গণতন্ত্রের ব্যর্থতা তার আপন পালিতপুত্র পুঁজিবাদে: প্রতিযোগিতামূলক একনায়কতন্ত্র ও বিশ্বশান্তি

সাজ্জাদ হোসেন


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময় কলোনী শাসন ভেঙ্গে অনেক দেশ স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে।

পরাধীনতার শিকল ছিড়ে জাতিরাষ্ট্র গুলো নব্য শাসন পদ্ধতি হিসাবে গণতন্ত্রকেই বেছে নিয়েছে কারণ পরাধীনতা থেকে মুক্তি পেতে সেদেশের রাজনৈতিক সকল দল এবং আপামর জনসাধারণ অংশ নিয়েছে।

তারপরও কি গনতন্ত্র সেসব দেশের জনগণকে স্বাধীনতা-উত্তর স্বদেশী শাসকদের পরাধীনতা থেকে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক বৈষম্য লাঘব করে মুক্তি দিতে পেরেছে? পারিনি।

এত দিনে যেহেতু ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত পৃথিবী গড়তে পারিনি তাহলে আর গনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সফলতার সলতে আর কত প্রহর পর্যন্ত জ্বলবে অনুমান করা যায়।

গণতন্ত্রের সুবিধাভোগীরা একে একটি আদর্শ শাসন ব্যবস্থা হিসাবে প্রচার করেছে কারণ গণতান্ত্রিক শাসনের অধীনে অপবাদ না মেখেও চার/বছর স্বেচ্ছাচারিতা চালানো যায়। একবার নির্বাচিত হতে পারলে পরের নির্বাচন পর্যন্ত বিশ্বনেতাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত হয়ে যায় তাই জবাবদিহিতা করেনা শাসকরা।

রাষ্ট্রের সব নাগরিক তো সমান যোগ্যতা সম্পন্ন এবং সমান সচেতন না এজন্য ভোটারদের সংঘবদ্ধ হতে দেখা যায় না। মাথাচাড়া দিলেই শাসকগোষ্ঠী তাদের নিজেদের দলে নিয়ে নেয় এজন্য কোন শ্রমিকনেতা, নেতা হলে আর শ্রমিক থাকেনা।

গণতন্ত্র পুঁজিবাদের ফাঁদে পা দিয়ে বিষ হারা কেউটে হয়ে গেছে। নামেমাত্র জনগণের অধিকার অধিকার করে ফোঁসফোঁস করতে পারে কিন্তু পুঁজিপতিদের কামড়ানোর সামর্থ্য ও সাহস নেই। পুজিবাদী অর্থব্যবস্থা লাভের সর্বোচ্চকরণে অটল। অপরদিকে গনতন্ত্র সব জনগণকে সমান হিসাবে প্রচার করে। কিন্তু লাভের সর্বোচ্চকরণ ঘটলে কি সমাজে সমতা আদৌ সম্ভব?

এই অসমতার জন্য রাষ্ট্রের সকল নাগরিক সমান ভাবে বেড়ে উঠতে পারেনা। ফলে মৌলিক অধিকারের প্রশ্নেও তারা সজাগ না। তাই গনতন্ত্রের নামে পুঁজিপতিরা তাদের শাসন করে।

জনগণের কাছে জবাবদিহিতা হলো, “প্রতিনিধি খারাপ হলে ভোট দিলে ক্যান “। পরবর্তী বছর আসতে আসতে এই শোক কেটে জনগণ কষ্টের ভাগ্য মেনে নেয় স্বাভাবিকভাবে।

পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা থাকলে গনতন্ত্র কখনো জনগণের মুক্তি দিতে পারে না। (যদিও আমি পুঁজিবাদে বিশ্বাসী তবে অন্য শাসন ব্যবস্থায়)।

পুজিবাদের ছায়ায় গণতন্ত্রের যে ভোট হয় তা ব্যবসায়িক বিনিয়োগ বলা চলে।পুঁজিপতিরা নির্বাচনকে এমন ব্যবসায়িক বাজার তৈরি করেছে সেখানে গরীবদের অংশগ্রহণ সম্ভব হয়না নির্বাচনের খরচ ব্যয় করার অসামর্থ্যতার কারণে।

পুঁজিপতিরা এই বিনিয়োগ করে কারণ নির্বাচন-উত্তর এই সকল বিনিয়োগকৃত অর্থ তুলে নিতে পারবে সেজন্য। এভাবেই চেয়ারম্যান, মেম্বার তথা জনপ্রতিনিধিরা তাদের চিরচেনা চরিত্র অংকন করেছেন।

এত এত অসংগতি যদি থাকে তাহলে কি জনগণের মুক্তির মাধ্যমে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়? প্রশ্ন আসতেই পারে। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গনতন্ত্র ও পুঁজিবাদ দুটির সরলরৈখিক চলমানতা থামাতে হবে আসলে তারা বিপরীত ধর্মী।

পুঁজিবাদ অর্থব্যবস্থা হিসাবে এমন ভাবে পাকাপোক্ত অবস্থানে বসেছে আপাতদৃষ্টিতে তার পতনের কোন পথ দেখিনা এই বাকস্বাধীনতা আর ব্যক্তি-স্বাধীনতাকামী সমাজে। তাহলে গণতন্ত্র যেহেতু আশার বাতি জ্বালাতে পারিনি তাই গণতন্ত্রের পতন খুব কাছাকাছি বলা যায়। গণতন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় গেলেও বিশ্বনেতাদের আচরণ আপাতত সেই আভাস দিচ্ছে।

বিশ্বনেতাদের শাসন ব্যবস্থার স্বেচ্ছাচারী মনোভাব পুঁজিবাদের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারলে বিশ্বে কিছুটা শান্তি মিলতে পারে। কেননা পুঁজিপতিরা যে পুঁজির পাহাড় গড়ে তোলে তা গনতান্ত্রিক উপায়ে জনগণের দাবি করার উপায় নেই আবার ক্ষমতায় থাকতে গেলে গনতান্ত্রিক শাসককে অবশ্যই পুঁজিপতিদের দরকার।

তাই গণতন্ত্র পুঁজিপতিদের দমনে ব্যর্থ। তাহলে এমন ধরণের একনায়কতন্ত্র দরকার যা পুঁজিবাদ থাকলেও প্রয়োজন মত ব্যক্তি সম্পদ রাষ্ট্রীয় করতে পারে বা পুঁজিবাদের নতুন রুপ দিতে পারে।

গণতান্ত্রিক শাসনে শাসকরা জনগণের কাছে জবাবদিহি করবে যা বাস্তবে অসম্ভব কারণ ক্ষমতাহীন জনগণের কাছে জবাবদিহিতা ইতিহাসে ছিলনা বর্তমানেও নেই।

গণতন্ত্রের চেহারা বোঝার জন্য আমাদের রাজা-প্রজার সম্পর্ক দেখলে বোঝা যায় যেখানে শুধু ক্ষমতা গ্রহণ হয় ভিন্ন প্রক্রিয়ায় বাকি সব একই। প্রজারাও শোষিত আবার গণতন্ত্রে জনগণও শোষিত তাহলে পার্থক্য কোথায়। রাজারা যেমন ইচ্ছামত শাসন ব্যবস্থা বা অর্থনীতিতে পরিবর্তন করতো, খাজনা বাড়াতো, নিত্যনতুন নীতিমালা প্রণয়ন করতে বিশ্বনেতারা কি কেউ ভিন্নপথে আছেন?

বিশ্বশান্তির জন্য জনগণের সাথে শাসকের এই সম্পর্ক এতটা মুখোমুখি হলে তা কার্যকর ফল আনতে পারবে না। এজন্য একনায়কতন্ত্রের কিছুটা পরিবর্তন দরকার। প্রতিযোগীতামূলক একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রয়োজন। এই শাসন ব্যবস্থায় শাসককে যোগ্য হতে হবে। অযোগ্য হলে তার প্রতিপক্ষের কাছে তার পরাজয় হবে। যোগ্যতার মাধ্যমে টিকে থাকতে হবে। আর শাসক যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তাহলে জনগণ চাইলে একনায়ক ব্যতিত রাষ্ট্রের সকল পক্ষকে সাথে পাবে।

আসলে জনগণের সাথে শাসকের জবাবদিহিতা নয় শাসকের সাথে শাসকের জবাবদিহিতায় জনগণের শান্তি আসবে। গণতন্ত্রের সাথে পুঁজিবাদ মিশে আছে জন্য বিরোধীদলের কাছে জবাবদিহিতা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি আর পুঁজিবাদের জন্যে জনগণও নিজেদের গণতন্ত্রের যোগ্য নাগরিক তৈরী করতে পারিনি।

লেখক: সাজ্জাদ হোসেন, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *