একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হোক তারুণ্য

কামরুল হাসান


একুশ মানে অহংকার, একুশ মানে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর শপথ, একুশ মানে তারুণ্যের জয়গান। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী মায়ের ভাষার সম্মান রক্ষায় ঝাপিয়ে পড়ে ছাত্র জনতা। পাকিস্তানি শোষকদের চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্তের উপর বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতসহ নাম না জানা হাজারো তরুন তরুণী স্লোগান তুলে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, বাংলা চাই। মায়ের ভাষার সম্মান রক্ষায় বিলিয়ে দেন বুকের তাজা রক্ত। বরণ করে নেন শাহাদাতের অমৃত স্বাদ।

ইতিহাসের কোথাও ভাষার জন্য রক্ত দিতে হয়নি। ভাষার জন্য এতোটা ত্যাগ কেবল বাঙ্গালীদের দ্বারাই সম্ভব। তাইতো ইউনেস্কো ২১ শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা দান করে।

মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার সাথে একাত্ম হয়ে আছে যে চেতনা, তার নাম মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মহৎ স্বীকৃতির প্রতীক এই দিনটি। পৃথিবীর বুকে মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখার ইতিহাসে রক্ত জড়িয়েছে কেবল বাঙ্গালী জাতি।

মহান ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস: ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর পূর্ব পাকিস্তানের উপর শুরু হয় পশ্চিম পাকিস্তানীদের নির্মম শোষণ। ধীরে ধীরে পশ্চিম-পাকিস্তানের শোষণ, নির্যাতনের বিরুদ্ধে পূর্বপাকিস্তান তথা বাংলার জনগণের মনে তীব্র ক্ষোভ জমতে থাকে। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে ঘোষণা দেন-‘Urdu and only urdu shall be the state language of Pakistan.’ পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে একই কথা বললে ছাত্রদের মধ্য থেকে , ‘No, No, It can’t be.’ প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়ে ওঠে। ১৯৫০ সালে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং ১৯৫২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনও একই রকম ঘোষণা দেন। এতে সারাদেশে ছাত্রসমাজ তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। ৪ ফেব্রুারি সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পালিত হয় ‘ধর্মঘট’।

সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত থেকে ঢাকায় জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকার রাজপথে মিছিল বের হয়। রাজপথে মিলিত হয় হাজার হাজার ছাত্র-জনতার ঢেউ। এই মিছিলে সরকার গুলি চালানোর নির্দেশ দিলে সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিউরসহ আরো অনেকেই শহিদ হন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে গড়ে যাওয়া এই ইতিহাস পৃথিবীর মানুষ চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। শহিদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ২১শে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারাবিশ্বে পালিত হয়।

একটি দেশের সংস্কৃতিকে ধারণ করে সে দেশের ভাষা। ভাষার মাধ্যমেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যুগ যুগান্তর ধরে বহমান থাকে। তাই মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার যে লড়াই তা সংস্কৃতি রক্ষার সংগ্রামও বটে। ২১ ফেব্রুয়ারি আজ আর শোকের দিন নয়, এটি অমর ভাষা শহিদদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করার এবং শোক-কে শক্তিতে পরিণত করার মাধ্যমে নব অধিকার চেতনায় উদ্দীপ্ত হওয়ার দিন। কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙ স্মরণ করিয়ে দেয় সেই অগ্নিঝরা রাজপথের জ্বলন্ত প্রাণের মিছিলকে। মূলত ২১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে উপ্ত ছিল, এদেশের মানুষের সব রকম শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আকাঙ্খা।

একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের মাধ্যমেই প্রথম বাংলা সংস্কৃতি সম্পর্কে অধিকারবোধ জেগে ওঠে। বাংলা সংস্কৃতি রক্ষায় একুশের চেতনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালি তার নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশে মনোনিবেশ করতে শুরু করে। সাংস্কৃতিক উত্তরণের পথে গড়ে ওঠা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবোধের এই জাগরণ পরবর্তীতে বাঙালি জাতীয়তাবোধের চেতনাকে দিয়েছে অমেয় শক্তি। যার প্রকাশিত নাম ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ’।

কোনো জাতির সম্যক পরিচয় ফুটে ওঠে তার সংস্কৃতির মধ্যে। সংস্কৃতি গড়ে ওঠে দীর্ঘদিনের জীবনযাপন, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক অগ্রযাত্রা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে। ভৌগোলিক অবস্থান, আবহাওয়ার ভিন্নতাও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশ নামক ব-দ্বীপ অঞ্চলের সংস্কৃতি বলতে আমরা বুঝি এখানকার মানুষের জীবনবোধ, জীবনাচরণ, আবেগ-অনুভূতির মধ্য দিয়ে অভিব্যক্ত ও প্রকাশিত সংস্কৃতিকে। ১৯৪৭ এর দেশভাগের পর আমরা আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাম। সাহিত্যে, শিল্পে, পোশাকে, বিনোদনে ছিল অনুকরণ প্রিয়তা। কিন্তু মহান ভাষা আন্দোলনই সেই আত্মচেতনাকে জাগ্রত করে এবং নিজস্ব সংস্কৃতির উত্তরাধিকার ও ঐতিহ্য রক্ষায় আমাদেরকে করে তোলে বদ্ধ পরিকর।

মূলত একুশ আমাদের শিখিয়েছে বাঁচতে হলে লড়াই করতে হবে। কণ্টকাকীর্ণ পথকে মসৃণ করতে গর্জে উঠার বিকল্প নেই। ১৯৫২ সালের একুশ মূলত অন্যায়, জুলুমের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে শেখায়। এরই প্রেক্ষিতে ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১ এর স্বাধীনতা অর্জন, ৯০ এর স্বৈরাচার বিরুধী আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করে। তারুণ্যের শক্তিকে ভোঁতা না করে একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হোক। এ চেতনা হোক অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অবিচারের বিরুদ্ধে, শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে, ক্ষুধা দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে, গুম,খুন, ধর্ষনের বিরুদ্ধে।
একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হোক তারুণ্য।


লেখক ও সাবেক শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ

Leave a Comment