একটি হুলস্থুল প্রেমের উপন্যাসের প্লট

ইশরাত মেহজেবিন তিহা


সন্ধ্যা থেকে বসে আছি । এখন রাত ৯.৩০টা । দেড় প্যাকেট সিগারেট খাওয়া শেষ । পোড়া টুকরো গুলো ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে ।

সন্ধ্যা থেকে একটা লাইনও লিখতে পারিনি। একটু লিখছি আর ঘ্যাসঘ্যাস করে পৃষ্ঠা টেনে ছিঁড়ে ফেলছি। মনের মতো প্লট আসছে না মাথায় । লিখতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, অথচ না লিখলে পেটে খাবার জুটবে না ।

সাড়ে দশটার দিকে পাশের ঝুপড়ি হোটেল থেকে খাবার আসবে । হোটেলের নাম “The Luncheon” । এই নাম রেখেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছেলে । মালিকের নাম – আব্দুল কুদ্দুস । হোটেলে আমার মাস করা হিসেব । টাকা হাতে থাকলে অগ্রিম মাসের টাকাও মিটিয়ে দেই, আবার হাত খালি থাকলে মাসে – দু’মাসেও বিল পরিশোধ করতে পারি না । দু’মাসের বেশি হয়ে গেলে আব্দুল কুদ্দুস সাহেবের দেখা পাওয়া যায় । তিনি খাবার পৌঁছে দেওয়া লোকটার সঙ্গে আসেন।

তবে সেটারও একটা নিয়ম আছে । দুই মাস পার হয়ে গেলে তৃতীয় মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার রাতে খাবার নিয়ে আসা লোকটার সঙ্গে তিনি আসেন । এসে একটা সিগারেট ধরান, কথাবার্তা বলেন । ঘড়ি ধরা ঠিক পনেরো মিনিট তিনি থাকেন । এরপর উঠে চলে যান ।

আজ বৃহস্পতিবার । আমার হিসেব মতে, গত দু’মাসে হোটেলের বিল ক্লিয়ার করা হয়নি । তো আজকে আব্দুল কুদ্দুস সাহেবের আসার কথা । সিগারেটের প্যাকেটটা সরিয়ে খাতা কলম গুছিয়ে একপাশে রাখলাম । রুমটার অবস্থা খারাপ । সিগারেটের অবশিষ্টাংশ আর ছেঁড়া কাগজের টুকরোয় মেঝে ভরে গেছে ।

রুমের কোণ থেকে ঝাড়ু এনে সেগুলো একপাশে জমিয়ে রাখলাম । রুমের আসবাব বলতে – একজন মানুষ চিৎ হয়ে শুতে পারবে এমন সাইজের একটা তক্তা বিছানো চৌকি, দুই তাক বিশিষ্ট পুরাতন আমলের ঘুনে খাওয়া নড়বড়ে একটা টেবিল যার উপরে আমার সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস টাল করা আর পায়া ভাঙ্গা একটা চেয়ার । নতুন বই বের হওয়ার আগে প্রত্যেকবার ভাবি – এবার একটা খুব আরামদায়ক চেয়ার কিনব, যেটাতে বসলে আর উঠতে মন চাইবে না । ইচ্ছে করবে সমস্ত কাজকর্ম চেয়ারে বসেই সেরে ফেলি ।

গতবারেরটা নিয়ে এই পর্যন্ত পাঁচটা বই বের হলো, অথচ চেয়ার এখনো কেনা হলো না । টেবিলের উপরে থাকা রঙচটা ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সাড়ে দশটা বাজতে এখনো বিশ মিনিট বাকি । বাতিটা নিভিয়ে আবার চেয়ারে এসে বসলাম । এই ঘরে একটা জানালা থাকলে ভালো হত । বাইরের বাতাস ঘরে আসা – যাওয়া করত । আর একটা এটাচড বাথরুম ।

রাত – বিরাতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া বেশ ঝামেলার ব্যাপার । কিন্তু তাহলে আবার ভাড়াটা বেড়ে যেত । একটা জানালাবিহীন বদ্ধ রুমের জন্য তিনহাজার টাকা ব্যয় করা ছাপোষা মানুষ, আমার এত বিলাসিতা পোষায় না । তবে রিনি থাকলে ভিন্ন কথা ছিল ।

প্যাকেটে চারটা সিগারেট অবশিষ্ট আছে । খাবার এবং আব্দুল কুদ্দুস সাহেব আসতে আসতে একটা সিগারেট শেষ করা যায় । সিগারেট ধরিয়ে টান দিতেই নিকোটিনযুক্ত ভারী বাতাস ফুসফুসে প্রবেশ করল সেই সাথে মাথাটা কেমন হালকা হালকা লাগছে । একই শরীরে দ্বৈত অনুভূতি, ঠিক যেমনটা হয় একই মানুষকে একসাথে ভালোবাসা এবং ঘৃণা করার অনুভূতি ।

এখন রিনি থাকলে সিগারেটের গন্ধে প্রথমে নাক কুঁচকে তাকাতো । তারপর হাত দিয়ে নাক চেপে ধরে মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নিতো আর নাকি সুরে বলত – আবিদ! তুমি কি আমাকে বাঁচতে দেবে না ।

আচ্ছা, রিনির বর্তমান স্বামী কি সিগারেট খায় ? রিনি কি তারও সিগারেট খাওয়া দেখে নাক চেপে ধরে গাল ফুলিয়ে বসে থাকে ? ওর স্বামীও কি আমার মত রিনির গাল ফুলিয়ে থাকা ভালো লাগে বলে রিনির সামনেই বেশি সিগারেট খায় ?

দরজায় ঠক-ঠক করে শব্দ হচ্ছে । সিগারেট শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই । অবশেষটুকু কোণে ছুঁড়ে ফেললাম । চেয়ার থেকে উঠে লাইট জ্বাললাম । এক নাগাড়ে দরজার কড়া নেড়ে যাচ্ছেন আব্দুল কুদ্দুস সাহেব । লোকটার আচরণ এই ক্ষেত্রে অল্পবয়সী কিশোরীর মতো, তর সয় না ।

দরজা খুলতেই আব্দুল কুদ্দুস সাহেব হই-হই করে ঘরে ঢুকলেন । তিনি জানেন আমার চেয়ারের পায়া ভাঙা । সরাসরি গিয়ে চৌকির উপর পা ছড়িয়ে বসলেন এবং আয়েশ করে সিগারেট ধরালেন ।

আব্দুল কুদ্দুস সাহেব সাইজে আমার ডাবল । সারাদিন বসে থাকেন বিধায় পেট বাড়তে বাড়তে বিপদজনক সীমা পার করেছে বহুদিন আগেই । গায়ের রঙ মিশকালো থেকে আরেকটু ফর্সা । থ্যাবড়া নাক, ছোট ছোট চোখ দিয়ে পিট পিট করে তাকায় ।

মুখের ভেতরে ঝকঝকে সাদা দাঁত । সারাক্ষণই দাঁত খোঁচানী দিয়ে দাঁত খোঁচাতে থাকেন যদিও উনার এক দাঁত থেকে আরেক দাঁতের দূরত্ব এক মাইলের মতো । আমার জীবনে আমি দেখেছি – যেসব মানুষের দাঁতে ফাঁক থাকে তারা খুব ভালো মনের মানুষ হয় । আমার বাবার দাঁতেও ফাঁক ছিল আর তিনি হচ্ছেন আমার দেখা সবচেয়ে ভালো মানুষটা ।

আজ খাবার নিয়ে এসেছে একটা অল্পবয়সী ছোকরা । সে খাবারটা টেবিলে রেখে চকিত দৃষ্টিতে আমার ঘর পর্যবেক্ষণ করছে । দেখার মতো কিছু নেই, তবুও সে আজ প্রথমবারের মতো এসেছে কিনা ।
আব্দুল কুদ্দুস সাহেব সময় নিয়ে সিগারেট খাচ্ছেন আর দাঁত খোঁচাচ্ছেন ।

বছর ষাটেকের মুখভর্তি রঙিন দাড়ি বিশিষ্ট মানুষের সিগারেট খাওয়ার দৃশ্যটা খুব সুখকর নয় । আমি চোখ নামিয়ে ঘরের মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলাম । আব্দুল কুদ্দুস সাহেব সিগারেট শেষ করে গলা খাঁকারী দিয়ে আবার দাঁত খোঁচাতে লাগলেন । তিনি কি বলবেন আমি জানি , তবু ওনার বলার অপেক্ষা করছি ।

– লেখক সা’ব ?
– জ্বি ।
– দিনকাল কেমন চলে ?
– জ্বি চলছে কোনোভাবে । একটা নতুন বই বের করতে চাচ্ছি । আজ সন্ধ্যায় লিখতে বসলাম, সময় গেল অথচ এক কলমও লিখতে পারলাম না ।
– এমনে করলে তো হইবো না লেখক সা’ব । আমি গরিব মানুষ । আমার দিকেও তো একটু তাকাইতে হইবো, নাকি ?

– জ্বি, আমি চেষ্টা করছি । টাকা হাতে আসলেই পাঠিয়ে দেব ।
– আইচ্ছা । খাবার ঠিক-ঠাক পান তো ? নষ্ট ডাইল, তরকারি এই সমস্ত দিছে নাকি কোনোদিন ?
– না না । সব ঠিক-ঠাকই দেয় ।
– ঠিক আছে লেখক সা’ব । গেলাম তাইলে । আর চেষ্টা করতাছেন, একটু ভালো কইরা করেন ।

আব্দুল কুদ্দুস সাহেব ছোকরা টাকে এক প্রকার বগল দাবা করে নিয়ে গেলেন । বলে গেলেন ঠিকই, কিন্তু যদি আগামী এক বছরও ওনার হোটেলে বিনে পয়সায় খাই, উনি কোনোদিন মানা তো দূর – একটা কটু কথাও বলবেন না ।

কিছু মানুষ ভং ধরে ভালোবাসা ঢেকে রাখে, উনি সেই টাইপের । আমার বাবার পর আমার দেখা দ্বিতীয় ভালো মানুষটা বোধয় উনিই ।

খেতে বসে ঝালে চোখে পানি চলে আসল । বোতলের মুখে মুখ লাগিয়ে পানি খেয়ে নিলাম এক ঢোঁক । বেশি খেলে আবার ভাত খাওয়া যাবে না । রিনি থাকলে এখন কী করত কে জানে !

বেগুন দিয়ে লইট্যা মাছের তরকারিটা অসাধারণ হয়েছে । ঝাল একটু বেশি কিন্তু অপূর্ব স্বাদ । রান্না-বান্না সম্পর্কে আমার কোনো আইডিয়া নেই কিন্তু মনে হচ্ছে ঝাল বেশি না দিলে এত ভালো লাগত না খেতে ।

আকাশে মেঘ ডাকছে । আষাঢ় মাস । বৃষ্টির আসা – যাওয়ার কোনো নিয়ম নেই । যখন খুশি আসছে, যখন খুশি চলে যাচ্ছে । আমার খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই ঝুম বৃষ্টি নামল । ঘরের দেয়াল চুঁইয়ে পানি পড়ছে । আমি হাত ধুয়ে এসে চেয়ারে বসলাম । কাছেই কোথাও বাজ পড়েছে – স্পষ্ট শব্দ শুনলাম ।

কিছু মেয়েরা বাজ পড়ার শব্দে ভয়ে চিৎকার করে কিংবা পাশে কেউ থাকলে জড়িয়ে ধরে । রিনি এসবে ভীষণ বিরক্ত হতো । নাক সিঁটকিয়ে বলতো – দেখেছো আবিদ ! এত ন্যাকা । এই মেয়েগুলা এত ন্যাকামোর বস্তা কোথায় পায় কে জানে ।

একবার আমাদের খুব অন্তরঙ্গ মুহূর্তে ভীষণ শব্দে একটা বজ্রপাত হয়েছিল । রিনি চমকে উঠে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল । পরে অবশ্য এটা নিয়ে লজ্জা পেয়েছিল খুব । রুপবতীদের লজ্জা লজ্জা মুখও অসামান্য সুন্দর । লাল হয়ে ওঠা দু’গাল আর আনত চোখে হাজার বার খুন হওয়া যায় ।
এত সুন্দর একটা মেয়ে আমাকে কি দেখে পছন্দ করেছিল আমি আজও বুঝতে পারি না । অবশ্য সে তার ভুলটা শুধরে নিয়েছে ।

আমার মানিব্যাগে ওর একটা ছবি আছে । বহুবার চেষ্টা করেছি ছবিটা ফেলে দেওয়ার । কিন্তু যখনি ছবিটা হাতে নেই , তখনি আরেকবার নতুন করে ওর প্রেমে পড়ি, আরেকবার মায়ায় জড়িয়ে যাই ।

আমাদের প্রেমের বয়স যখন একবছর, রিনি আমাকে অ্যান্টিক টাইপের একটা বড় ডায়ালের রোল্যাক্স ঘড়ি গিফট করেছিল । উল্টো পিঠে আবার কিভাবে যেন ঝালাই করিয়ে ‘আবিদ’ লিখিয়েছিল মেয়েটা ।

ওর দেওয়া প্রত্যেকটা উপহার আমার কাছে সযত্নে সুরক্ষিত । ওর প্রত্যেকটা স্মৃতি আমার কাছে মহামূল্যবান । শুধু মানুষটাই থাকল না ।

রিনি চলে যাওয়ার আগে ডিভোর্স পেপারে আমার সাইন নেয়ার পর বলেছিল – “এভাবে জীবন চলে না আবিদ । তুমি বড্ড খাম খেয়ালী । আমার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না । লেখা লেখা করে জীবনটা শিকেয় তুলে দিলে অথচ তোমার প্রাপ্তির খাতায় বিগ জিরো । তুমি হয়তো প্রেমিক হিসেবেই আমার জন্য ভালো ছিলে, স্বামী নয় ।”

আমি সেদিন খুব আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করেছিলাম – আমার একটুও কষ্ট হচ্ছে না । শুধু চোখ বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল । আগে থেকেই আঁচ পেয়েছিলাম হয়তো । ওর সিদ্ধান্তে আমি কোনোদিনই বাধা দেইনি । কাছে আসাটাও ওর সিদ্ধান্ত ছিল আর ছেড়ে যাওয়াটাও । আমি মাঝখান থেকে শুধু তীব্র ভালোবাসাটা ছাড়া আক্ষরিক অর্থেই ওকে আর কিছু দিতে পারিনি ।

বৃষ্টির বেগ বাড়ছে । ঘরের মেঝেতে পানি জমা হয়ে দরজার নিচের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে । বাতাসের দমকে দরজায় কড়া নাড়ার মত শব্দ হচ্ছে । জানি আজ রাতেও আমার ঘুম হবে না । আবারও কড় কড় – কড়াৎ করে বাজ পড়ল । সেই সাথে বিদ্যুৎ চমকের মত আমার মাথায় একটা প্লট চলে আসল । দ্রুত খাতা – কলম টেনে নিয়ে লিখতে শুরু করলাম, একটা হুলস্থুল প্রেমের উপন্যাস ।

মানুষ বড় অদ্ভূত । নগ্ন শরীরে থেকে, ডাস্টবিনের খাবার খেয়ে, রাস্তার উপর ঘুমিয়েও মানুষই নিজেকে সবচেয়ে সুখী প্রমাণ করতে পারে । সেই তুলনায় আমি কোন ছার !

মানুষ চাইলেই সুখে থাকতে পারে রিনি । সুখ মনের ব্যাপার ।
ইশশ! তুমি যদি একটাবার বুঝতে ।

লিখেছেন: ইশরাত মেহজেবিন তিহা
এমবিবিএস, ১ম বর্ষ
ডক্টর সিরাজুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *