আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না

অনিল মোঃ মোমিন


১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট ওয়াশিংটন ডিসিতে মার্টিন লুথার কিং ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন, “কিন্তু ১০০ বছর পর মর্মান্তিক সত্য হচ্ছে, কৃষ্ণাঙ্গরা আজও মুক্ত নয়। শতবর্ষ পরও কৃষ্ণাঙ্গরা আজও দুঃখজনক ভাবে বিচ্ছিন্নতার শেকলে আর বৈষম্যের জিঞ্জিরে বাঁধা।

শতবর্ষ পরও কৃষ্ণাঙ্গদের জীবন যেন ধন-সম্পদের বিরাট সমুদ্রের মাঝখানে এক নিঃসঙ্গ দারিদ্রের দ্বীপ। শতবর্ষ পরও কৃষ্ণাঙ্গরা মার্কিন সমাজের এক কোণে নির্জীব দশায় পড়ে আছে, হয়ে আছে নিজভূমে নির্বাসিত। তাই আজ আমরা এখানে আমাদের দুর্দশাকে তুলে ধরতে এসেছি।”

তার ঠিক ৫৫ বছর এখন পুরো আমেরিকা জুড়ে মার্টিন লুথারের সেই বক্তব্যেরই পুনরাবৃত্তি করতে বুঝি আবালবৃদ্ধ বনিতা এখন রাজপথে নেমে এসেছে। I can’t breathe! Please! পৃথিবী জুড়ে এখন এর চেয়ে আলোচিত আরর আবেদনময় বাক্য একটাও নেই।

জর্জ ফ্লয়েড নি:শ্বাস না নিতে পেরে কাতরাচ্ছেন এবং বারবার একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারকে বলছিলেন, “আমি নি:শ্বাস নিতে পারছি না”।

একজন সাধারণ কৃষাঙ্গ ফ্লয়েড নিতান্তই চা-পোষা মানুষ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সে সিগারেট কিনে ২০ ডলারের একটি জাল নোট দিয়েছেন দোকানিকে। এই অভিযোগে শেতাঙ্গ পুলিশ ফ্লয়েডকে গ্রেফতার করে হাতকড়া পড়ায় । পুলিশের গাড়িতে সে উঠতে না চাইলে একজন পুলিশ অফিসার তার হাঁটু দিয়ে জর্জ ফ্লয়েডের গলা চেপে ধরে।

কাতরাতে কাতরাতে ফ্লয়েড বলতে থাকে আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। কিন্তু পুলিশ সদস্যদের তাতে কোন কর্ণপাত হয়নি। একপর্যায়ে ফ্লয়েড শ্বাসরোধে মারা যায়। মৃত্যুর পরেও পুলিশ তার গলা চেপে ধরে রেখেছিল। ভিডিও ক্লিপটি দেখে হতবাক হয়ে অশ্রু নিবারণ করেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না।

৪৬ বছর বয়সী বেচারা জর্জ ফ্লয়েড মিনিয়াপোলিস অঙ্গরাজ্যের একটি রেস্তোরাঁয় নিরাপত্তা কর্মী হিসাবে কাজ করতেন । দীর্ঘাকায় ও সুঠাম-দেহের অধিকারী ফ্লয়েড করোনা ভাইরাসের কারণে চাকুরী হারিয়ে কিছুটা কঠিন দিন যাপন করছিলেন বলে তার বন্ধুরা জানিয়েছে ।

২৫ মে’র এই নির্মম,মর্মান্তিক ঘটনায় বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে পুরো আমেরিকা। তবে এই একটি মৃত্যুই কিন্তু আমেরিকাকে আজ এতোটা উত্তাল করে দেয়নি। বরং বর্ণ বিদ্বেষের যাঁতাকলে ফ্লয়েড যে শুধু নতুন যুক্ত আরেকটি নাম সেটা অাবারও দৃশ্যমান। শেতাঙ্গদের কাছে কৃষ্ণাঙ্গরা বরাবরই অবহেলিত আর উপেক্ষিত। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, শতাব্দীর পর শতাব্দী শুধু চামড়ার রঙের জন্য সাদাদের নোংরা কটূক্তি শুনে এসেছে তারা যুক্তরাষ্ট্রে।

২০২০ সালে এসেও কথায় কথায় কালোদের জন্য রাখা থাকে নোংরা গালিগালাজ। ব্ল্যাক, নিগ্রো, স্লেভ শব্দগুলো গা সওয়া হয়ে গেছে। ল্যাটিন আমেরিকান স্ল্যাং শব্দগুলো যেন কালো মানুষদের ডাকনাম। শেতাঙ্গদের কাছে কালো মানুষ মানেই নোংরা, গরিব, শয়তান এবং হিংস্র।ফলে সময়ে সময়ে মূল্যও কম দিতে হয়নি কালো মানুষদের।

ওয়াশিংটন পোস্টের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে আমেরিকায় পুলিশের গুলিতে মারা গেছে ১০১৪ জন এবং বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে আমেরিকায় পুলিশের গুলিতে নিহতদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে বেশিরভাগই কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান।

তবে জর্জ ফ্লয়েড এখন কোন সাধারণ নাম নয়; এক দূর্দমনীয় দূর্বার আন্দোলনের নাম। নতুন করে বর্ণবৈষম্যের একটা প্রতীক হয়ে উঠেছেন জর্জ ফ্লয়েড। পুরো আমেরিকা জুড়ে মানুষ রাস্তায় এসে দাড়িয়েছে। স্লোগান দিচ্ছে ‘ সে দ্যা নেম- জর্জ ফ্লয়েড’। প্ল্যাকার্ডে শোভা পাচ্ছে ‘I can’t breathe ‘।

আমেরিকা ছাড়াও বিশ্বজুড়ে যেখানে যত কালো মানুষ আছে প্রত্যেকে আজ একজন জর্জ ফ্লয়েড। টানা ৮ম দিনেও যে ধরনের সহিংস প্রতিবাদ, বিক্ষোভ চলছে তেমনটা গত কয়েক দশকে দেখা যায়নি। দেশটির ৭৫টি র বেশি শহরে এখন পর্যন্ত বিক্ষোভ হয়েছে। ৪০টির অধিক শহরে বিক্ষোভকারীদের দমাতে কারফিউ জারি করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কঠোর হচ্ছেন। জনগন ভ্রুক্ষেপ করছে না।

বরং তার হুমকি ধামকি ওদের অরো প্রতিবাদী করে তুলছে। অনেকে বলছেন যুক্তরাষ্ট্রের এবারের দাঙ্গা ১৯৬৮ সালে মার্টিন লুথার কিংয়ের মৃত্যু পরবর্তী সহিংসতার চেয়ে বেশি মারাত্মক।

করোনা-ভাইরাসে মৃত্যুতে শীর্ষে থাকা দেশটির জনগন করোনা ভাইরাস, কারফিউ অগ্রাহ্য করে আন্দোলন অনড়। আস্তে আস্তে এই আন্দোলন বিশ্বব্যাপী ছড়াতে শুরু করেছে।

বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ, ক্রিয়াঙ্গনের সেলিব্রেটিরা, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গুলো সবাই বর্ণ বৈষ্যমের নিন্দা করে আন্দোলনকারী সমর্থন জানাচ্ছেন। স্থায়ী পরিবর্তন কি আসবে? সময় বলে দিবে। তবে মার্টিন লুথার কিং, নেলসন ম্যান্ডেলা আমৃত্যু বর্ণবৈষম্য, সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে লড়াই করে গেলেও এখন ফ্লয়েড শিকার হয়েছেন।

বিশ্বজুড়ে অসংখ্য মানুষ শিকার। আশা করি আমেরিকান বসন্ত বর্ণবৈষম্য দূর করতে ফলপ্রসু ভূমিকা রাখবে। তবে বাকি সব বৈষম্যের বেড়াজাল থেকে আমাদের মুক্তি মিলবে কি না তা কেউই জানি না। বৈষম্যের ঐশ্বর্যে আমরাও শ্বাস নিতে পারছি না মি. ফ্লয়েড। সত্যি বলছি আমরা শ্বাসও নিতে পারি না; অক্সিজেন মাস্কে নিঃশ্বাস ফেলে বেঁচে আছি। জর্জ ফ্লয়েডের আত্মা শান্তি পাক।


লেখকঃ শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ

Leave a Comment