উচ্চ শিক্ষায় অবহেলার ৫০ বছর: শিক্ষার্থীরা অধিকার বঞ্চিত (পর্ব-৩)

আবু জাফর আহমেদ মুকুল


ক্ষমতাবান শ্রেণী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। সেই কারনে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্য প্রমাণিত। সুতরাং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি সফল কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়। এর কারণ এই সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্য ছাত্রদের ব্যবহার করে রাজনৈতিক ক্ষমতায় টিকে থাকার এই উদ্দেশ্যে শিক্ষকবৃন্দের ভূমিকা রয়েছে।

নিজেদের পদ-পদবির উন্নতি সন্ধান করতে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে দল করে যেমন লাল, সাদা, নীল ইত্যাদি। এই প্রক্রিয়ার সবলতম প্রমাণ হচ্ছে ভিসি পদের চাকুরির জন্য দলের লোক বসানোর মধ্যে।

বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করাটাই প্রধান উদ্দেশ্য, লেখাপড়া বা জ্ঞানচর্চা নয়। যে বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজন সেটা তৈরি হয়নি কারণ না আছে গবেষণা করার আগ্রহ, না আছে পরিবেশ, না আছে প্রয়োজন। দুই একজন তো নিশ্চয় নিরবে নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছেন কিন্তু তারা তো একটা গোটা ব্যবস্থার প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র এহসান রফিকের ওপর নির্যাতনের বিচার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে একটি চিঠি লিখেছিলেন তার বাবা। চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন ভবিষ্যতে যেন আর কোনো বাবাকে তার সন্তানকে এভাবে নির্যাতিত হতে দেখতে না হয়। এহসান রফিকের বাবার ভাগ্য ভালো যে, তার সন্তান প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছিল হল থেকে। কিন্তু বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরারের বাবাকে বহন করতে হয়েছে সন্তানের লাশ।

দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হল প্রশাসন অকার্যকর হওয়ায় একের পর এক ঘটছে এ ধরনের মর্মান্তিক আর শোকাবহ ঘটনা। হল প্রশাসনের ব্যর্থতার কারণে যুগের পর যুগ নেতাকর্মীদের হাতে মেধাবী অনেক শিক্ষার্থীর ওপর চলছে অমানবিক নির্যাতন। দেশসেরা মেধাবী সন্তানেরা দেশসেরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর তাদের অনেককে শিকার হতে হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, লাঞ্ছনা আর অবমাননার।

গত অক্টোবরে বুয়েটের ছাত্র আবরার হত্যার পর হলগুলোতে গণরুম, গেস্টরুম ও পলিটিক্যাল রুম সংস্কৃতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলে। সে সময়কার আলোচনায় অনেকটাই মনে হয়েছিল, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এটি একটি বড়সড় পরিবর্তনের সূচনা করবে। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিছুটা নড়েচড়ে ওঠে। দফায় দফায় মিটিং করে বহিরাগত ও হলে বসবাস করার অধিকারহীন শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু এগুলো শুধু নোটিশ বোর্ডের বিষয়। খুব যে কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে বলে আমরা স্বস্তি প্রকাশ করব, এমন কিছুই হয়নি।

ছাত্রসংগঠনের নেতা কর্মী তথা এলাকার সিনিয়র ছাত্ররা সত্যিকারার্থে আবাসিক হলের রাজা বাদশা যেখানে প্রভোস্ট হলো নিস্ক্রিয় দর্শক। আর হল দখলে নেয়ার পর প্রতিপক্ষ ছাত্রসংগঠনের কাউকে চিহ্নিত করতে পারলে তাদেরকে হল থেকে বের করে দেয়া, পিটিয়ে হাত- পা ভেঙে দেয়া, বিছানাপত্র পুড়িয়ে দেয়া, কখনো কখনো বন্দুকযুদ্ধ আর হত্যার মতো ঘটনা ঘটছে। কখনো কখনো ছাত্রসংগঠনের নিজেদের মধ্যে মারামারিতেও হত্যার ঘটনা ঘটে।

বিশিষ্টজন বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে ‘গবেষণা সেল’ থাকার কথা, সেখানে টর্চার সেলের এই ভয়াবহতা সমগ্র জাতির জন্য লজ্জা এবং পরিতাপের।

তারেক বাড়ি ছেড়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকায় আসে ২০১৮ সালে। এখন সে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় বর্ষের ছাত্র। দু’বছর ধরে সে গণরুমে গাদাগাদি করে থাকে। চারজনের একটি কক্ষে থাকছেন ২০ থেকে ২৫ শিক্ষার্থী। এ হলে অনেকেই ঘুমান পালা করে। কেউ ঘুমান রাতে আর কেউ দিনে। একদিক থেকে সে ভাগ্যবান। কারণ কেউ কেউ গণরুমেও আশ্রয় পায় না। তাদের কেউ থাকে খোলা বারান্দায়, কেউ বা মসজিদে। পড়ে কখনও লাইব্রেরি, কখনও হলের রিডিং রুমে, কখনও বিভাগের সেমিনার রুমে – আর কোথাও জায়গা না পেলে নিজের বিছানার উপর বসে বসে। কবে সিট পাবে তা সে জানে না। না পেলে তার করারও কিছু নেই। এই উপায়েই তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকে থাকতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ঘূর্ণিঝড়ের সময় খোলা সাময়িক আশ্রয়কেন্দ্র নয়। ছাত্ররা এখানে আশ্রয় চাইতে আসেনি। এখানে সিট পাওয়া তার অধিকার। কিন্তু ব্যাপারটা অবস্থাদৃষ্টে এখন একরকম আশ্রয়কেন্দ্র হয়েই দাঁড়িয়েছে।

একটা ঘুমাবার বিছানা ও একটা পড়ার টেবিল, মোটামুটি চলা যায় এমন একটা ঘর – এর বাইরে কোন বিলাসিতা আশা করে না দূর-দূরান্ত থেকে পড়তে আসা তারেকদের মতো ছাত্ররা। কিন্তু বাস্তব চিত্র খুবই করুণ। পত্রিকায় এ নিয়ে খবর এসেছে, ছবি এসেছে। হাজতিদের মতো হলের ডাইনিং, টিভি রুম, মসজিদে লাইন দিয়ে শুয়ে আছে ছাত্ররা। এই রুমগুলো পেলে ভাল, অনেক জায়গায় রুম না পেয়ে তাদের আশ্রয় নিতে হয় হলের বারান্দাতে। লাইন দিয়ে খোলা বারান্দাতে সারিবদ্ধভাবে শুয়ে আছে ছাত্ররা; সেখানে রোদ আসছে, বৃষ্টি আসছে, শীত আসছে। দুই সিঁড়ির সংযোগস্থলের ফাঁকা জায়গায় চেয়ার-টেবিল পেতে পড়তে বসেছে ছাত্ররা কিংবা বারান্দার কোণে পেতেছে চেয়ার-টেবিল – এ চিত্রও বিরল নয়।

একটি লেখায় এই সংকটের পুরোটা তুলে ধরা অসম্ভব। হলের খাবারের গুণগত মান নিয়ে এক দীর্ঘ আলোচনা হতে পারে। আলোচনা হতে পারে হলগুলোর স্যানিটেশন নিয়ে – যেখানে এক একটা ফ্লোরের দুপাশের ৬/৮ টি বাথরুমে শত শত ছাত্র যাতায়াত করে। দুজনের রুমে ৮ জন গাদাগাদি করে কোনরকমে শুতে পারে, কিন্তু বাথরুমের ক্ষেত্রে সে নিয়ম খাটে না।

ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর চিত্র আজ অনেকটা রিফিউজি ক্যাম্পের মতো। দেশের যারা ভবিষ্যৎ, যারা চিন্তা করবে, লিখবে, পথ দেখাবে, নেতৃত্ব দেবে, সাহিত্যিক-শিল্পী-বিজ্ঞানী-শিক্ষক-প্রশাসক হবে তাদের প্রতিদিনের জীবনযাপন চলে এই যুদ্ধের মধ্যে। এই যুদ্ধ চিন্তা করার কোন অবসর রাখে কি? এই ভাবনাই সে প্রতিনিয়ত তৈরি করতে থাকে যে, কবে দুটো পয়সা রোজগার করব, একটু ভাল থাকব, এই দুঃসহ জীবন থেকে মুক্তি পাব।

আবাসন সংকটের কারণে শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী মেস কিংবা বাসা ভাড়া করে থাকতে হয়। এসব মেস ও বাসাগুলোতে পরিবেশ নিম্নমানের, প্রতিনিয়ত লোডশেডিং এবং ন্যূনতম সুবিধা না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

দেশের প্রায় সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই অভিন্ন চিত্র। ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৮-এর তথ্যমতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ৩৭ হাজার ৯৮৪ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৫ হাজার ৭৫ জন শিক্ষার্থী বিভিন্নভাবে আবাসিক হলে থাকছেন। শতকরা হিসেবে ৬৬ শতাংশ শিক্ষার্থী আবাসন সুবিধা পাচ্ছেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন সুবিধা রয়েছে মাত্র ৩৬ শতাংশ শিক্ষার্থীর। এছাড়া বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটে ৩৬ শতাংশ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭ শতাংশ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০ শতাংশ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০ শতাংশ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩২ শতাংশ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ শতাংশ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬ শতাংশ, মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ২ শতাংশ শিক্ষার্থীর আবাসন সুবিধা রয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর জন্য কোনো আবাসন সুবিধাই নেই।

একইভাবে শিক্ষার্থীদের আবাসনের জন্য কোনো হল নেই বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়েও। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আড়াই হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন মেসে থাকছেন। রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ হাজার ৫৩ শিক্ষার্থীর বিপরীতে আবাসিক হলগুলোতে আসন আছে মাত্র ১ হাজার ৩৯ জনের।ফলে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীকে নির্ভরশীল হতে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন এলাকার মেসগুলোর ওপর। ইউজিসি প্রতিবেদনের তথ্যমতে মাত্র ১২ শতাংশ শিক্ষার্থীর আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এছাড়া জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬ শতাংশ। সবমিলে দেশের ৪০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র ৩৬ শতাংশ শিক্ষার্থীর আবাসন সুবিধা রয়েছে। বাকি ৬৪ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রীই এ সুবিধার বাইরে রয়ে গেছেন।

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন এমিরিটাস অধ্যাপককে চিনি । যিনি জীবনে তিন (৩) বার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হবার অফার প্রত্যাখান করেছিলেন। তৎকালীন এরশাদ সরকারের আমলে দুই ( ২)বার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হবার অফার প্রত্যাখান করেছিলেন। সরকারের পক্ষ থেকে এ প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন স্বয়ং তৎকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টা। স্যারের কাছে কারন জিজ্ঞাস করতে বলেছিলেন,” আমি উপাচার্য হয়ে এসির হাওয়া খাবো আর আমার ছাত্ররা হলে কষ্টে থাকবে। এটা আমি নিজেই ব্যক্তিগতভাবে মেনে নিতে পারছি না।”পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে আওয়ামি লীগ সরকারের আমলে একইভাবে (এক) ১ বার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তাঁর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি সত্যিই অসাধারন যা বর্তমানে বাংলাদেশে খুবই বিরল ঘটনা।

জানা গেছে, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্ (বিইউপি) ছাত্রদের জন্যে কোনো নিজস্ব ফোরাম নেই, নেই কোনো কোন দলীয় নেতা, কোনো দলের স্বার্থন্বেষী কার্যক্রম নেই, নেই কোন সেসন জট। উপস্থিতি নেই টেন্ডারবাজিরও। অস্ত্রের ঝংকার তো দূরে থাক রক্তের বিভীষিকাও নেই। ছাত্র রাজনীতি না থাকার পরও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্ (বিইউপি) স্ব-গৌরবে নিজেদের প্রকাশ করে চলছে বছরের পর বছর। তবে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের ক্যারিয়ার ক্লাবগুলো খুবই কার্যকর এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্লাবগুলোকে নিয়মিত পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এছাড়া দেশের সব বিশ্ববিদ্যলয়কে পেছনে ফেলে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্ (বিইউপি) উদ্ভাবনী ক্যাটাগরিতেও শীর্ষে উঠে এসেছে। সুতরাং অন্য সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত গুনগত উচ্চ শিক্ষার মানের জন্য এই দুইটি বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামো ও ম্যানেজমেন্টকে অনুসরন করা।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নামে মাত্র একটি মেডিক্যাল সেন্টার রয়েছে। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর জন্য নাম মাত্র একজন ডাক্তার। কোনো ওষুধ দেয়া হয় না। জরুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য নেই যন্ত্রপাতি। এছাড়া রোগী ভর্তি রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিন যাবৎ বন্ধ ছাত্র সংসদের নির্বাচন না হলেও এ খাতে টাকা আদায় করা হয়েছে। নিয়মিত সমাবর্তনের হয় না বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। অথচ এর চেয়েও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকটের পাশাপাশি নিম্নমানের খাবার সরবারহ, সরকার দলীয় রাজনীতির থেকেও আঞ্চলিক রাজনীতির ছাত্র নেতৃত্বের প্রভাব, জুনিয়র ছাত্রদের মিছিল-মিটিং বাধ্য করা, ক্লাসে সিনিয়র ছাত্রদের প্রভাবে ক্লাস ও পরীক্ষায় অংশগ্রহন না করা, মুখস্থ নির্ভর পড়াশুনা, নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্লাসরুম ও শিক্ষক সংকট, পরিবহন ও লাইব্রেরী সংকট, উন্নত মানের ল্যাবের অভাব, সেসন জট ও ফলাফল প্রকাশে বিলম্ব, প্রশ্নপত্র, পরীক্ষা ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন পদ্ধতির মডারেশন নেই, ইন্ডাস্ট্রি সাথে ছাত্রদের গ্যাপ বেশি, আদিম কালের নোটপত্র বিতরন, ডিজিটাল প্রযুক্তির কম ব্যবহার, ক্লাসে প্রয়োগিক ও গবেষণাধর্মী জ্ঞানের বাস্তবায়ন কম, বীমার প্রচলন নেই, ক্যারিয়ার ক্লাবগুলো পরিচালনার জন্য আর্থিক সংকট, একাডেমিক কাউন্সিলের নামে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অতিরিক্ত কোর্স ক্রেডিট চাপানো, শিক্ষা লোনের প্রচলন নেই এবং একাডেমিক কাজে কিছু শিক্ষক ও ছাত্রদের পরিশ্রমের মধ্যে সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। তবে এটি সত্যি যে, বাংলাদেশের বাইরে কোন বিশ্ববিদ্যালয় দেখা যায় না যেখানে এই সকল সমস্যা নিয়ে কথা হয় না। এ সকল সমস্যা নেই তাদের ওইখানে। বরংচ একাডেমিক এবং গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত তারা এবং এ বিষয়ে তাদের মধ্যে কথা হয় বেশি।

আমাদের শিক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা কী শিখল বা না শিখল, তারচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে একশ’ নম্বরের মধ্যে কত নম্বর পেল সেটি। বিষয়টি আমরা স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কালচারে পরিণত করে ফেলেছি যা খুবই দুঃখজনক বিষয়। এভাবে আসলে উচ্চ শিক্ষার মান নির্ধারন হয় না। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক দিন পরে একাডেমিক কাউন্সিল হয় যার ফলে অনেক সময় ছাত্ররা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই প্রত্যেকটি অনুষদের বিষয়ের ভিন্নতা থাকায় একাডেমিক কাউন্সিলের পরিবর্তে ফ্যাকাল্টি এক্সেকিউটিভে কাউন্সিল করে সমস্যার সমাধান দ্রুত করা যেতে পারে এবং মান সম্মত উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে।

আমি একবার সকাল ৯টায় ক্লাশ রুমে লক্ষ্য করলাম কিছু ছাত্র সবসময় অনুপস্থিত থাকে। ক্লাসের বাইরে তাদের জিজ্ঞাস করলাম তারা কেন সকালের ক্লাস ধরতে পারে না? কিছু কিছু ছাত্রের ক্লাসে না আসার কারণগুলো ছিল ভীষণ অদ্ভুত। তাদের সরল স্বীকারোক্তি, রাতে ফেসবুক, ইউটিউব, নেটফ্লিক্স আর পাবজি নিয়ে তাদের বড় সময় কাটে, ঘুমাতে ঘুমাতে রাত গভীর হয়ে যায়। ফলে সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারে না। আর ক্লাসে এলেও মনোযোগ বসাতে পারে না। আমরা কি তাহলে তবে একটা গ্যাজেট আর ফেসবুক মহামারিতে আক্রান্ত দিবা স্বপ্নচারী জাতিতে পরিণত হচ্ছি? আরও কিছু ছাত্রের উত্তর ছিল বেশ ভয়ংকর। তারা রাজনীতি করে এবং তাদের বড় ভাইদের দেখে এসেছে কিংবা শুনে এসেছে পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য বিশেষ অনুমতি জোগাড় করা যায় সহজেই।

তবে একটি দিক থেকে আজকাল ছাত্রদের স্ট্রেস কম, হলের ছাত্ররা সকলে সরকার দলীয় রাজনীতি করেন যা আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খুবই বিরল ঘটনা ছিল। তবে শুধুমাত্র কেউ যদি সিনিয়রদের কথা না শুনে তাহলে অন্য দল বলে চাপানো হয় যা হিংসাত্বক। আজকাল ছাত্র রাজনীতি দেখে মনে হয় বিএনপি সরকারের আমলে আমরা যারা ছাত্র লীগ সমর্থন করেছি সে কি স্ট্রেস ছিল? স্রোতের প্রতিকূলে টিকে থাকলেও আমাদের ছাত্র জীবনে সাহস ও আনন্দ ছিল।

শিক্ষাবিদরা মনে করেন, দেশের যে কোন সঙ্কট উত্তরণে নেতৃত্ব দেয়ার কথা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। কিন্তু প্রযুক্তির ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে এসব বিশ্ববিদ্যালয় অনেক পিছিয়ে। যদিও এখন এবং আগামী দিন হচ্ছে প্রযুক্তির। আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়ার দরকার ছিল, এখনো সময় আছে। যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইচ্ছা করে শতভাগ না হলেও ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে অনলাইনের আওতায় আনতে পারবে এবং শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে। শিক্ষকগণের সদিচ্ছা থাকলে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য অনলাইন থিউরি ও প্রাকটিক্যাল ক্লাস এবং পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব। বুয়েট ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্ (বিইউপি) অনলাইন কার্যক্রমের উৎকৃষ্ট উদাহরন। আর কিছু কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আচরণ দেখে মনে হয়েছে এরা সব কিছু থাকার পরও শপথ নিয়েছে কখনো অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষায় যাবে না যা সত্যিই খুবই দুঃখজনক।

৪র্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা অর্জনের জন্য দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মান সম্মত উচ্চ শিক্ষা প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষা মান সম্মত না পেলে জাতীগতভাবে সুশিক্ষিত ও দক্ষ জনগোষ্ঠী সৃষ্টি হবে না। এভাবে অবহেলায় পড়ে থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বছরের পর বছর। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতি মনোযোগী না হলে তারা ধীরে ধীরে দেশের সব ধরনের চাকরি-বাকরি, নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়া থেকে হারিয়ে যাবে। দেশে তৈরি হবে বেকার গ্রাজুয়েট ও সামাজিক অস্থিরতা। আর দেশ হারাবে তার খেটে খাওয়া মানুষদের সন্তানদের, সত্যিকারের দেশপ্রেমিকদের। সকল ধরনের সহযোগিতার জন্য সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের মধ্যে সেতু বন্ধন খুবই প্রয়োজন বলে বিশ্বাস করি।

তবুও এখানে টিকে আছে নেতৃত্ব, বেঁচে আছে আশার প্রদীপ। এখানকার ছাত্ররা স্বপ্ন দেখে সুন্দর আগামীর, স্বপ্ন দেখায় সুন্দর আগামীর বাংলাদেশের। অবশেষে আমার প্রিয় কবি সুকান্ত ভট্রাচার্যের ছাড়পত্র’ কবিতার দুটি লাইন দিয়ে সকল পক্ষকে দায়িত্বশীল হবার জন্য অনুরোধ করছিঃ

বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি—
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।


লেখকঃ শিক্ষাবিদ, গবেষক, বিশ্লেষক ও ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ এবং সহকারী অধ্যাপক, ম্যানেজমেন্ট এন্ড ফাইন্যান্স বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *