এমদাদুল হক সরকার
গুজব শব্দটার সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে নানা কারণে নানা প্রকারের গুজব ছড়ানো হয়েছে। পদ্মা সেতুতে লাগবে শিশুর মাথা; নিখোঁজ হয়ে গেছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট; ডেঙ্গু প্রতিরোধে হারপিক; সাইদী চাদে; রং চা, অ্যালকোহল, থানকুনি পাতায় করোনা সারবে – এমন সব গুজব ছড়িয়েছে বাংলাদেশে৷
“গুজব” যার ইংরেজীতে অর্থ অনেক- Rumor,Gossip, Bruit, propaganda । এসব শব্দকে বিভিন্ন দেশের ভাষাভাষীরা বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করলেও এর মূলকথা- “গুজব”।
গর্ডন অলপোর্ট ও লিও পোস্টম্যানের মতে, গুজব বলতে সেই সমস্ত বিশ্বাসকে বোঝায় যে সমস্ত বিশ্বাস কোনও প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও তা মানুষের কথার মাধ্যমে সমাজে ছড়িয়ে পড়ে।
এর জন্ম অনেক অনেক কাল আগে। লিখিত ইতিহাসে ৫১৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ইরানের বহিস্তান শিলালিপিতে এর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ভারতের পণ্ডিত চাণক্য (৩৭১-২৮৩ খ্রিষ্টপূর্ব) এই ‘উদ্দেশ্যপূর্ণ প্রচার’ নিয়ে খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তাঁর জীবদ্দশায় আলোচনা করে গেছেন বিস্তর। প্রায় প্রতিটি দেশ নিজেদের প্রয়োজনে গুজব ছড়িয়েছে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়।
ব্রিটিশরা তাদের চিরকালের জুজু রুশদের ভারত আক্রমণ নিয়ে গুজব ছড়াত এককালে। আর ব্রিটিশদের ছড়ানো রাশিয়াবিরোধী এই গুজবের সূত্র ধরে বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জীবনের প্রথম চিঠি লিখেছিলেন বালক রবীন্দ্রনাথ।
‘এটি গোয়েবলসীয় মিথ্যা’ কিংবা ‘এটি গোয়েবলসীয় মিথ্যাকেও হার মানাবে’—এমন একটা কথা আমরা প্রায়ই লোকমুখে বা বই পুস্তকে শুনে থাকি। প্রশ্ন আসতে পারে কে এই গোয়েবলস? অবাক হলেও সত্যি তিনি ছিলেন একজন “গুজব পরিচালনা” মন্ত্রী।
প্রোপাগান্ডা বা গুজব শব্দটি শুরুতে একটি ইতিবাচক শব্দ ছিল। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা পরিকল্পিতভাবে তাদের সেনা এবং জনগণের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের প্রেষণা যোগানোর জন্যে এর ব্যবহার শুরু করে। এডলফ হিটলারও বুঝতে পেরেছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের এমন পরাজয়ের কারণ আর কিছু নয় বরং ব্রিটিশদের এমন গুজব ছড়ানো।
তাই হিটলার আলাদা মন্ত্রণালয় খোলেন এই প্রোপাগান্ডা রুখতে। নাম দেন “মিনিস্ট্রি অব পাবলিক এনলাইটেনমেন্ট এন্ড প্রোপাগান্ডা”। আর এর প্রধান করেন তার সরকারের সাবেক তথ্যমন্ত্রী “দ্য লিটল ডক্টর” নামে পরিচিত গোয়েবলসকে, যিনি প্রোপাগান্ডা শব্দটিকে নিয়ে গিয়েছিলেন অনন্য উচ্চতায়।
আর তাই এখনো পৃথিবীজুড়ে প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যাপক জনপ্রিয় “গোয়েবলসীয় কায়দা”। একটা মিথ্যাকে বারবার সোচ্চারে বললেই সেটা সত্যি হয়ে যায় প্রচারের এই কৌশলকে “গোয়েবলসীয় কায়দা” বলে।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও বাংলার আকাশে-বাতাসে ছিল গুজবের ছড়াছড়ি। জাহানারা ইমামে ‘একাত্তরের দিনগুলি’ এর ৩০ মার্চের ডায়েরিতে লিখেছেন, “দিনরাত কি এক দুঃস্বপ্নের ঘোরে কাটছে। আর গুজবই যে কতো। একটা করে গুজব শুনি আর ভয়ে আঁতকে উঠে হুটোপুটি লাগিয়ে দিই।”
১০ এপ্রিলের ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন, “স্বাধীন বাংলা বেতারের বরাত দিয়ে আকাশবাণী যত খবর বলে, সব বিশ্বাস করতে মন সায় দেয় না। ওদের কিছু খবর ভুল প্রমাণিত হয়েছে। নীলিমা ও সুফিয়া আপার মৃত্যু সংবাদটা ভুল ছিল।”
ঐতিহাসিকভাবে প্রতিটি মহামারির সময় গুজব এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ যেভাবে ছড়িয়েছে ঠিক একইভাবে এই ভাইরাসকে কেন্দ্র করেও নানা ধরনের ভুল খবর এবং মিথ্যা তথ্যও ছড়িয়েছে সমানতালে।
করোনা ভাইরাস নিয়ে নানারকম ‘গুজব মহামারি’ চলছে বলে উল্লেখ করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। করোনা নিয়ে বিশ্বজুড়ে ছড়ানো নানামুখি গুজবের বিষয়টিকে ‘মিসইনফো-ডেমিক’ বলে আখ্যায়িত করে একইসঙ্গে এর বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দিকেও দৃষ্টিপাত করেছেন তিনি।
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ওরহান পামুক মার্কিন সংবাদ মাধ্যম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত নিবন্ধে বলেন, মহামারীর সময় আরেকটি সার্বজনীন প্রতিক্রিয়া হলো গুজব এবং ভুল তথ্য ছড়ানো। অতীতের মহামারীগুলোতে গুজব ছড়িয়েছে কারণ তখন সঠিক তথ্য পাওয়া ও সামগ্রিক পরিস্থিতি দেখতে পারাটা ছিল অসম্ভব।
বর্তমান বিশ্বে গোয়েবলসীয় কায়দায় গুজব রটছে। করোনায় সবচেয়ে বেশি গুজব ছড়িয়েছে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নানা ধরনের ভুয়া পরামর্শ। করোনাভাইরাস ঠেকাতে নানা ধরনের স্বাস্থ্য পরামর্শ দেখা যাচ্ছে – যেগুলো প্রায়ই হয় অপ্রয়োজনীয় নয়তো বিপজ্জনক।
বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। করোনা মুক্তিতে থানকুনি পাতা, আজান দেয়া, রং চা, অ্যালকোহল পান, সহ নানা গুজব ছড়িয়েছে। শুধু স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয় নয়, করোনা-ভাইরাসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রুপ এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকেও ভুয়া খবর ছড়ানো হয়েছে। করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা নিয়েও চলছে গুজব। আবার সুস্থ্য ব্যক্তিকে করোনা আক্রান্ত বলে গুজব ছড়ানোয় হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে অনেককে । ফলে জনমনে ভীতি সঞ্চার করেছে।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক চলছে। এপ্রিলের প্রথম দু সপ্তাহে প্রায় ৫০জনকে আটক করা হয়েছে। তবু থামছে না গুজব।
ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে মুহুর্তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথ্য একে অপরকে জানানো যায়। হাজার হাজার তথ্যের ভীরে কোনটি সত্য আর কোনটি মিথ্যা যাচাই না করেই ছড়িয়ে দেয় অনেকে। ফলে দ্রুত গুজব ছড়িয়ে পড়ে। অনেক সময় মানুষকে সচেতন করতে কোন খবর দ্রুত জানাতে গিয়েও গুজব ছড়ানো হচ্ছে। আর গুজব তখন নিয়ে আসে চরম বিপর্যয়। এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো হিটলারের মতো গুজব রটানো বন্ধ করতে “মিনিস্ট্রি অব প্রোপাগান্ডা” খুলতে হবে।
তথ্যসূত্র: ১। বিবিসি। ২। প্রথম আলো। ৩। উইকিপিডিয়া। ৪। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনস্মৃতি, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, ১৩১১। ৫। ‘একাত্তরের দিনগুলি’, জাহানারা ইমাম।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।