কোন চেতনায় জাগ্রত সন্ত্রাস বিরোধী রাজু ভাস্কর্য?

সানজিদ আরা সরকার বিথী
ঢাবি


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের টি.এস.সি. প্রাঙ্গণ সংলগ্ন অবস্থিত ঢাকার অন্যতম প্রধান একটি ভাস্কর্য রাজু স্মারক ভাস্কর্য;যেটি সকলের কাছে রাজু ভাস্কর্য নামে পরিচিত।

রাজু ভাস্কর্যে নিয়ে অনেকের ভুল ধারনা রয়েছে;অনেকে ভাবে এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীর ধারনা, রাজু ভাস্কর্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একটি স্মারক।

তাই পাঠকদের উদ্দেশ্যে রাজুর দৃপ্তকণ্ঠে সম্মিলিত প্রতিবাদের ইতিহাস আরো একবার তুলে ধরা হল-

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মৃত্তিকা বিজ্ঞানের কৃতি ছাত্র ছিলেন মঈন হোসেন রাজু। যুক্ত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সাথে। এ সময় তিনি ৯০’র স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ঢাবি ছাত্র ইউনিয়নে যুক্ত থাকার সময় প্রথমে তিনি শহীদুল্লাহ হল কমিটির সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সমাজকল্যাণ সম্পাদক এবং ওই বছরই ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন (১৯৯১)।

১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ, দিনটি ছিল শুক্রবার। একজন শিবিরকর্মীর প্রহৃত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাধারণ ছাত্রদের সাথে পুলিশের ঝামেলা হয়। সেখানে রাজু কনুইতে আঘাত প্রাপ্ত হন। তাই বাসায় গিয়ে খাওয়ার কথা থাকলেও বাসায় না গিয়ে চলে যান তার হলের রুমে। শহীদুল্লাহ হলের ১২২ নং কক্ষ। বিকেলে ক্যাম্পাসের দখলদারিত্বের রাজত্ব নিয়ে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের মধ্যে শুরু হয় গোলাগুলি।

ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী রাজু ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্য’র ব্যানারে সংগঠিত সন্ত্রাসবিরোধী মিছিলে যোগ দেন। হঠাৎ সন্ত্রাসীরা সেই মিছিলে গুলি বর্ষণ করে। সন্ত্রাসীদের ছোঁড়া একটা বুলেট রাজুর মাথা ভেদ করে। রাজুর রক্তে রঞ্জিত হয় টি.এস.সি.র সামনের রাজপথ। তাঁর আর ঘরে ফেরা হয় না। সন্ত্রাসীদের হাত থেকে প্রিয় ক্যাম্পাসকে বাঁচাতে চেয়ে নিজেকে উৎসর্গ করে দেন ।

ডাকসুর সংগ্রহশালায় এখনো সংরক্ষিত আছে শহীদ রাজুর রক্তমাখা শার্ট ও ব্যাগ। সেই ব্যাগ, যা গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময় স্লোগানরত রাজুর কাঁধে যে ব্যাগ ছিল আর সেই ব্যাগে ছিল নোটখাতায় নিজ হাতে টুকে রাখা জীবনানন্দের কবিতা এবং রং করার ব্রাশ ও হকিয়ার।
সেই রাজুসহ সন্ত্রাস বিরোধী আন্দোলনের সকল শহীদের স্মরণে নির্মিত হয় সন্ত্রাস বিরোধী রাজু ভাস্কর্য। ভাস্কর্যে বৃত্তাকারে স্থাপিত আটজন নারী-পুরুষ একে অন্যের হাত ধরে হার না মানা প্রতিবাদের অভিব্যক্তি প্রকাশ পাচ্ছে।

যাদের প্রতিকৃতি ব্যবহার করা হয়েছে তারা হলেন সন্ত্রাস বিরোধী আন্দোলনের শহীদ মুনীম হোসেন রানা, শাহানা আক্তার শিলু, সাঈদ হাসান তুহিন, আবদুল্লাহ মাহমুদ খান, তাসফির সিদ্দিক, হাসান হাফিজুর রহমান সোহেল, উৎপল চন্দ্র রায় ও গোলাম কিবরিয়া রনি।

রাজু ভাস্কর্যটি ১৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৯৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এ. কে. আজাদ চৌধুরী উদ্বোধন করেন। এই ভাস্কর্য নিমার্ণে জড়িত শিল্পীরা ছিলেন ভাস্কর শ্যামল চৌধুরী ও সহযোগী গোপাল পাল।

নির্মাণ ও স্থাপনের অর্থায়নে ছিলেন – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক আতাউদ্দিন খান (আতা খান) ও মুন্সিগঞ্জ-বিক্রমপুর সমিতির সভাপতি, লায়ন নজরুল ইসলাম খান বাদল। ভাস্কর্যটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন।

কবি শামসুর রাহমানের রচিত “পুরাণের পাখি” কবিতায় কবি এই ঘটনাটি তুলে ধরেন-

“দিনদুপুরে মানুষ শিকারীরা খুন করেছে তোমাকে। টপকে-পড়া, ছিটকে-পড়া তোমার রক্তের কন্ঠস্বরে ছিল পৈশাচিকতা হরণকারী গান।

ঘাতক নিয়ন্ত্রিত দেশে হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলে তুমি, মধ্যযুগের প্রেতনৃত্য স্তব্ধ করার শুভ শ্লোক উচ্চারিত হয়েছিল তোমার কন্ঠে তোমার হাতে ছিল নরপশুদের রুখে দাঁড়াবার মানবতা-চিহ্নিত প্রগতির পতাকা …”

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ

Leave a Comment