থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ছাত্র লীগের সৈনিক ছিলেন। ১৯৯১ সালের পর চট্টগ্রাম মেডিকেলে শিবির ছাত্রদলের তোপের মুখে ছাত্রলীগের শ্লোগান দিয়েছে। শিবিরের মা’র খেয়ে ক্যাম্পাসও তাকে ছাড়তে হয়েছিল । সে শিবিরের সাথে যুদ্ধ করে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগকে পুর্নপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই বিষয়ে তথ্য দেওয়া খুব সহজ। আপনারা চাইলেই খবর নিয়ে দেখতে পারেন। তাঁর সাথে যদি আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী এরকম আচরন করেন তাহলে সাধারন মানুষ যাবে কোথায়?
গত পরশু যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ ফ্লাইটে থেকে দেশে ফেরা ১২৮ জনের মধ্যে ডা. ফেরদৌস খন্দকারের করোনা নেগেটিভ সনদ থাকলেও তাকে ছাড়া সবাইকে হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে। উনি আসছিলেন বাংলাদেশে বিশেষত ঢাকা ও তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় করোনা রোগিদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য। অথচ সবাইকে ছেড়ে দিয়ে উনাকে পাঠানো হলো প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে। সাধারন মানুষকে বাসায় যেতে বলে একজন ডাক্তারকে আটকিয়ে কী লাভ জাতির? বরংচ উনাকে সাহায্য করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
ডা. ফেরদৌস বাংলাদেশে পৌঁছলেও তার ৮ টি স্যুটকেস এয়ারপোর্টে আটকে দেওয়া হয়েছে। করোনার মহামারীতে সে স্যুটকেস গুলোতে রয়েছে মাস্ক, গ্লাভস ও পিপিই। এসব তিনি এনেছিলেন করোনার সম্মুখ যোদ্ধাদের দিতে। দুঃখজনক হলো এয়ারপোর্টে কর্তৃপক্ষ বলেছেন, এসবের জন্য ট্যাক্স দিতে হবে, না হলে ছাড়া হবে না।” আহারে মাস্ক, গ্লাভস ও পিপিই এর জন্য মানুষ বাঁচে না আবার ট্যাক্স।
পরে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তার বক্তব্য থেকে জানতে পারলাম তা তুলে ধরলামঃ
ডাঃ ফেরদৌস খন্দকার বাড়ি কুমিল্লার দেবিদ্বারে। তাদের পূর্ব পুরুষেরাও এখানকার স্থানীয়।
১. ডা.ফেরদৌস এর মামা মোস্তাক এটা সঠিক।তবে খন্দকার মোস্তাক নয়,তার মামা এখনো জীবিত, তিনি বোস্টনে ফার্মাসিস্ট হিসেবে কর্মরত!উনি ডাঃ ফেরদৌস এর ৪র্থ মামা।উনার নানার ৭ সন্তান (৬ ছেলে আর এক মেয়ে),যার প্রথম জন মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার ছিলেন আর একমাত্র মেয়ে ডাঃ ফেরদৌস এর মা!
২.তার নামের সাথে খন্দকার আছে,এই যা!
৩. উনি দেবীদ্বার উপজেলার বাকসার গ্রামের বিমান বাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার অব: ফয়েজ খন্দকারের পুত্র।নানার বাড়ি মুরাদনগর কৃষ্ণপুর গ্রামের খান বাড়ি।নানার নাম আব্দুল আলী খান।
৪.আর,খন্দকার মোস্তাকের বাড়ি কুমিল্লা না।খন্দকার মোস্তাকের বাবা ছিলেন ফেরী ওয়ালা। তিনি কানের দুল , চুরি , ফিতা ইত্যাদি ফেরি করে বিক্রি করতেন ।এই লোকের বাড়ী ছিল ঝিনাইদহ । তিনি নারায়ণগঞ্জ থেকে মালামাল কিনে আসে পাশের উপজেলায় বিক্রি করতেন ।ফেরী করা কালিন দাউদকান্দি এসে মুস্তাকের মাকে বিয়ে করে ঘর জামাই থেকে যান ! তাই মোস্তাকের বাবার পক্ষের আত্মীয় কুমিল্লায় পাওয়া যায় না।
যে সমস্ত প্রভাবশালীরা এমন নোংরামির খেলায় মেতে উঠেছেন মনে রাখবেন ইতিহাস ক্ষমা করবেনা আপনাদের ।
রবি ঠাকুরের কথা দিয়েই শেষ করি-“রেখেছো বাঙ্গালী করে মানুষ করো নি”।
১৯৯১ সালে বিএনপি এর আমলে ছাত্র লীগ করা লোক ডাঃ ফেরদৌস। স্রোতের প্রতিকূলে রাজনীতি করা এতো সহজ নয়। আশা করি, গোয়েন্দা সংস্থা যাদের আটকানো উচিত সেই সিকদার সাহেবের দুই পুত্র তাদের খবর নেই। একজন নিরহ ও মানবতাবাদী ডাক্তারকে হয়রানী করা অত্যন্ত লজ্জাজনক। ডাঃ ফেরদৌস লজ্জিত আমরা, দেশে আমরা ডাক্তারদের সম্মান করতে পারি না।
লেখকবৃন্দঃ শিক্ষাবিদ, গবেষক , বিশ্লেষক এবং ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ।