একুশে এসাইনমেন্টই হোক প্রমোশনের সমাধান
তরিকুল ইসলাম মাসুম
একুশ মাস আগে (অক্টোবর ২০১৯) চীনের উহান শহরে বিস্তার ঘটার পর থেকে ধীরে ধীরে সমগ্র পৃথিবীটাকে করালগ্রাসে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে মহামারী করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) ওরফে নোভেল করোনা।
গত বছর মার্চের আট তারিখে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস শনাক্তের পর থেকেই জনস্বাস্থ্য রক্ষার্থে কঠোর বিধি-নিষেধ জারি করার পাশাপাশি ১৭ মার্চ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
সেই সাথে সারাদেশে একযোগে কঠোর লকডাউন শুরু হয় ২৬ মার্চ থেকে। ধাপে ধাপে লকডাউন শীথিল করা, ক্ষেত্রবিশেষে তা তুলে নিলেও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান আজও খোলেনি। তাছাড়া নতুন করে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্তের পর সীমান্তবর্তী জেলাসমূহে বিশেষ লকডাউন ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়। খুলনা ও রাজশাহী বিভাগে করোনা পরিস্থিতি অবনতির দিকেই ঝুঁকছে। ফলে স্বশরীরে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান চালু করা একটি বড় চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁিড়িয়েছে।
একুশ দফা (সম্ভবত) ছুটি বাড়িয়ে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। চলমান ছুটি ইতোমধ্যে ষোল মাসে পদার্পন করলেও ঈদের আগে খোলার ন্যূনতম কোন লক্ষণ নাই। এমনকি করোনার ভ্যাকসিনের অপ্রতুলতার দরুণ এবছর খোলার পরিবেশ সৃষ্টি হবে কিনা সন্দেহ রয়ে যায়। অন্যদিকে, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে স্বশরীরে ক্লাস-পরীক্ষা গ্রহণ করা একটি জটিল সমীকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজ নিজ উদ্যোগ গ্রহণে তৎপর হলেও শতভাগ সফলতা অর্জন করতে যথারীতি ব্যর্থ হচ্ছে।
বলে রাখা প্রয়োজন, এইচ.এস.সি.থ ২০২০ ব্যাচকে বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় অটোপাস দেওয়া হয়েছে। যদিও ফলাফল নির্ধারণ নিয়ে নানান সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে, তবুও সরকার ধন্যবাদ পাওয়ার যথেষ্ট দাবি রাখে। মাধ্যমিকে এসাইনমেন্টের মাধ্যমে ওপরের শ্রেণীতে প্রমোশন দেওয়া হয়েছে।
একাদশে গত দুই বছরে স্বশরীরে একটিও পরীক্ষা হয় নি, শুধুমাত্র অনলাইনে কুইজ পরীক্ষা নিয়ে একাদশ থেকে দ্বাদশে প্রমোশন দেওয়া হয়েছে। তবে ২০২১ সালের মাধ্যমিক ও সমমান এবং এইচ.এস.সি ও সমমান পরীক্ষাসমূহ অনিশ্চয়তায় ঘুরপাক খাচ্ছে। অন্যান্য শ্রেণীতে পুন:রায় এসাইনমেন্ট দেওয়া শুরু করেছে। কিন্তু দুই পাবলিক পরীক্ষা কিভাবে হবে তা নিয়ে চলছে নানান কল্পনা-জল্পনা। কেউ কেউ প্রস্তাব দিচ্ছেন অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের জন্য।
বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে আমি এই প্রস্তাবের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করছি। অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের পরিবর্তে নির্ধারিত বিষয়সমূহের পরীক্ষার আদলে এসাইনমেন্ট নেওয়া হোক অথবা প্রদত্ত সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের আলোকে অর্ধশত নম্বরের এসাইনমেন্ট (ত্বত্তীয়) গ্রহণের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্টি নীতিমালা তৈরি করে বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরসমূহকে দায়িত্ব দেওয়া হোক।
বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একটু বেশি নাজুক পরিস্থিতির স্বীকার। গত বছর মে মাস থেকে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার নির্দেশনা থাকলেও তা বাস্তবায়ন যেন আরেকটি জটিল সমীকরণ। ইতোমধ্যে নানান ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও তা কতটুকু সার্থক তা বলাবাহুল্য। প্রথম দিকে কিছুটা সাড়া ফেললেও আপতত তা যেন ধূ ধূ মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল অনুষদভূক্ত বিভাগসমূহে কিছুটা সচল শোনা গেলেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি সন্তোষজনক নয়। অন্যান্য বিভাগসমূহের অবস্থা বর্ণনার অযোগ্য। তাছাড়া প্রত্যন্ত এলাকায় নেটওয়ার্ক সুবিধা অপ্রতুল। সেখানে অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের পরিকল্পনা বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয়। তথাপি অনেকেই দুই বা ততোধিক বছর ধরে একই শ্রেণি/বর্ষ/সেমিষ্টার এ আটকে রয়েছে।
গত জানুয়ারী মাসে শর্ত সাপেক্ষে পরীক্ষা গ্রহণের অনুমতি দিলে চতুর্থ বর্ষের আটকে থাকা চূড়ান্ত পরীক্ষা গ্রহণ শুরু হয়। সেই সাথে মার্চ থেকে অন্যান্য বর্ষ ও সেমিষ্টার ফাইনাল পরীক্ষার সময়সূচি ঘোষণা করা হলেও অপ্রত্যাশিত কারণে তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যায়।
বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নয়, সীমান্তবর্তী এলাকাসমূহ বিশেষ করে খুলনা ও রাজশাহী বিভাগে করোনা এখন বেসামাল। এই দুই বিভাগের সীমান্ত এলাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো বিশেষ লকডাউনের আওতায় রয়েছে। এমাতাবস্থায় গুটিকয়েক বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা গ্রহণ শুরু করলেও নানা কারণে বন্ধ ঘোষণা করছে।
এমন পরিস্থিতি মোলাবিলা করতে এবং করোনা ভ্যাকসিন প্রদানের পূর্ব পর্যন্ত লেখাপড়ার বিশাল ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এসাইনমেন্টের মাধ্যমে পরবর্তী শ্রেণিতে প্রমোশনের ব্যবস্থা করুন। এক্ষেত্রেও পরীক্ষার আদলে প্রশ্ন দিয়ে এসাইনমেন্ট প্রক্রিয়া সম্পাদন করা যেতে পারে। অথবা বিগত বর্ষ বা সেমিষ্টারগুলোর গড় সিজিপিএ থেকে ৫০% এবং এসাইনমেন্ট, ক্লাসের উপস্থিতি, টিউটোরিয়াল বা ইনকোর্স এ গৃহিত নম্বর এর উপর ৫০% জিপিএ নিয়ে ফলাফল প্রদানসহ পরবতর্তী বর্ষ বা সেমিষ্টার এ প্রমোশন দেওয়া যেতে পারে।
শর্তসাপেক্ষে ব্যবহারিক পরীক্ষাগুলো পরবর্তীতে গ্রহণ করতে হবে। তবে শেষ বর্ষ বা সেমিষ্টার এর ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য-বিধি মেনে ব্যবহারিক পরীক্ষাসমূহ গ্রহণ করা যেতেই পারে। সেই সাথে মৌখিক বা ভাইভা পরীক্ষা অনলাইনে জুম বা গুগল মিট এ সংযুক্ত করে গ্রহণ করলে সকলেই উপকৃত হতো। তাছাড়া কোন বিভাগের সকল শিক্ষার্থীরা যদি অনলাইনে সংযুক্ত হয়ে পরীক্ষা দিতে সম্মত হয়, তবে সেই সকল বিভাগে অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের অনুমতি প্রদান করা যেতে পারে।
এদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কতর্ৃপক্ষ অনার্স প্রথম বর্ষের তিন লক্ষাধিক শিক্ষার্থীদেরকে শর্তসাপেক্ষে অটো প্রমোশন দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ । যদিও সেগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান শর্ত – পরিস্থিতি স্বাথাবিক হলে এসব শিক্ষাথর্ীদেরকে অবশ্যই প্রথম বর্ষের লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে। কেউ যদি উক্ত পরীক্ষায় অংশ না নেয় কিংবা পরীক্ষায় অংশ নিয়ে প্রমোটেড না হয়, সেক্ষেত্রে প্রমোশন বাতিল বলে গন্য হবে।
উল্লেখ্য, ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী বর্তি হয়েছিল ৩ লক্ষ ৭৩ হাজার ৮৭৬ জন। কিন্তু পরীক্ষার জন্য ফরম পূরণ করেছে অনিয়মিত পরীক্ষার্থী সহ সর্বমোট ৪ লক্ষ ৬৭ হাজার ৮৩৫ জন। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধের ষোল মাস চলমান, অথচ ৮৩ শতাংশ কলেজ শিক্ষার্থীদেও অনলাইনে ক্লাস শুরুই করতে পারে নি। যদিও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলো অনলাইন ক্লাসের ধার ধারে না। তাছাড়া শ্রেণিকক্ষের অপর্যাপ্ততা, সপ্তাহে তিন দিন ক্লাস এমনকি শিক্ষকদের অলসতার কারণে অফলাইনেও ঠিকমতো ক্লাস হতো না। যেখানে ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা ক্লাস পেয়েছিল মাত্র পাঁচ মাস, সেখানে তারা দ্বিতীয় বর্ষে প্রমোশন পাবে কোন পড়াশোনা ছাড়াই! পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে আর এঁরা আবার আটকেন থাকা পরীক্ষাই বা কবে দিবে? তার চাইতে এসাইনমেন্টের মাধ্যমে মূল্যায়ন করে উপরের শ্রেণিতে প্রমোশন দেওয়াই উত্তম পন্থা হবে বলে মনে করি।
আমি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগে চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। প্রায় এক বছর আগেই হয়তো আমাদের পরীক্ষা শেষ হয়ে যেতো। কিন্তু করোনা মহামারীর জন্য আটকে আছে।
গত জানুয়ারি মাসে আমরা পরীক্ষা শুরু করেছিলাম, ব্যবহারিক পরীক্ষাগুলো এবং একটি ত্বত্তীয় পরীক্ষা হওয়ার পর টি.আই.সি.আই এর জন্য আমরা ফেব্রুয়ারিতে নরসিংদীর ঘোড়াশালে এক মাস অবস্থানের পর আমরা ফিরে আসি। হঠাৎ করেই সরকারিভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য চলমান পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়ায় দীর্ঘদিন যাবৎ আমরা আটকা পড়ে আছি। এমতাবস্থায় আমরা না পারছি কোন সরকারি/বেসরকারি চাকরির আবেদন করতে, না পারছি কোন প্রাইভেট চাকরিতে যোগদান করতে। তাই আমরা চাই যেভাবেই হোক আমাদের আটকে থাকা ত্বত্তীয় পরীক্ষাগুলো শেষ করে ফলাফল দেওয়া হোক।
ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী মোছাঃ হনুফা খাতুন বলেন, “আমরা এভাবে আর ঝুলে থাকতে পারছি না, এই পরিস্থিতিতে স্বশরীরে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব না হলে আমাদের মুক্তি দিতে দুইটি পদ্ধতির যেকোন একটি পদ্ধতি অবলম্বন করা হোক। প্রথমত, আমাদের স্থগিত হওয়া বাকি পরীক্ষাগুলো অনলাইনে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হোক। দ্বিতীয়ত, বিগত বর্ষ বা বর্ষগুলোর ফলাফলের সাথে চতুর্থ বর্ষে আমাদের দেওয়া টিউটোরিয়াল, এসাইনমেন্ট এবং ব্যবহারিক পরীক্ষা, প্রজেক্ট রিপোর্ট ও টি.আই.সি.আই ট্রেনিং এর পরীক্ষার ফলাফল গড় করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রদান করা হোক। কেননা, এ বছরের জন্য আমরা স্বশরীরে পরীক্ষা দেওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছি।
ইতিহাসের পাতা ঘাটলে দেখা যায়, প্রতিটি শতকেই দুই একটি মহামারীর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। তাতে মানুষের প্রাণহানি, পশু-পাখি ও পরিবেশের বিপর্যয়সহ দুর্ভিক্ষের অবতারণা ঘটে। ক্ষতি হয় চিকিৎসা, শিক্ষা, বাণিজ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে। সেইসব মহামারী থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে দুই, তিন কিংবা পাঁচ বছর সময় লেগেছে। করোনা ভাইরাস থেকেও স্বাভাবিক পরিস্থিতির অবতারণা কবে হবে তা এখেনো নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। যদি দুই বা তিন বছর লেগেই যায়, ততদিন তো জীবন থেমে থাকবে না।
জীবন তার নিজস্ব গতিতে নদীর স্রোতের মতো কলকল বেগে কিংবা ঘড়ির কাটার মতো টিকটিক করে চলতেই থাকবে। আর সেই জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো বিবাহ* যা মানষকে সামাজিক ও দায়িত্বশীল জীবন যাপনের প্রতি অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু শিক্ষা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি ডিগ্রি স্নাতক বা অনার্স শেষ করতে না পারায় অনেক মেয়ের বিবাহ আটকে রয়েছে। এমনকি বিবাহ করার সর্বোত্তম সময় ২০-২৫ বছর বয়সের মধ্যে অনেক ছেলে গ্রাজুয়েশন শেষ করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের অভাবে বিবাহ করতে পারছে না। সুতরাং, পরীক্ষা গ্রহণে দীর্ঘসূত্রিতার জন্য লক্ষ লক্ষ বেকারদের জীবন বৃক্ষের চূঁডায় কালো মেঘ জমা হয়ে মনের পৃথিবীটাকে মেঘাচ্ছন্ন করে রেখেছে। শুধুই প্রতীক্ষা, কবে মেঘরাজি বৃষ্টি হয়ে পড়বে আর মনজগতে সূর্যের হাসি উদিত হবে।
আশাকরি, করোনার এই সময়ে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সংক্ষিপ্ত সময়ে সরকার, শিক্ষামন্ত্রণালয়, শিক্ষা অধিদপ্তর, শিক্ষাবোর্ড, ইউজিসি এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ স্ব স্ব উদ্যোগে যথাযথ কর্মসূচি প্রদানপূর্বক সংশ্লিষ্ট সকলকে শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। করোনামুক্ত একটি সবুজ-শ্যামল ও নির্মল পৃথিবী দেখার প্রত্যাশায়।
লেখক:
তরিকুল ইসলাম মাসুম ( শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক) ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি অনুষদ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।