করোনা কথন

মোঃ সোহানুর রহমান সোহান


জীবিকা এখন জীবনের ঊর্ধ্বে দাঁড়িয়ে গেছে। সারা জীবনে কখনো কারো কাছে হাত পাতেননি তিনি। দিন এনে দিন খেয়ে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই কাটে দিন তার।প্রায় তিন মাস হতে চলা এই অবরুদ্ধতায় তিনি তার স্বয়-সম্বল সবকিছু শেষ করে ভাঙ্গা কুটিরে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করা পুরুষ এক।

স্ত্রী পারিবারিক কলহের জেরে অভিমান করে তাকে ফেলে রেখে গেছেন বেশ কিছুদিন হলো। কারো কাছে নত হতে না পারার লজ্জায়,পেটের ক্ষুধায় মিষ্টি কুমড়া সিদ্ধ করে বেলা পার করছিলেন তিনি। কখনো আবার ঘাসের মধ্যভাগে উঁকি দেয়া সবুজ শাক খুঁটে খুঁটে তুলে এনে তা সেদ্ধ করে খাচ্ছিলেন। নিজ এলাকার এই দুঃসহ সংবাদ গোপনে কানে আসার সাথে সাথেই যখন তার ঘরে পৌঁছে যায় গ্রীন ভয়েসের খাদ্য উপহার, তার চোখের ঝলকানো হাসি আর কে দেখে তখন?

হাঁটু পানি! তাতে কি? গোড়ালির প্যান্ট হাঁটুতে তুলে চপেট জোড়া এক হাতে অন্য হাতে ঈদ উপহার নিয়ে পানি ভাঙতে শুরু করেন টিমের অন্যান্যরা।ওপাশ থেকে যে স্নেহ মাখা সুর ভেসে আসলো তাতে যুক্ত হলো মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া ভালবাসার পরশ। আর কি লাগে কাজের প্রাপ্তিতে?

এই অবরুদ্ধতায় কিছু স্মৃতি জমার সাথে সাথে কিছু ভাবনাও জমে গেছে মননে। উপরের সপ্ত আসমানে বসে যিনি সব নিয়ন্ত্রন করছেন তিনি তো কেবল এক মানুষেরই স্রষ্ঠা নন। তিনি একই সাথে সকল গাছ-গাছালি, পাখ-পাখালি সহ গোটা প্রকৃতিকূলের স্রষ্ঠা। তিনি হয়তো নিজ কান পেতে সেই প্রকৃতিকূলের আর্তনাদে সাড়া দিয়েছেন এবার। তাইতো ধূলোময়লার এ শহর আজ ধূলোবালি হীন। শব্দের নিক্কনে মুখরিত এ ক্যাম্পাস আজ শান্ত। গাড়ি-ঘোড়াতে অবিরাম থাকা পিচ ঢালা সড়কের বুক আজ শূণ্য। খবরের পাতাটিও আজ ব্যাভিচারমুক্ত, সড়কযাত্রা এখন মৃত্যূহীন। এদিকটায় চোখ মেলে একটু জিরিয়ে নেই মাঝে মাঝে।

কিন্তু মুদ্রার অপর পিঠটি ভয়াবহ, সর্বশেষ কোন বছর তারাবির নামাজ সম্পূর্ণভাবে পড়েছি তা ভাবতে গেলে চিন্তার রেখায় একটা বড়-সড় দাগ কাটতে হয়, আর খতম তারাবি ছাড়া সূরা তারাবি তো আজন্মই আয়োজন হয় নি আমাদের কবিরাজ পাড়া মসজিদে। জানতাম এবারও সম্পূর্ণ তারাবি পড়া হবে না তবুও গোটা মুসলিম উম্মাহর এই খতম তারাবির বঞ্চনায় কি যে শূন্যতা অনুভূত হয়েছিল তা ভাবলে মন ডুকরে কেঁদে ওঠে।এখনো নামাজ এ দাঁড়িয়ে যখন পাশের জন বলে ভাই ৩ফিট দূরে যান কি যে হাহাকার জাগে বুকে এ ব্যথা দেখাবার নয়।এতো গেল মুসলিম উম্মাহর কথা, হিন্দু- বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের অবস্থা আরও করুন।

গেল তিন দশকের চাক্ষুষ সাক্ষ্য দিয়ে বলছি- এমন বন্দিদশা কেউই-কখনোই অবলোকন করে নি‌‌। কোনো শিক্ষক এতোদিন ক্লাস না নিয়ে ঘরে বসে থাকেন নি, কোনো ছাত্রও এতটা সময় বাসায় নির্বিকার থাকেনি। কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী অফিস না গিয়ে এতটা দিন ঘরে বন্দি হন নি, কোন চালক তাই স্টিয়ারিংবিহীন এতটা দিন ঘরে শুয়ে থাকেন নি। এতসবের নেপথ্যের কারণ আমাদের সকলেরই জানা।সেই অদৃশ্য শক্তি ছোট্ট একটি ভাইরাসের সংক্রমণ আমাদের নির্জীব-নিষ্কর্ম-নিথর করে রেখেছে ঘরের ভেতর।

একদিন এক হকার আমাদের বাসার সামনে এসে হাঁক দিলে বের হয়ে এসে গল্প জুড়ি তার সাথে। দু-চার কথা বলতেই দুঃখের সাথে নিজের অসামর্থ্যকে ফুটিয়ে তুলে মাথার উপর ঋণের বোঝা লাঘব করতে সকল শৃংখল ভেঙ্গে বেরিয়ে পড়েছেন কাজে এবং ক্ষুব্ধতার সাথে তা প্রকাশ করে বলছিলেন- “সরকার কি হামাক টেহা দিবে তা যে হামরা সরকারের কথা শুনমো ‌? আরে ভাই, দুই দিন কাম না কইল্লে পেটোত ভাত যায় না, তার উপরে পাওনাদারের ঠেলা- ক্যাং করি এমরা ঘরত থাইকপের কয়, কন তো? সরকারে হামাক ফাও খোয়াইবে?”

লোকটার শেষের দুই প্রশ্নে নির্বাক ভাবতে থাকি আর চিন্তার গভীরতায় নিশ্চুপ থেকে যাই।

আমার ক্ষুদ্রতর ধারনা থেকে মনে হয়, আমাদেরকে একটা বড়সড় লাফ দেয়া উচিত। আর সেই লাফের পূর্বে একটা দূরত্বও মাপা উচিত। কোন একটি বড় ধরনের লাফ দেয়ার পূর্বে যেমন বড় করে পিছনে পিছিয়ে খানিকটা দূরত্ব নিতে হয় ঠিক তেমনি ভাবে একটি/দুইটি সপ্তাহ অর্থনীতিকে খানিকটা উন্মুক্ত করে সকলের ঠিক ১৫/৩০ দিনের খাবার নিশ্চিত করে পুরো দেশ পূর্বপ্রস্তুতিমূলক ভাবে ১৫/৩০ দিনের জন্য একিবারি সম্পূর্ণরূপে পিনপতন নীরব করে দেয়া উচিত যেখানে একটি পিপড়াও হাঁটবে না ঐ ১৫/৩০ দিন।

এবার লাফ দেয়ার পর যেমন কেউ খানিকটা জুড়িয়ে নিয়ে কর্মে অগ্রসর হয় ঠিক একইভাবে ধাপে ধাপে সীমিতাকারে সবকিছুকে উন্মুক্ত করলে সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে কাজের কাজ হলেও হতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।

আবারো সেই কাজে ফিরে আসি যে কাজের রোমন্থিত স্মৃতি দিয়ে শুরু করেছিলাম সেই কাজ করতে গিয়েই যথার্থ মনে হয়েছিল যে- মানুষ আসলেই দুই ধরনের। কেউ অভাবে করুন আর কেউ স্বভাবে করুন। কারো অভাব নেই কিংবা যতোটুকুই সম্বল আছে তা দিয়ে চালানো যাচ্ছে, তার পরেও বলে- নাই-নাই। আবার কারো একিবারি নাই কিন্তু তারপরও মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারেনা যে নাই।

  • লেখকঃ শিক্ষার্থী, ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
Scroll to Top