একজন উপাচার্য কেমন হওয়া উচিত?
একজন উপাচার্য কেমন হওয়া উচিত??
নাসির উদ্দীন: হিদেই ওহনো। আমার বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট। বাংলাদেশের কন্টেক্সটে উপাচার্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ভবনের কাছেই আমার ল্যাব। এজন্য প্রায় প্রতিদিনই উনার ভবনের চারপাশে হাটাহাটি করা হয়। নিজের প্রয়োজনে উনার ল্যাবের অন্য একজন প্রফেসরকে মেইল করতে গিয়ে উনাকে মেইল করেছিলাম।
উনি আমার প্রয়োজন বুঝতে পেরে সে মেইল যথোপযুক্ত মানুষের কাছে ফরওয়ার্ড করেছিলেন। তারপরে জানতে পারি উনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট। ল্যাবের অন্য একজন সহকর্মীর কাছে জানতে পেরেছিলাম উনি নাকি ফিজিক্সে নোবেল পেতে পারেন।
আগ্রহ নিয়ে উনার ল্যাব ওয়েবসাইট, গুগল স্কলার ইত্যাদিতে ঢুঁকে উনাকে একটু পড়তে চেষ্টা করেছিলাম। জাপানের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি টোকিও ইউনিভার্সিটিতে অনার্স, মাস্টার্স ও পিএইচডি করেছেন।
আমেরিকার কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে ভিসিটিং গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট ছিলেন। হোক্কাইডো ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেছেন। তারপর থেকে তহকু ইউনিভার্সিটিতে ন্যানোইলেকট্রনিক্স ও স্পিনট্রোনিক্স ল্যাবের দায়িত্ব নিয়ে এখনও কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। যা দেখলাম তাতে বুঝতে পারলাম উনি নিজ ফিল্ডে বিশ্বের হাতেগোনা কয়েকজন সেরা গবেষকের একজন।
গুগল স্কলারে উনার সর্বোচ্চ সাইটেড আর্টিকেলটি প্রায় ১০০০০ বার সাইট হয়েছে। বিশ্বসেরা অনেক গবেষকের টোটাল সাইটেশনও উনার মাত্র একটি আর্টিকেলের সাইটেশনের চেয়েও কম থাকে।
২০১৯ সালে বিশ্বের ২১৬ জন হাইলি সাইটেড রিসার্চারের মধ্যে উনি একজন ছিলেন। প্রেসিডেন্ট অবস্থাতেই গত বছরে উনার প্রায় ২০ টিরও বেশি আন্তর্জাতিক প্রকাশনা প্রকাশিত হয়েছে। ২০১১ সালে স্পিনট্রনিক্সে কাজের জন্য উনি নোবেলের জন্য পসিবল ক্যান্ডিডেট লিস্টে ছিলেন।
উনার বিল্ডিংয়ের সামনে অতিরিক্ত মানুষ বা গাড়ির আনাগোনা নেই। বের হয়ে যাওয়ার সময় ১০/২০ জনের চাটুকার গ্রুপের উপস্তিতিও থাকেনা।
উপরের বাস্তব গল্প বললাম দেশের উপাচার্য দের সাথে একটু তুলনামূলক বিবেচনা করার জন্য। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে যে যত বড় পজিশনে তার একাডেমিক ক্যারিয়ার ততই নিচে। অতিরিক্ত রাজনীতি করে একাডেমিককে নষ্ট করে ফেলেছেন।
একবার দেশের কিছু উপাচার্যের রিসার্চগেট আর গুগল স্কলারের প্রোফাইল খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম। ২/৩ জন ছাড়া বেশিরভাগেরই পাইনি।দেখাযায়, অনেক উপাচার্যের লাস্ট ভালো একটা আর্টিকেল ১০/১৫ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে। অথচ দেশে বহু স্কলার গবেষক আছেন যাদেরকে এসব পদে দেয়া হয় না।
একজন উপাচার্যের নিজের ফিল্ডে দারুণ স্কলার হওয়া উচিত। নিজের একাডেমিক দক্ষতার প্রতি নিজের বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা না থাকলে অন্যান্য সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের জন্য কখোনোই সে রোল মডেল হতে পারবেন না। উনাকে নিজেকে বাকিদের কাছে উদাহরণ তৈরি করতে হবে। উনি গবেষক না হয়ে বাকিদের কোন লজ্জায় উনি গবেষনায় উতসাহ দেবেন?
একজন উপাচার্যের বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে অগাধ জ্ঞ্যান থাকা উচিত। তার অধীনস্থ ডিন, পরিচালক বা বিভাগের হেড দের সঠিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার মত উনার জ্ঞ্যানের পরিধি থাকা উচিত।
তৃতীয়ত, একজন ইন্সপাইরিং লিডার হওয়া উচিত যার মাধ্যমে উনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল স্টেকহোল্ডারদের (প্রফেসর-প্রভাষক থেকে মালি পর্যন্ত) কাছে সম্মানের সাথে সকল বিষয়াদি ডিল করতে পারেন। দৃঢ়তা নিয়ে কমান্ড করতে পারার যোগ্যতা থাকা উচিত। সবার কথা মন দিয়ে শোনার ও উপদেশ নেয়ার মত মানসিকতা থাকা উচিত।
একজন উপাচার্যের উনার নিজের সীমাবদ্ধতা নিয়ে সম্যক জ্ঞ্যান থাকা উচিত। ভালো সেন্স অফ হিউমার থাকা উচিত। বৈশ্বিক চিন্তা করে লোকালি ইম্পলিমেন্ট করার দক্ষতা থাকা উচিত।ধৈর্যশীল হওয়া উচিত। চালাক নয় বরং জ্ঞ্যানি হওয়া উচিত। সর্বশেষ, একজন ভালো মানুষ হওয়া উচিত।
আমরা র্যাংকিং নিয়ে কথা বলি অথচ র্যাংকিং এ ভালো করার জন্য প্রয়োজনীয় নিয়ামকগুলো নিয়ে কথা বলিনা। উপাচার্য নিয়োগের বর্তমান পদ্ধতির পরিবর্তন হওয়া আবশ্যক। ভালো একাডেমিসিয়ানের সাথে উপরোক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষের হাতে দায়িত্ব দিলে অবস্থার উন্নতি হবে বলে আমার বিশ্বাস।
এ দায়িত্ব পালন করতে হবে ইমানের সাথে। শিক্ষা ও গবেষনায় দেশকে এগিয়ে নিতে হলে যোগ্য লোকের হাতে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ভার থাকা আবশ্যক।
লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরবিপ্রবি) ও পিএইচডি গবেষক তহকু ইউনিভার্সিটি, জাপান।