আমার দেখা বশেমুরবিপ্রবির সাংবাদিকতা!

মো. রায়হানুল ইসলাম সৈকত


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরবিপ্রবি)। গোপালগঞ্জের এই বিশ্ববিদ্যালয়টির অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চলছে গত এক দশক ধরে।

বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাংবাদিকতা যেন এক অনিবার্য নিয়ামক। প্রায় প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার নজির রয়েছে বাংলাদেশে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দল না থাকলেও সেখানে সাংবাদিকতা এবং তার সংগঠন দেখা যায়।

তবে ‘সাংবাদিকতা’ এবং ‘রাজনীতি’ দুটো আলাদা বিষয়। গণতন্ত্র এবং দেশকে সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যেমন সুস্থ রাজনীতির প্রয়োজন আছে, তেমনি একটি ভালো সমাজ বিনির্মাণে একজন দক্ষ সাংবাদিক সমাজের দর্পণ হিসেবে কাজ করেন।

দেখা যায় সাংবাদিকতা সাধারণত রাজনৈতিক দলের বলয়মুক্ত থাকে। অর্থাৎ কেউ যদি সাংবাদিকতা করেন তাহলে নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশনের জন্য তাকে রাজনৈতিক দল মুক্ত থাকতে হয়। এই হচ্ছে রাজনীতি এবং সাংবাদিকতার বিষয়ে মোদ্দাকথা।

এবার মূল কথায় ফিরে আসি। বঙ্গবন্ধুর পুণ্যভূমির এই ৫৫ একরের ক্যাম্পাসে বর্তমানে সাংবাদিক সমিতি, প্রেসক্লাব, রিপোর্টার্স ইউনিটি ও সাংবাদিক ফোরাম নামের চারটি সাংবাদিক সংগঠন রয়েছে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুধু সাংবাদিক সমিতির অনুমোদন রয়েছে। বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এতগুলো সাংবাদিক সংগঠন রয়েছে কিনা সন্দেহ আছে।

৫৫ একরের এই ছোট ক্যাম্পাসে এতগুলো সাংবাদিক সংগঠনের প্রয়োজন আছে? এই প্রশ্ন শুধু এই ক্যাম্পাসে নয়, বাংলাদেশের প্রায়শই ক্যাম্পাস থেকে করা হয়। এই প্রশ্নের উত্তরের আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়ে কিছু কথা বলা যায়।

পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) নামের এই একটি দল ছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে এই একটি দল ভেঙে প্রায় তিনটি উপদল তৈরি হয়। এছাড়া আরও কয়েকটি উপদল সেখানে রয়েছে। এতগুলো দল তৈরির পরে শুরু হয় নিজেদের মধ্যে সহিংসতা। এক দলের লোক অন্য দলের লোককে হত্যা করছে প্রতিনিয়ত।

এছাড়া বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড তো লেগেই আছে। ফলে বলা যায়, এই ভাঙন কখনই তাদের জন্য ভালো ছিলো না। এদিকে এই ভাঙনের পিছনে নিরাপত্তা বাহিনীর বড় ধরনের মদদ রয়েছে বলে অভিযোগ আছে।

ঠিক তেমনি ২০১৯ সালের অক্টোবর-নভেম্বর পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সাংবাদিক সংগঠন ছিলো। যদিও কয়েকটি সংগঠন দাবি করেন তাদের প্রতিষ্ঠা অনেক আগে হয়েছে। কিন্তু সে বিষয়ে তেমন কোন দালিলিক ভিত্তি নেই। ছোট ক্যাম্পাসে এতগুলো সাংবাদিক সংগঠন তৈরির পিছনেও কতিপয় শিক্ষকের মদদ রয়েছে বলে অভিযোগ আছে।

এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলের এজেন্ট হয়ে সাংবাদিকতা করার অভিযোগ আছে। অভিযোগ আছে দুর্নীতি করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে নিজের শক্ত অবস্থান তৈরি করার জন্য সাংবাদিকতা পেশাকে বেছে নেয়ার। তবে এসব অভিযোগ যদি সত্য হয় সেক্ষেত্রে অন্যান্য সাংবাদিকদের জন্য বিষয়টি বেশ চ্যালেঞ্জের। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের আস্থা হারিয়ে যেতে পারে সাংবাদিকতার উপরে। যদি তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো মিথ্যা হয় তাহলে সে বিষয় সম্পর্কে অভিযুক্তদের পরিস্কার বক্তব্য দেয়া উচিত।

একজন সাংবাদিক হিসেবে আমার মনে হয় কোন প্রশ্নবিদ্ধ মানুষের সাংবাদিকতা করা উচিত না। এটি একটি মহান পেশা। কতিপয় মানুষের জন্য এটি কলঙ্কিত হতে পারে না।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সংগঠন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের দলগুলোর মধ্যে একটা মিল আছে। সেটি হলো নিজেদের মধ্যে কোন্দল। সহসাই দেখা যায় ৫৫ একরের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিক সংগঠনের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব হয়। এটি যেমন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট করে তেমনি সাংবাদিকতার মতো মহান পেশাটাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে কিছু বলা জরুরী। একজন সাংবাদিক হিসেবে আমার মনে হয় সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে একজন সাংবাদিকের উচিত সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকা। কিন্তু এসমস্ত সাংবাদিক সংগঠনের মধ্যে কয়েকটি সংগঠনকে দেখা যায় একটি নির্দিষ্ট মহলের হয়ে কাজ করতে। এটি আমাদের জন্য লজ্জার।

এই ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সময়ে সত্য প্রকাশের কারণে সাংবাদিকদের বিপদের মুখে পড়তে হয়েছে। কিন্তু সেই বিপদের সময়ে বর্তমানে সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দেয়া অনেকে পাশে এসে দাঁড়ায়নি। বরং সেসময়ে অনেককে রাজনৈতিক দলের ব্যানারে সত্য প্রকাশ করে বিপদে পড়া সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সক্রিয় হতে দেখা গেছে।

সত্য প্রকাশ করার কারণে অনেক সাংবাদিককে বিভন্ন সময়ে জামাত-শিবির অপবাদসহ বহিষ্কারের দাবিতে মিছিল করা অনেকেই এখন নিজেকে সাংবাদিক বলে পরিচয় দেন বশেমুরবিপ্রবিতে।৫৫ একরের এই ছোট ক্যাম্পাসে এতগুলো সাংবাদিক সংগঠনের প্রয়োজন আছে কিনা- এই প্রশ্নের বিষয়ে এখন কিছু বলা যেতে পারে।

দুর্বৃত্তায়ন ও নিজেদের দুর্বলতা আড়াল করার জন্য যদি কেউ সাংবাদিকতা এবং সংগঠন করে থাকেন তাহলে সেটি বাদ দেয়া উচিত। সত্য প্রকাশ করে কোন সাংবাদিক বিপদে পড়লে তার পাশে সকলে দাঁড়াতে না পারলে সংগঠনের কোন প্রয়োজন নেই। নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়ার জন্য এসব সংগঠনের দরকার নেই।

সাংবাদিকতার চর্চা না করে শুধু সংগঠনের সংখ্যা বাড়ানো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আশঙ্কার বিষয়। আর প্রকৃতপক্ষে সাংবাদিকতা করার ইচ্ছা থাকলে সংগঠনের সংখ্যা না বাড়িয়ে এমনকি সংগঠন না করেও সাংবাদিকতার চর্চা করা যায়। একজন সাংবাদিক যদি সত্যের পথে থাকে তাহলে তাকে আটকে রাখার সাধ্য কারো নেই এবং দিনশেষে সকলেই তার পাশে এসে দাঁড়ায়।

আমাদের উচিত সংগঠনের চর্চা ভুলে গিয়ে সাংবাদিকতার চর্চা করা। সত্যের পথে থাকা, সকলের সাথে সহযোগিতামূলক আচরণ করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে যদি একাধিক সংগঠন প্রয়োজন হয় তাহলে সেটি অবশ্যই করা যেতে পারে কিন্তু সকলে এক হয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা অন্যরকম।

ভিন্ন নামে নয় ‘আমি সত্যের পথের পথিক, আমি সাংবাদিক’ এই হোক আমার পরিচয়।


লেখক: শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় করোসপন্ডেন্ট, দৈনিক ইত্তেফাক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *