করোনাকালে পরিবেশ রক্ষায় কঠোরভাবে আইনপ্রয়োগ, উন্নয়নে পরিবেশ ব্যবস্থাপনা ও সচেতনার উপর গুরুত্ব
বিশেষ প্রতিনিধিঃ শনিবার Virtual Session এ শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক আবু জাফর আহমেদ মুকুল এর উপস্থাপনায় আগামির বাংলাদেশ ফেসবুকে পেইজে “পরিবেশ উন্নয়নে কোভিড-১৯ তাৎপর্য” শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
আলোচনায় Panelist হিসেবে সংযুক্ত ছিলেনঃ ড. এ. আতিক, নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্ট্রার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের প্রফেসর ড. নিয়াজ আহমেদ খান, মুকিত মজুমদার বাবু, Chairman, Prokriti O Jibon Foundation, Vice Chairman, Impress Group and Channel I; সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, পরিচালক, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) এবং ড. রঞ্জন রায়, সহযোগী অধ্যাপক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
লাইভ প্রোগ্রামের শুরুতে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. রঞ্জন রায় পরিবেশের সাথে কোভিড-১৯ এর সম্পর্ক, কোভিড-১৯ এর কারনে পরিবেশের প্রধান চ্যালেঞ্জ ও উন্নয়নের উপর কোভিড-১৯ এর শিক্ষা নিয়ে আলোকপাত করেন।
তিনি বলেন কোভিড-১৯ সংক্রমনের মূল কারণ হচ্ছে, মানুষ ও বন্যপ্রাণীর মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে ক্ষতিকর মিথষ্ক্রিয়া (potentially harmful interactions). মাত্রাতিরিক্ত হারে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ, অনেক প্রজাতির অস্তিত্বের জন্য মারাত্মকভাবে হুমকি স্বরূপ। তিনি যোগ করেন গবেষণা দেখাচ্ছেঃ বানরজাতীয় প্রাণী থেকে এইচআইভি ভাইরাস, পাখী থেকে এভিয়ান Flu, শূকরের দেহ থেকে Swine Flu, বাদুড় থেকে সার্স ও ইবোলা ভাইরাস এবং সাম্প্রতিককালে, বাদুড় থেকে করোনা ভাইরাসের সৃষ্টি হয়েছে।
মোদ্দাকথা হলো, মানুষ সব সময়ই, প্রাণীর দেহ থেকে আসা, নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এর অন্যতম কারণ হল গাছপালা ও বনাঞ্চল ধংস করা। ফলে, প্রাণীর আবাসস্থল হারিয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়েই প্রাণীরা মানুষের কাছাকাছি আসছে এবং রোগ সৃষ্টিতে ভুমিকা রাখছে।
তিনি উল্লেখ করেন, পরিবেশের জন্য কোভিড-১৯-এর স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ-মেয়াদী চ্যালেঞ্জগুলো লক্ষ্যনীয়। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা প্রকট। এ দেশে Medical Waste Management and Processing’র Legislation (আইন) নেই। মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আমাদের ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
মেডিকেল বর্জ্য, পরিবেশ ও বায়ু দূষণের জন্যও বড় হুমকি। The World Economic Forum বলেছে COVID-19 এবং বায়ু দূষণের মধ্যে “সাংঘাতিক” সম্পর্ক (deadly link) রয়েছে. এছাড়া কয়েকটি গবেষণা দেখিয়েছে বায়ু দূষণ ও COVID-19 মৃত্যুহারের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। বায়ু দূষণ কমানো ছাড়া শুধু COVID-19 নয়, বরং জনস্বাস্থ্যের উন্নতি করা সম্ভব নয়।
উন্নয়নে কোভিড-১৯ এর শিক্ষা নিয়ে ড. রায় বলেন বায়োফিজিক্যাল থ্রেসহোল্ড অতিক্রম করলে পরিণতি যে ভয়াবহ, কোভিড-১৯ তা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। সেজন্যই, উন্নয়ন কার্যক্রম পরিবেশ-বান্ধব না হলে, আগামী দিনে, আমরা আরও দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতির মুখোমুখি হব। তিনি গুরুত্ব দিয়ে বলেন করোনা প্রণোদনা যেন জলবায়ু-সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নয়নকে কে সর্মথন করে, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া বাঞ্ছনীয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. নিয়াজ আহমেদ খান কোভিন-১৯ ভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন মানুষ ও প্রাণীকূলের আবাসস্থলের যে স্বাভাবিক ভারসাম্য তা আমরা মানুষ ধংস করে ফেলেছি। প্রকৃতির শ্বাভাবিক যে বিভাজন মানুষ সেটা ভুলে গেছে। মানুষের আচরণ বলে দিচ্ছে এ প্রথিবীতে বাঁচার অধিকার শুধু তাদের আছে। তিনি জোর দেন মানুষের প্রকৃতিকে করায়ত্ত করার যে বৃথা চেষ্ঠা সেখান থেকে সরে আসা উচিত।
তিনি মানুষকে প্রাকৃতিক বৈচিত্র সংরক্ষণ করার বিষয়ে আলোকপাত করেন। তিনি পরিবেশ সংরক্ষনে রাষ্ট্রীয়, সামজিক ও ব্যক্তিক পর্যায়ে সচেতনাকে তুলে ধরেন। জিডিপিকে নয়, পরিবেশকে সঙ্গে নিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) এর পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পরিবেশ আইন ও ও বাস্তবায়নের উপর গুরুত্বরোপ করেন। তিনি সরকারকে স্থানীয় বাধা অতিক্রম করার জন্য পদক্ষেপ বিষয়ে তুলে ধরেন; পাশাপাশি উন্নয়নের জন্য জনগনকে সম্পৃক্ত করার জন্য অনুরোধ করেন। তিনি সরকারি কর্তৃপক্ষের স্বদিচ্ছা ও জনবলের অভাব এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার বিষয়ে দৃষ্টিপাত করেন। তিনি পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যক্রমকে ৬৪ জেলায় বিস্তার করার জন্য অনুরোধ করেন।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বাংলাদেশে, বিশেষকরে ঢাকা শহরের পরিবেশ দূষণের চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন আমরা বুড়িগঙ্গা নদী ধংস করেছি এখন সিইটিপি (সেন্ট্রাল এফ্লুয়েন্ট ট্রিট্মেন্ট প্লান্ট) নামক নাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমে ধলেশ্বরী নদী ধংস করার সব আয়োজন করে ফেলেছি।
তিনি উন্নয়নের প্রাইরটাইজেসনের উপর জোড় দিয়ে বলেন, উন্নয়ন মানেই পরিবেশ ধংস না এবং প্রশ্ন রাখেন আমরা কি একটি বুড়িগঙ্গা বা ধলেশ্বরী নদী সৃষ্টি করতে পারবো? যে উন্নয়নে পরিবেশ ধংস হয় সেটাকে তিনি অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বলতে পারি, কিন্তু উন্নয়ন বলতে রাজি না।
তিনি বলেন পরিবেশ রক্ষায় সরকার সুকৌশলে কতকগুলো বাঁধা সৃষ্টি করে এবং পরামর্শ দেন “এনভারমেন্টাল ডেমোক্রেসি” বাড়ানোর উপর। Prokriti O Jibon Foundation এর চেয়ারম্যান এবং Impress Group and Channel I এর Vice Chairman মুকিত মজুমদার বাবু প্রকৃতি ও পরিবেশ থেকে শিক্ষা নিয়ে কাজ করার উপর গুরুত্বরোপ করেন। তিনি বলেন করোনা বড় একটা শিক্ষা দিয়েছে, যদিও এটা কাম্য না। তবে এর জন্য মানুষই দায়ী। প্রকৃতি একটা প্রতিশোধ নিল।
তিনি সরকারকে সচেতনা ও আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়নের উপর জোর দেন। তিনি বাজেট বৃদ্ধির উপর দৃষ্টি আকর্ষন করে বলেন সরকার অবশ্যই করোনার শিক্ষা নিয়ে প্রকৃতি ও পরিবেশকে বাঁচানোর উদ্যোগ নিবেন। প্রকৃতি ও পরিবেশকে ভালো রাখতে হলে সব স্তরে সকলের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের আহবান করেন। তিনি স্বাস্থ্য এবং প্রকৃতি ও পরিবেশ এর সম্পর্ক পরিপূরক বিষয়ে আলোকপাত করেন। পরিবেশ-বান্ধব কৃষির বিষয়টিও তুলে ধরেন।
বাংলাদেশ সেন্ট্রার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ এর নির্বাহী পরিচালক ড. এ. আতিক কোভিড-১৯ ও পরিবেশ এবং জীবন ও জীবিকার দ্বন্দ্ব বিষয়ে দৃষ্টিপাত করেন। তিনি বাজেটে শুধু স্বাস্থ্য না বরং জনস্বাস্থ্য বিষয়ে সরকারের আরো মনযোগ আর্কশন করেন। জনস্বাস্থ্য বিষয়ে গবেষণা এবং বিশেষজ্ঞ এর মতামতকে গুরুত্ব দেয়া উচিত বলে মনে করেন।
ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের প্রশ্নের উত্তর প্রদান করেন অথিতিবৃন্দ। এক প্রশ্নের উওরে ড. রায় বলেন UN Environment’r রিপোর্টের আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে গ্রাউন্ড-লেবেলে ওজোনের মাত্রা কমানোর ফলে ভুট্টা, ধান, সয়াবিন ও গমের ক্ষতি ৪৫ শতাংশ কমানো যাবে। তাই ক্রপ লসে বায়ু দূষণের (গ্রাউন্ড-লেবেলের ওজোন দ্বারা) প্রভাব নিয়ে গবেষনা হওয়া জরুরি।
অথিতিবৃন্দ উপসংহারে বলেন দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা হিসাবে টেকসই উন্নয়ন এবং উন্নয়নের সমন্বিত মডেল গ্রহণ ছাড়া আমাদের গত্যন্তর নেই। তারা যোগ করেন, টেকসই উন্নয়ন এজেন্ডা ২০৩০-এর সঠিক বাস্তবায়নই হতে পারে এই মডেলের গুরুত্বপূর্ণ পথ প্রদর্শক।