সাজু সরদার
আজ আমি মরুভূমি! শিক্ষার্থীর কোলাহলহীন আমিতো মরুভুমিই সাদৃশ্য। শ্রেণীকক্ষে শূন্যতা, শহীদ মিনার মুক্ত মঞ্চে নেই নাটক, গান, বিতর্ক প্রতিযোগিতা কিংবা কবিতার ছন্দ। ঝড়ে ভেঙ্গে যাওয়া বাবলা গাছ অপসারণের পর টুকিটাকি চত্বরে সদ্য রোপণ করা দুটি কদম গাছের চারার নবীন সতেজ পাতা, চায়ের কাপ আর গিটারের টুংটাং শব্দ শোনার অপেক্ষার প্রহর গুনছে।
সিনেট ভবন, ইবলিশ চত্বর কিংবা পশ্চিম পাড়ায় নেই জুটিদের আনাগোনা। তাই সন্ধ্যার পর হ্যান্ডমাইকে খুব কদাচিৎ শোনা যায় “আপনারা অতি দ্রুত যে যার বাসায় চলে যান, প্রক্টর স্যারের টিম আমাদের সাথে আছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে! আপনারা অযথা ঘোরাঘুরি না করে যে যার বাসায় চলে যান”। শিক্ষার্থীরা করোনাহীন সুস্থ পৃথিবীতে যখন আবার আমার বুকে পদার্পণ করবে তখন তারা নিশ্চয়ই আমার কাঠামোগত প্রাকৃতিক ও কৃত্তিম পরিবর্তন দেখে অবাক হবে।
আজ আমার বুকে রক্তক্ষরণ! শিক্ষার্থী-শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বুকের রক্তক্ষরণতো আমার বুকেই রক্তক্ষরণ সাদৃশ্য। কারণ, তাদের (শিক্ষার্থী-শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী) অস্তিত্বেই আমি সদা সর্বত্র বিরাজমান। এই রক্তক্ষরণের কারণ- আজ আমার ঠাই হয়েছে পত্রিকার কলামে আর টিভির স্ক্রলে। আমার যে সকল বর্তমান শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত তারা এই করোনা মহামারিতে নিজ নিজ বাড়িতে থাকার বদলে নতুন তথ্যের খোঁজে আর নিউজ অফিসের চাপে আমার বুকেই দিনরাত, খেয়ে না খেয়ে পড়ে আছে।
বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিকতার জীবনে এত নিউজের চাপ আর অফিসের ঝাড়ি তারা মনে হয় আগে কখনো উপভোগ করেনি! তাদের (সাংবাদিক) কর্তব্য পালন করতে গিয়ে আমার যে প্রচার সেটাতেই আজ আমার মুখ দেখান দায়! আমার সন্তানতুল্য শিক্ষার্থী-শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের অস্বস্তিতো আমারই দায়। কোন আড্ডা কিংবা সাক্ষাতে আমার পরিচয় পেতেই আমার সন্তানদের শুনতে হচ্ছে “ওহ তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েতো………”।
এ যেন মহাবলী ভিমের গদা, অর্জুনের তীর কিংবা সিন্দাবাদের সোলেমানি তরবারির আঘাত! উক্ত আঘাত আজ আমার সন্তানদের হৃদয়ের রক্তের অনুচক্রিকার নির্মম বিচ্ছুরণ। আজ আমি কেমন আছি? এ আমার নিজের কাছেই নিজের প্রশ্ন। যদি ভালই থাকি তবে এ কেমন ভাল থাকা! আর যদি খারাপই থাকি তবে আমার এ খারাপ থাকার শেষ কোথায়!
আমিই সত্যিই ভালো আছি না খারাপ আছি সে বিষয় বিবেচনায় আজ আমি বোধশক্তিহীন নই তবে কিছুটা বিচলিত। কোন কোভ্যাক্স, কোভিশিল্ড, স্পুটনিক-ভি কিংবা সিনোফার্ম টিকার মত প্রতিষেধক টিকা আমার এ বিচলতা দূর করার জন্য যথেষ্ট নয়। বরং আমার সন্তানদের জাগ্রত বিবেকই এর জন্য যথেষ্ট। কেউ কি আছে যে এ বিবেককে জাগ্রত করতে পারে? যে আমাকে উপহার দিতে পারে একটি নির্মল, শিক্ষা ও গবেষণাবান্ধব পরিবেশ।
আজ আমি সত্যিই ক্লান্ত এবং চিন্তিত! আমার বুকের এ রক্তক্ষরণ বন্ধ না হলে, আমার সন্তানদের পড়াশোনা শেষ করে সার্টিফিকেট তোলার বদলে আমার সাথে সাথেই পটল তুলতে যেতে হবে! কোথাও কেউ কি আছেন- যে আমাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ বন্ধ করে, এই “পটল তোলা” থেকে বাঁচিয়ে নিঃশেষের পথে আমাদের এ যাত্রা রুখতে পারেন?
লেখকঃ শিক্ষক ও নাট্যকর্মী
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।