ক্যাম্পাস থেকে ক্যাম্পাসে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি

প্রফেসর ড. আনন্দ কুমার সাহা
উপ-উপাচার্য
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে লালন করার জন্য এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রবাহিত করার জন্য তৈরি হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সব জাতীয় আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ৬ দফা, ’৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন নেতৃত্বে ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

অপরাজেয় বাংলা

ভাস্কর্যের শিল্পী সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। ভাস্কর্য নির্মাণ করতে গিয়ে দু’হাত রক্তাক্ত করে দেশের প্রতি ঋণ শোধ করলাম এভাবেই অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছিলেন শিল্পী আবদুল্লাহ খালিদ।

১৯৭২-৭৩ সালে ডাকসুর উদ্যোগে অপরাজেয় বাংলার কাজে হাত দেয়া হয়। ১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে এর আনুষ্ঠানিক নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৯৭৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে সকাল ৯ টায় ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করা হয়।

ভাস্কর্যের নাম ‘অপরাজেয় বাংলা’ কিভাবে হলো?

দৈনিক বাংলার সাংবাদিক মুক্তিযোদ্ধা সালেহ চৌধুরী সেসময় দৈনিক বাংলাতে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন, যার শিরোনাম ছিল ‘অপরাজেয় বাংলা’। পরবর্তীতে এ নামটিই সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হয়। সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ কাজ শুরু করার কিছু দিনের মধ্যে ঘটে যায় ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ড। ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ স্তিমিত হয়ে যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের দিকে তাক করিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো সেনাবাহিনীর বিধ্বংসী ট্যাংক। যেকোন সময় গুঁড়িয়ে দিতে পারে। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯৭৯ সালের জানুয়ারি মাসে পুনরায় ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ শুরু হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে সকাল ৯:০০ টায় ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করা হয়।

‘অপরাজেয় বাংলা’ ভাস্কর্যটির ভিত্তি অত্যন্ত মজবুত। ১৪০০ মাইল বেগের ঝড় মোকাবিলা করতে সক্ষম, স্থায়ী হবে ভাস্কর্যটি প্রায় হাজার বছর। ভাস্কর্যটিতে তিনজন তরুণের মূর্তি প্রতীয়মান। এদের মধ্যে দু’জন যুবক একজন যুবতী। সর্বডানে ফাস্ট বক্স হাতে কুচি দিয়ে শাড়ী পরা প্রত্যয়ী এক যোদ্ধা নারী সেবিকা।

মাঝে দাঁড়িয়ে আছে- কাঁধে রাইফেল, বা হাতে গ্রেনেড, কাছা দেওয়া লুঙ্গি পরণে এক যুবক- গ্রাম বাংলার জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। আর বাঁ-পাশে জিন্স-প্যান্ট পরা শহরে তরুণ মুক্তিযোদ্ধা, যার হাতে রাইফেল এবং চোখে মুখে স্বাধীনতার দীপ্ত চেতনা।


সাবাস বাংলাদেশ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী
অবাক তাকিয়ে রয়
জ্বলে-পুড়ে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়।

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘সাবাস বাংলাদেশ’ কবিতা অবলম্বনে নামকরণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ‘সাবাস বাংলাদেশ’। শিল্পী নিতুন কুণ্ডু ১৯৯২ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি কংক্রিটে তৈরী ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।

মূল ভাস্কর্যে দুটি ফিগার লক্ষ করা যায়। দুইজন যুবককেই খালি গায়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। একজন লুঙ্গি পরা, মাথায় গামছা বাঁধা গ্রামীণ যুবা- কৃষক সমাজের প্রতিনিধি যার এক হাতে রাইফেল ধরা, মুষ্টিবদ্ধ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অন্য হাতটি উপরে উত্থিত। প্যান্ট পরিহিত অন্য ফিগারটি শহুরে যুবকের প্রতিনিধি- দুই হাত দিয়ে ধরে রয়েছে রাইফেল, কোমরে গামছা বাঁধা, বাতাসের ঝাপটায় চুলগুলো পিছনের দিকে সরে গেছে।

সিঁড়ির উপরে মঞ্চের পিছনের দেয়াল গাত্রে নারী-পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ, সমাজের সকল বয়সের মানুষের মিছিলের দৃশ্য, রাইফেল হাতে যুবক-যুবতী, একতারা হাতে বাউল, গেঞ্জিপরা এক কিশোর তাকিয়ে আছে পতাকার দিকে। মোটকথা, বাংলার জনজীবনের ছবি এঁকেছেন শিল্পী, বুঝিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে গণমানুষের সম্পৃক্ততার কথা।

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করে সমগ্র বাংলাদেশকে ভস্মীভূত করে ফেলতে চায়। কিন্তু বাঙালির দৃঢ় মনোবল, মুক্তির প্রচণ্ড স্পৃহা, সীমাহীন কষ্টভোগ, অসীম ত্যাগের বিনিময়ে ভস্মাবশেষ থেকেই উদ্ভব হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের।


সংশপ্তক ভাস্কর্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯০ সালের ২৬শে মার্চ নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য সংশপ্তক।

এ ভাস্কর্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যুদ্ধে শত্রুর আঘাতে এক হাত, এক পা হারিয়ে ও রাইফেল হাতে লড়ে যাচ্ছেন দেশমাতৃকার বীর সন্তান। ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান।


অদম্য বাংলা, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

শিল্পী গোপাল চন্দ্র পাল। বলিষ্ঠ ও তেজোদীপ্ত চার মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতি আছে এ ভাস্কর্যটিতে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সর্বস্তরের বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের মূর্ত প্রতীক এটি। পুরো মুক্তিযুদ্ধের একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ উপস্থাপনা রয়েছে এই ভাস্কর্যটিতে।

ভাস্কর্যটিতে জাতীয় নেতাদের প্রতিবিম্ব মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বের সুস্পষ্ট একটি চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে।


দুর্বার বাংলা, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

২০১৩ সালে কুয়েটে প্রতিষ্ঠিত হয় দুর্বার বাংলা। এই ভাস্কর্যের ভাস্কর গোপাল চন্দ্র পাল। সম্ভবতঃ ২০১৫ সালে প্রথম দেখি এই ভাস্কর্যটি। ভীষণ ভালো লেগেছিলো। মনে হয়েছিলো কুয়েট ক্যাম্পাসের মূল আকর্ষণ ‘দুর্বার বাংলা’। ইতোমধ্যে কুয়েট চত্বরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চমৎকার একটি শহীদ মিনার।

‘দুর্বার বাংলা’ এক ব্যতিক্রম জীবনীশক্তি। সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়। এই প্রেরণার পিছনে যাঁদের অবদান, তাঁরা সব সময় আমাদের কাছে স্মরণীয়। আমরাও যেন তাঁদের মতো হতে চেষ্টা করি, সেই শক্তি দেয় এই ভাস্কর্য।

মুক্তিযুদ্ধের উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে ভাস্কর্য। এই ভাস্কর্যগুলো শুধু ভাস্কর্যই নয়, প্রতিবাদের সাহসী প্রতীক। ভাস্কর্যগুলোর মাধ্যমে শিক্ষার্থী-দর্শনার্থীরা দেশের জাতীয় আন্দোলন সম্পর্কে জানতে পারে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জাগ্রত হয় দেশপ্রেম, নিজের অধিকার আদায়ের চেতনা।

কৃতজ্ঞতা:
১. জনাব জাহিদ হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
২. জনাব বণি আদম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
৩. জনাব সুপ্রভা হক, কুয়েট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *