আমাদের শিক্ষক প্রফেসর ড. নাজমুল করিম চৌধুরি : স্মৃতিচারণ, আদর্শ ও শিক্ষণীয়

আবু জাফর আহমেদ মুকুল


আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ২০২ নং ক্লাসরুমে একদিন সকাল ১১টায় বিজনেস ল ক্লাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম । ক্লাস প্রতিনিধি হিসেবে আমার দায়িত্ব থাকে প্রথম ক্লাসে বিভাগে হাজির হয়ে স্যারকে ক্লাসের বিষয়ে অবগত করা।

আমি বিভাগে স্যারকে আনার জন্য আনুমানিক সকাল ১০.৫০ মিনিটে ক্লাস রুম থেকে রওনা হতেই দেখি স্যারতো ক্লাস রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। স্যার হয়তো ভাবছে অন্যদের ক্লাস চলছে তাই হয়তো ক্লাসের বাইরে অপেক্ষা করছে।

স্যারকে সালাম দিতে বললো, আজকে প্রথম ক্লাস তাই একটু আগে হয়তো আপনাদের ক্লাসে চলে আসলাম। আমি বললাম, স্যার ঠিক আছে।

উল্লেখ্য স্যার, সবাইকে আপনি বলে সম্বোধন করতেন। তবে স্যারকে পুরো সেমিস্টারে কখনো কোন ক্লাসে দেরি করতে দেখি নাই। আমার চোখে বাস্তবে নাজমুল করিম চৌধুরি স্যার নম্র-ভদ্র ও খুবই সহজ-সরল দৃষ্টি ভঙ্গির এবং ভরাট কণ্ঠের একজন মানুষ। মোটা চশমার ফাঁকে একজন বুদ্ধিজীবী ভাবও ছিল স্যারের। তিনি সর্বদা ফরম্যাল ড্রেস পরতেন এবং স্যারের কথায় চৌধুরির পরিবারের একটি আভিজাত্যের প্রকাশ পেত। এমনকি আমাদের বিভাগের সবচেয়ে ভদ্র ও নমনীয় ব্যক্তি হিসেবে স্যার আমাদের কাছে বেশি পরিচিত ছিল।

বিজনেস ল ক্লাস অনেক বোরিং কোর্স বলে প্রতি ক্লাসে ১৫-২০ জন শিক্ষার্থী ২০২ নং ক্লাসরুমের পেছনের দরজা দিয়ে বাইরে চলে যেত। স্যার অতিশয় ভদ্র বলে দেখে না দেখার ভান করতো। আর বাকি যারা ক্লাসে থাকতাম স্যারের ক্লাসের সহজভাবে ক্লাস বুঝার চেষ্টা করতাম। তবে সত্যি কথা বলতে কী স্যারের নম্রতা ও ভদ্রতা আমাদের মুগ্ধ করতো। উনি নোয়াখালীতে জন্মগ্রহণ করলেও তার কথায় কোন বিন্দুমাত্র আঞ্চলিকতা ছিল না।

একদিন ক্লাসে কথা প্রসঙ্গে প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন স্যার বললো- প্রফেসর ড. নাজমুল করিম চৌধুরি আমারও স্যার। আমরা সবাই অবাক হলাম, আমরা ভাবতাম মহিউদ্দিন স্যারের বয়স হয়তো বেশি। অবশ্য নাজমুল করিম স্যারের বয়স বোঝা যায় না। স্যারের ক্লাসের পর মৌচাকে ভার্সিটি কোচিং সেন্টারে আমার ক্লাস থাকতো।

একদিন স্যারের ক্লাস শেষ করে তাড়াহুড়া করে নীচতলায় নামছি। সালাম দিতে স্যার এগিয়ে এসে বললেন, কোথায় যাবেন? আমি বললাম, স্যার মৌচাক যাবো। স্যার বললেন আমি ঔ পথে যাব, আপনি গাড়ীতে ওঠেন। আমি আপনাকে ড্রপ করে দিতে পারবো। আমি বললাম, না স্যার ঠিক আছে। আমি রিকশায় চলে যেতে পারবো। স্যার বললো আপনি গাড়ীতে উঠেন, সমস্যা নাই। অবশেষে স্যার গাড়ী করে আমাকে মৌচাকে নামিয়ে দিলেন।

আর মৌচাক যেতে পথে বেইলি রোড থেকে একটি লাঞ্চ প্যাকেট কিনে রাখলেন গাড়িতে। আমি ভাবছিলাম, এটা মনে হয় স্যারের বাসার জন্য কিনেছেন। পরে গাড়ী থেকে নামার সময় আমাকে হাতে লাঞ্চ প্যাকেটটি ধরিয়ে দিলেন এবং বললেন আপনি যেহেতু ক্লাস নিবেন সুতরাং লাঞ্চ করে ক্লাস নিয়েন। আমি মুগ্ধতার চোখে স্যারের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এ যেন আমার বাবার হাতের স্নিগ্ধতা ও ভালবাসার পরশ।

প্রফেসর ড. নাজমুল করিম স্যার একজন শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক, আইনজীবী, উপদেষ্টা, ধর্মপরায়ণ ও মানবিক চেতনার অসাধারণ গুণী ব্যক্তি। ১৯৪৯ সালের ১৫ নভেম্বর নোয়াখালী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন প্রফেসর ড. নাজমুল করিম চৌধুরী। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যানেজমেন্টে অনার্স ও ১৯৭০ সালে মাস্টার্স, ১৯৭২ সালে এলএলবি ডিগ্রি এবং ১৯৮৪ সালে বেলজিয়ামের ব্রাসেলস ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেন তিনি। তার শিক্ষকতা জীবন শুরু ঢাকা কলেজে ১৯৭২ সালে। ১৯৭৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগে যোগ দেন। ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ইএমবিএ প্রোগ্রামের পরিচালক ছিলেন তিনি।

মাঝখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নিয়ে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দায় এক দশকের বেশি সময় কাজ করেছেন। ২০১৪ সালে উত্তরা ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। ২০১৬ সালের অগাস্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়ে তিনি ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। নাজমুল করিম চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ছিলেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির অনারারি ট্রেজারারসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন।

স্যারের সাথে আমার সর্বশেষ দেখা হয়েছিল মার্চ ১২, ২০২০ইং বিকাল ৫টায় বনানীর ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে তাঁর অফিসে যেই ছবিটি আমার ছাত্র অর্পণ বড়াল তুলেছেন। কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিজনেস স্কুলের ডিন প্রফেসর ড. নজরুল ইসলাম স্যারের সাথে দেখা করতে যেয়ে আমার একটু দেরি হলেও নাজমুল করিম স্যার আমার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন।

প্রথম দেখাতে সালাম দিতে স্যার বললো, করোনার কারণে এখন কারো সাথে হ্যান্ডসেক করছি না। বাসায়ও মিসেসকে বলে দিয়েছি বাইরে থেকে খাবার যাতে না আনা হয়। স্যারকে সচেতন দেখে আমার কাছেও খুবই ভাল লাগছিল। স্যার বললো তাঁর নাতিরা আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে এসেছে তাদের সাথে খুব ভাল সময় কাটছে। ওদেরকে আগে খুব মিস করা হত এখন খুব আনন্দের মধ্যে রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তার কিছু পরিকল্পনা কথাও বললেন।

কথা প্রসঙ্গে বললো, আগামী মার্চ ১৭, ২০২০ইং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সিলেকশন বোর্ডে যাব। স্যারকে বললাম আমার পরিচিত একজন ম্যানেজমেন্টের সহকর্মী রয়েছে ফাতেমা সে আপনাকে রিসিভ করবে। পরে অবশ্য ফাতেমাকে স্যারের নাম্বার দিয়েছিলাম স্যারকে রিসিভ করার জন্য। স্যার তার সৌখিনতার কথা বললো আমাকে সে যেখানে যায় ঔখান থেকে কিছু নিয়ে আসে।

সেইদিনও স্যার আমাকে নিজে রুম থেকে বেড়িয়ে লিফট পর্যন্ত এগিয়ে দেন যা বর্তমানে কোন ভিসির কাছে থেকে পাওয়া বিরল ঘটনা। এটা নিয়ে আমি সেদিন আমার ফেসবুকে এই ছবিটিসহ পোস্টও করেছিলাম। প্রকৃতপক্ষে আমার কাছে সব সময় মনে হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের থেকে তার ১ম প্রতিষ্ঠান পরিবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যার উজ্জ্বল উদাহরণ স্যার নিজেই।

সত্যি বলতে কী তখনকার এক মুহূর্তে আমার মনে হয়নি স্যার মে ৭, ২০২০ইং করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাবেন। তিনি একজন খ্যাতিমান শিক্ষক ছিলেন। তার এমন মৃত্যু আমাদের সবাইকে ভীষণভাবে ব্যথিত করেছে। আমরা স্যারের মাগফেরাত কামনা করছি। আশা করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট পরিবার উনার অবদান শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে ।

ম্যানেজমেন্টের মোস্ট জেন্টলম্যান হিসেবে পরিচিত স্যার যেখানে থাকুক ভাল থাকবেন এবং বিশ্বাস করি পরকালে একজন ধর্মপরায়ণ ও মানবিক লোক হিসেবে মহান আল্লাহতায়াল আপনাকে জান্নাতবাসী করবেন।


লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ম্যানেজমেন্ট এন্ড ফাইন্যান্স বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *