একটি আত্মহত্যা

 নুর ইসলাম আলিফ


রাফী চোখ খুলতেই দেখল কয়েকজন মানুষ তার মুখের দিকে ঝুঁকে আছে। রাফীকে চোখ খুলতে দেখে তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করল, ‘এইতো চোখ খুলেছে।’

রাফী ধড়মড় করে উঠে বসতেই মানুষগুলো একটু দূরে সরে দাঁড়াল। রাফী অবাক হলো এটা দেখে যে সে অচেনা একটা জায়গায় কাদা-পানিতে শুয়ে আছে। রাফী বুঝতে পারছে না সে এখানে কীভাবে আসলো। এই লোকগুলোই বা কে। এদের কাউকে কখনো কোথাও সে দেখেছে বলে মনে হচ্ছে না।

লোকগুলোর মধ্য থেকে মাঝবয়সী এক লোক কিছুটা এগিয়ে এসে রাফীকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার নাম কী?’
‘রাফী। কিন্তু আপনারা কারা? আমি এখানে কীভাবে আসলাম?’
‘আপনার কিছু মনে নেই?’
‘না। কিছুই মনে করতে পারছি না।’
‘আচ্ছা। প্রথম প্রথম এমন হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে সব মনে পড়ে যাবে।’
‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘আপনি আত্মহত্যা করেছেন।’
‘কিহ্!’
‘হ্যাঁ… মনে করার চেষ্টা করুন। সব মনে পড়ে যাবে।’

রাফীর মনে পড়েছে। রাতে ঘুমানোর আগে সে একসাথে বারোটা ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল। মরার জন্য। তাহলে কী সে সত্যি মরে গেছে? রাফী ভীত কণ্ঠে লোকটার কাছে জানতে চাইলো, ‘আমি কী মরে গেছি?’

‘মরে না গেলে এখানে আসার কথা না। এখানে যাদের দেখছেন সবাই মৃত। সবাই আত্মহত্যা করেছে।’

লোকটার কথা রাফীর বিশ্বাস হচ্ছে না। কী আবোল-তাবোল বলছে লোকটা। আশেপাশে যাদের দেখছে সবাইকে জলজ্যান্ত বলেই মনে হচ্ছে। রাফী দাঁড়িয়ে হাঁটতে গিয়ে লক্ষ্য করল তার এক পা শেকল দিয়ে বাঁধা। রাফী পা থেকে শেকল খুলার চেষ্টা করতে লাগল। রাফীকে শেকল খুলার চেষ্টা করতে দেখে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা বলল, ‘লাভ নেই। ওটা খুলবে না।’
রাফী ঢোক গিলে বলল, ‘আমি বাসায় যাব।’

রাফীর পেছন থেকে এক মহিলার কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘এইখানে আইলে আর ফেরত যাওন যায় না। অখন থেইক্যা এইখানেই থাকা লাগব। ঘুম নাই, খানা-পিনা নাই, হাগা-মুতা নাই, দিন রাইত নাই।

মহিলার কথা শুনে রাফী চোখ বন্ধ করল। মনে মনে বলল, ‘যা ঘটছে এসব একটা দুঃস্বপ্ন মাত্র। ঘুম ভাঙলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’

মাঝবয়সী লোকটা রাফীর কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘ভয় পাচ্ছেন?’
রাফী বিড়বিড় করে বলল, ‘আমি বাসায় যাব।’

‘প্রথম প্রথম আমারো অনেক ভয় করত। এখনো ভয় করে তবে অভ্যস্থ হয়ে গেছি। আপনারো অভ্যেস হয়ে যাবে।’
‘আমি এখানে থাকব না।’
‘থাকব না বললে তো হবে না। আপনি এখানে থাকতে বাধ্য। যত তাড়াতাড়ি বিষয়টাকে মেনে নিবেন। ভয়টা তত তাড়াতাড়ি কমে যাবে।’

রাফীর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা রাফীর সামনে এসে কৌতুহলি কণ্ঠে বলল, ‘আপনি মরলেন ক্যান? ক্যামতে মরছিলেন? আমি জমাইয়ের লগে ঝগড়া কইরা ফাঁস নিছিলাম।’
মাঝবয়সী লোকটা ধমকের স্বরে মহিলাকে বলল, ‘আহা এসব কথা পরে হবে। কোন কথা কখন বলতে হয় সেই জ্ঞানটুকুও দেখছি এতদিনে আপনার হলো না।’

রাফীর কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে বলল, ‘আপনি কিছুক্ষণ একা থাকুন। কথা বলতে চাইলে ডাকবেন। আমরা এখানেই আছি।

কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পরে রাফী মাঝবয়সী লোকটাকে ডাকল, ‘এই যে ভাই এদিকে একটু আসবেন?’
লোকটা রাফীর কাছে এসে বলল, ‘বলুন।’
‘এটা কী পরকাল?’ রাফী জানতে চাইলো।
লোকটা কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘তা তো জানি না।’
‘আপনিও কি সুইসাইড করেছিলেন?’
‘জ্বী।’
‘কেন?’
‘শুনবেন?’
‘আপনার বলতে আপত্তি না থাকলে শুনব।’

‘তাহলে শুরু থেকেই বলি। আমার নাম গাজীউল হক। সংক্ষেপে গাজী। অনেকে হক সাহেব বলেও ডাকত। ফার্নিচারের ব্যবসা করতাম। বউ বাচ্চা নিয়ে সুখেই ছিলাম। আমার দুই মেয়ে, সাফা-সারাহ্। জমজ। আমার সমস্যা শুরু হয় যেদিন প্রথম বন্ধুদের সাথে ক্লাবে যাই। শখের বসে তাশ খেলেছিলাম সেদিন। প্রথম দিনেই পাঁচ হাজার টাকা জিতলাম।

তখনকার দিনে পাঁচ হাজার টাকাই অনেক। লোভ পেয়ে গেল আমার। এরপর নিয়মিত ক্লাবে যেতে শুরু করলাম। কখনো জিততাম কখনো হারতাম। ধীরে ধীরে ব্যবসায় লস হতে লাগল। কারণ সারাটাক্ষণ ক্লাবে পড়ে থাকতাম অথবা কোনো জুয়াড়ির আড্ডায়। সুলতানা বিষয়টা জানতে পেরে বাচ্চাদের মাথায় হাত রেখে ওয়াদা করালো যাতে এসব ছেড়ে দেই। আমি ওয়াদা করলাম। কিন্তু ওয়াদা রাখতে পারলাম না। মাস না পেরুতেই আবার ক্লাবে গিয়ে হাজির হলাম।

সুলতানা জানতে পেরে কান্নাকাটি করে বাচ্চাদের নিয়ে ভাইয়ের বাসায় চলে গেল।’ কথাগুলো বলে গাজীউল হক থামলেন।‘তারপর?’ গাজীউল হককে চুপ করতে দেখে রাফী প্রশ্ন করল।

‘ব্যবসায়ের সব টাকা নষ্ট করলাম। ধার দেনায় ডুবে গেলাম। সুলতানাকে বললাম তার ভাইদের কাছ থেকে কিছু টাকা এনে দিতে। কিন্তু সুলতানার ভাইয়েরা টাকা দিবে কোথা থেকে। তাদের নিজেদেরই নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। এদিকে পাওনাদারেরা হুমকি ধামকি দিকে লাগল। আমার কাছে টাকা থাকলে তবেই না দিব। এক পর্যায়ে স্ত্রী কন্যাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ভয় দেখাতে লাগল। আমি বুঝতে পারলাম যে সমস্যায় জড়িয়েছি সে সমস্যা সমাধানের আমার কোনো উপায় নেই।

একদিন খুব সকালে গোসল করে সুলতানার উপহার দেয়া শার্টটা পড়ে সুলতানার বাসায় উপস্থিত হলাম। মেয়ে দুটো দৌড়ে এসে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অনেকদিন পরে দেখায় সুলতানা দূরে দাঁড়িয়ে আঁচলে চোখ মুছল। আমি দেরি করলাম না। সেখান থেকে বেড়িয়ে আসলাম। বাচ্চাগুলো কিছুতেই ছাড়তে চাচ্ছিল না।’

গাজীউল হকের চোখ ছলছল করছে। গাজীউল হক ধরা গলায় বলল, ‘রাস্তার অপর পাশ থেকে ছুঁটে আসা ট্রাকের নিচে বাইকসহ চাপা পড়লাম। সবাই জানল দুর্ঘটনা। কিন্তু কীভাবে যেন সত্যটা সুলতানা বুঝতে পেরেছিল। তারপর থেকেই আমি এখানে।’

গাজীউল হকের কথা শুনে কী বলা উচিত রাফী ভেবে পেল না। নীরবতা ভাঙল ওই কৌতুহলি মহিলা। দু’পা এগিয়ে এসে বলল, ‘আমার কাহিনীটা কই। আমি তুলুর মা। আমার শাশুড়ী একখান দজ্জাল মহিলা। সারাদিন খ্যাঁচখ্যাঁচ করত। একদিন আমার বাপ-মারে নিয়া খারাপ কথা কইতাছিল। সহ্য করতে না পাইরা কথা জবাব দিলাম। ঝগড়া লাইগা গেল। রাইতে তুলুর বাপ দোকান থেকে আসার পরে শাশুড়ি আমারে নিয়া আজেবাজে কথা কইল। আমি নাকি তাকে মাগী বইলা গালি দিছি। বিশ্বাস করেন ভাইজান। আমি ওই গালি দেই নাই। তুলুর বাপে রাগ সামলাইতে না পাইরা আমারে থাপ্পড় দিল। সেইদিন পরথম তুলুর বাপ আমারে মারছিল। আমি বাড়ির পেছনের আমগাছে ফাঁস নিলাম। ফাঁসটা যখন গলায় চাইপা ধরল তখন ভাবলাম আহারে রাগের মাথাত কী ভুলটাই না করছি। অখনো আফসুস হয়। জানেন ভাইজান তুলুর বাপে অখনো বিয়া শাদি করে নাই।’

‘আপনি কীভাবে জানলেন তিনি এখনো বিয়ে করেনি?’ রাফী তুলুর মায়ের কাছে জানতে চাইল।

‘মাঝে মাঝে আমাগোরে এইখান থেইক্কা ছাইড়া দেয়। দুনিয়ায় যাইয়া ঘুইরা আসি।’ তুলুর মা জবাব দিল।
‘তাই নাকি?’
‘প্রত্যেকের মৃত্যু বার্ষিকীতে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।’ অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা বলল।

রাফী লক্ষ্য করল মেয়েটা বেশ রূপবতী। বয়স কতো হবে উনিশ-কুড়ি। রাফী মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি কেন সুইসাইড করেছিলেন?’

মেয়েটা রাফীর কথার জবাব দিল না। একটু দূরে সরে দাঁড়াল। তুলুর মা রাফীর একটু কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, ‘বিয়ার আগেই পেট হইছিল। পোলার কাছে গেছিল। পোলা সাফ কইয়া দিছে বিয়া করব না। বিষ খাইছিল। লজ্জার কথা তো হেল্লাইগা কাউরে কইবার চায় না। আমি মেয়ে মানুষ তাই আমারে কইছিল।’
‘নাম কী তার?’
‘শাকীলা।’
‘আচ্ছা।’

কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে তুলুর মা হাতের ইশারায় পনেরো-ষোলো বছরের একটা মেয়েকে দেখিয়ে দিয়ে বলল, ‘ওরে দেখেন। অর নাম হাফসা। পরীক্ষায় ফেল কইরা ফুরাটন খাইয়া মরছে। পরীক্ষায় ফেল কইরা কেউ মরে কন? ক্লাস ফাইভে দুইবার ফেল করছিলাম। আব্বায় মারছিল। কই তাও তো তখন মরি নাই। একটা মজার জিনিস দ্যাখবেন?’

তুলুর মায়ের কথা শুনে রাফী কিছুটা অবাক হলো। এই অবস্থায়ও মানুষ মজার কথা বলতে পারে। রাফীর জবাবের অপেক্ষা না করে তুলুর মা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক লোককে ডেকে বলল, ‘ভাইজান আপনি জানি ক্যামতে মরছিলেন?’

লোকটা তুলুর মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে অন্যদিকে মুখ করে তাকাল। তুলুর মা হেসে ফিসফিস বলল, ‘বেডায় মাতাল। ভেজাল মদ খাইয়া মরছিল…

কথা বলতে বলতে সবাই চুপ হয়ে গেল। সবার দৃষ্টি শাকীলা মেয়েটার পায়ের দিকে। অন্যদের দেখাদেখি রাফীও শাকীলার পায়ের দিকে তাকাল। শাকীলার পায়ের শেকল খোলা। রাফী গাজীউল হকের কাছে জানতে চাইলো।

গাজীউল হক বলল, ‘আজ তার মৃত্যুবার্ষিকী।আজ চাইলেই সে পৃথিবীতে গিয়ে আপন মানুষদের দেখে আসতে পারবে।’

বেশকিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পরে রাফী বলল, ‘কী ব্যাপার সে যাচ্ছে না কেন?’
‘সে এখন আর যায় না। এখানেই থাকে, কান্নাকাটি করে।’
‘কেন?’
‘প্রথমবার যখন সে গিয়েছিল তখন দেখেছিল তার বাবা মা তার জন্য কতো কান্নাকাটি করে। যেই ছেলেটা তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল সেই ছেলেটা বিয়ে করে সুখে সংসার করছে। সে এসব মেনে নিতে পারে না বলেই যায় না।’
‘আপনি যান?’

‘হ্যাঁ যাই। মেয়ে দুটোকে দেখতে যাই। এখন তারা কলেজে পড়ে। জানেন খুব খারাপ লাগে। মনে হয় যদি সেদিন ওই ভুলটা না করতাম তাহলে রোজ মেয়ে দুটোকে কলেজ পৌঁছে দিতে পারতাম। সুলতানার সাথে পঁচা মাছ কেনা নিয়ে ঝগড়া করতে পারতাম। মেয়েদুটো তখন কার পক্ষ নিতো জানতে ইচ্ছে করে।’

রাফী শাকীলার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘আপনি যাবেন না?’

শাকীলা রাফীর দিকে না তাকিয়েই বলল, ‘না।’
কিছুক্ষণ চুপ থেকে শাকীলা জানতে চাইলো, ‘আচ্ছা আপনি এ কাজ কেন করলেন?’
‘বিষয়টা কিছুটা আপনার মতো।’
‘আমার মতো মানে? আমার কী হয়েছিল জানেন আপনি?’
‘জ্বী জানি। তুলুর মায়ের কাছে শুনেছি।’
‘ও…’
‘জ্বী…’
‘আপনার ঘটনাটা কী?’

‘এক মেয়ের সাথে প্রায় সাত বছরের সম্পর্ক ছিল। গত কয়েক মাস যাবদ সম্পর্কটা ভালো যাচ্ছিল না। ছোট ছোট বিষয়ে ঝগড়া হতো। সবসময় দোষটা নিজের ঘাড়ে নিয়ে ঝগড়া মেটাতাম। তাকে হারানোর ভয়ে তার প্রত্যেক কথায় সম্মতি জানাতাম। তবুও সম্পর্কটা টিকলো না। সে আমাকে চায় না বুঝেও অবুঝের মতো তার কাছে বারবার যেতাম। সে বারবার অপমান করে ফিরিয়ে দিত। অনেক বেশি ডিপ্রেসড হয়ে পড়ি। তাকে ছাড়া জীবন অর্থহীন মনে হতো। যখন তাকে অন্যকারো সাথে দেখলাম তখন আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না। যে কয়েকটা ঘুমের ওষুধ পেয়েছি খেয়ে ফেলেছি। ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ হয়ে আসলো। যখন চোখ খুললাম তখন আমি এখানে।’
‘অনেক বড় ভুল করেছেন।’
‘হ্যাঁ সেটা এখন বুঝতে পারছি।’

কথোপকথনের এক পর্যায়ে বিকট একটা শব্দ হলো। মুহূর্তেই শাকীলার চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ ফুটে উঠল। কিছু বুঝে ওঠার আগে রাফী দেখল গাজীউল হককে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কে টানছে তাকে দেখা যাচ্ছে না। শুধু বুঝা যাচ্ছে। কেউ একজন প্রবল শক্তি দিয়ে শেকল টানছে। গাজীউল হক হাত দিয়ে কাদামাটি আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না। গাজীউল হককে টানতে টানতে একটা গর্তে নিয়ে গেল। ভয়ে রাফীর গলা শুকিয়ে গেল। ভীত কণ্ঠে শাকীলাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তাকে কোথায় নিয়ে গেল?’

কিছুক্ষণ চুপ থেকে খানিকটা স্বাভাবিক হয়ে শাকীলা বলল, ‘সঠিক জানি না। তবে আমার ধারণা আমরা একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পৃথিবীতে আসি। আত্মহত্যা করে সেই সময়ের আগে পৃথিবী ত্যাগ করি বলেই আমাদের এখানে রাখা হয়। মাঝে মাঝে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেয়া হয় দেখার জন্য আমরা কী ভুলটা করেছি। আর যখন পৃথিবীতে থাকার নির্দিষ্ট সময়টা শেষ হয় তখন আমাদের এখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয়।’

‘কোথায়?’
‘তা তো জানি না। তবে মনে হয় জায়গাটা এখানকার থেকেও ভয়ংকর।… কথাগুলো বলতে বলতে শাকীলা বলল, ‘একী! পানি বাড়ছে কেন? এমন তো আগে কখনো হয়নি।’

রাফী লক্ষ্য করল দ্রুত পানি বাড়ছে। কয়েক সেকেন্ডে পানি বেড়ে হাটু, হাটু থেকে কোমড়, কোমড় থেকে নাক অবদি, তারপর চারপাশে পানি আর পানি। পাশেই শাকীলাকে আবছা দেখা যাচ্ছে। রাফীর দম বন্ধ হয়ে আসছে।

শ্বাসরুদ্ধকর এক অবস্থায় রাফী চোখ খুলল। সিলিং ফ্যানটা থেমে আছে। ঘরটা অন্ধকার। ভাঙা জানালার ফাঁক দিয়ে অল্প আলো আসছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। পুরো শরীর যেন অবশ হয়ে আছে। অনেক কষ্টে রাফী উঠে বসল। টেবিলের ওপর রাখা জগে মুখ লাগিয়ে পানি খেল। পানি খাওয়ার সময় মুখের দুপাশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানি দিয়ে রাফীর পরনের শার্টটা ভিজে গেল। পানি খেয়েই রাফী জানালা খুলল। সে নিজের রুমেই আছে। তাহলে এতক্ষণ যা দেখেছে সব কী স্বপ্ন ছিল? নিজেকে প্রশ্ন করল রাফী। তার কেমন ভয় ভয় করছে। রাফী বাসা থেকে বাইরে রাস্তায় চলে আসলো।

তার মাথা শরীর কেমন দুলছে। হয়তো ওষুধের রিএ্যাকশনের কারণে। রাফী আর হাঁটতে পারছে না। একটা টং দোকানের বেঞ্চে বসল।

অনেকক্ষণ সেখানেই বসে থাকল। দু’কাপ রঙ চা খেল। এখন কিছুটা ভালো লাগছে। রাফীর মনে হলো অনেক বড় একটা ভুল করতে গিয়েও সে বেঁচে গেছে। রাফী সিদ্ধান্ত নিলো এ শহরে সে আর থাকবে না। দূরে কোথাও চলে যাবে। নতুন করে শুরু করবে। সবকিছু শেষ করে দেয়ার চেয়ে নতুন করে শুরু করাটা ভালো। রাফী রাস্তায় নেমে আসলো। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। হুট করে গা ঘেঁষে একটা রিকশা থামল। হুট তোলা রিকশা থেকে একটা মেয়ে নেমে এসে রাফীকে ধরল। না ধরলে নিশ্চই রাফী পড়ে যেত।

মেয়েটাকে রাফীর কেমন চেনা চেনা লাগছে। রাফীর হাত ধরে মেয়েটা রাফীতে রিকশায় তুলল। রাফীর প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়ার আগে রাফী শুনতে পেল কেউ একজন মায়া মাখা কণ্ঠে বলছে, ‘আপনি ঠিক আছেন তো? কী হয়েছে আপনার?’ কণ্ঠটা চেনা চেনা লাগছে রাফীর কিন্তু নামটা মনে পড়ছে না। মেয়েটার কাঁধে মাথা রেখে রাফী ঘুমিয়ে পড়ল। দুটো কোমল হাত রাফীকে শক্ত করে ধরে রেখেছে।

লেখা –

নূর ইসলাম আলিফ

শিক্ষার্থী ব্যবস্থাপনা বিভাগ,

মকবুলার রহমান সরকারি কলেজ।

Scroll to Top