ছাত্র রাজনীতির ভবিষ্যৎ
মোঃ রিয়াজ উদ্দীন রেজা
ছাত্র রাজনীতি হলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের কল্যাণে নিয়োজিত, অধিকার আদায়ে সোচ্চার, ইতিবাচক সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে নিযুক্ত, ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে থেকে সর্বদা হীনস্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থানকারী, শিক্ষাঙ্গনে দূর্নীতি অনিয়ম প্রতিরোধে অকুতোভয়, ক্যাম্পাসে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য নীতিবান আর ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব সৃষ্টির বাতিঘর বা কারখানা।
যদিওবা বর্তমানে চর্চিত ছাত্র রাজনীতির ধারা ভিন্ন। তবুও এদেশের ইতিহাসে ছাত্র রাজনীতির বর্ণাঢ্য অতীত রয়েছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে, ৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ এর ৬ দফা দাবি আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচন, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে স্বাধীকার আদায়ে স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে দেশ রক্ষার আন্দোলনে এদেশের ছাত্র সমাজ তথা ছাত্র রাজনৈতিকবৃন্দ উল্ল্যেখযোগ্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। অতএব একথা বলা যায়, অতীতের ছাত্র রাজনীতি ছিল দেশের স্বার্থ নির্ভর, দেশের কল্যাণ নির্ভর, আদর্শ এবং নীতি নির্ভর।
কিন্তু বর্তমানে এমন আদর্শিক রাজনৈতিক চর্চার ক্ষুদ্র অনুপস্থিতি তথা ব্যত্যয় এর অন্যতম কারণ ক্ষমতার মোহে শিক্ষার্থীদের ছাত্র রাজনীতিতে আগমন। এছাড়া নৈতিক শিক্ষার অবক্ষয়ও নানাবিধ অরাজকতা বৃদ্ধির সাথে যুক্তিযুক্ত।
যদিওবা চলমান ছাত্র রাজনীতির অশুভ ধারা সুশীল সমাজের কিছু সুক্ষ্ম ষড়যন্ত্রের দৃষ্টান্ত স্বরূপ। তবুও বলাবাহুল্য নীতি, নৈতিকতা, আদর্শ এগুলো ফাঁকা বুলিতে পরিণত হওয়ায় দিনদিন কতিপয় অসামঞ্জস্যতাগুলো সামগ্রিক সমস্যায় পরিণত হচ্ছে।
এমন নয় যে, একজন শিক্ষার্থী ছাত্র রাজনীতি করলে তাকে পরবর্তীতে রাজনীতিটাই করে যেতে হবে কিংবা তাকে রাজনৈতিক নেতা হতে হবে। রাজনৈতিক নেতা ছাড়াও একজন ব্যক্তি দেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাস্তবে ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে সমাজে নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলী সম্পন্ন একটি শ্রেণী গড়ে ওঠে।
এই নেতৃত্বের গুণাবলীর মাধ্যমে একজন ব্যক্তি পরবর্তীতে শিক্ষকতায়, চিকিৎসায়, সাংবাদিকতায়,ব্যবসায়, বিচার বিভাগে, প্রশাসনসহ রাষ্ট্র ও সমাজের সব ক্ষেত্রে তথা দেশ গঠনে এবং কল্যাণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। আমরা জানি প্রতিটি পেশায় সফলতার জন্য ম্যানেজমেন্ট ও নেতৃত্ব গুণ অতীব জরুরি।
ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে এই ম্যানেজমেন্ট ও নেতৃত্ব গুণের বিকাশ ঘটে থাকে। আবার ব্যক্তিজীবনে, পেশাগত জীবনে সর্বোপরি জাতীয় জীবনে একজন মানুষের জন্যে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাই সব থেকে বড় গুণ হিসেবে পরিগণিত হয়। আর এটা সৃষ্টি হয়ে থাকে নেতৃত্বের ট্রেনিং মাধ্যমে। আর এই ট্রেনিংয়ের ক্ষেত্রে ছাত্র রাজনীতি সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে থাকে।
আমরা জানি,মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। স্থায়ী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, খাদ্যে স্বনির্ভরতা, নারীর ক্ষমতায়ন, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্রামীণ অবকাঠামো, যোগাযোগ, জ্বালানী ও বিদ্যুৎ, বাণিজ্য, আইসিটি এবং এসএমই খাতে এসেছে ব্যাপক সাফল্য।
এছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার, পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি সম্পাদন, একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতিসহ জাতীয় জীবনের বহুক্ষেত্রে এসেছে অভাবনীয় সাফল্য। এসব সম্ভব হয়েছে দেশরত্ন শেখ হাসিনার বিচক্ষণ, দূর্দান্ত, দুরাদর্শি , ডায়নামিক নেতৃত্বের ফলে। আর এসবের নেপথ্যেও রয়েছে কিন্তু ছাত্র রাজনীতি। তিনি ছাত্র রাজনীতির ‘প্রডাক্ট’।
তিনি যে বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার মতো সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন, সেটারও কারণ ছোটবেলা থেকে ছাত্র রাজনীতি তাঁকে নেতৃত্ব শিখিয়েছে। একমাত্র নেতৃত্বের গুণাবলীই মানুষকে অসম্ভব থেকে সম্ভবের দিকে যাওয়ার সাহস জুগিয়ে থাকে।
এটা স্বীকার্য সত্য,প্রজম্মের কাজ ওই প্রজম্মকেই করতে হয়। তাই শুধুমাত্র সাময়িক প্রাপ্তিকে বড় মনে না করে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ স্বার্থ নির্ভর ছাত্ররাজনীতি চর্চার সুষ্ঠু ধারা আমাদেরকেই ফিরিয়ে আনতে হবে।
বর্তমান প্রজম্মকে ভাবতে হবে, আমাদের পূর্বসূরিরা যদি নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করে স্বাধীনতা এনে দিতে পারে, সামরিক স্বৈরাচার দূর করতে পারে, তাহলে আমরা কেন একটি ভালো ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের জন্যে নিজেদের উৎসর্গ করতে পারব না।
বর্তমানের তরুণরা যদি এ কাজ না করে তাহলে ভবিষ্যতে আধুনিক রাষ্ট্রকেন্দ্রিক নেতৃত্বে শূন্যতা নেমে আসবে। নানা ধরনের মৌলবাদী বা পশ্চাৎপদ গোষ্ঠী ওই সুযোগে রাষ্ট্র দখল করবে।আধুনিক বাংলাদেশ রক্ষা করতে হলে স্বাধীন দেশের স্বাধীন ছাত্র রাজনীতি তরুণ প্রজম্মকে করতেই হবে।
আর সেজন্য ছাত্র রাজনীতিকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতা তৈরির কারখানার কালচার থেকে বেরিয়ে ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে নেতৃত্বের ট্রেনিং প্রদানের মাধ্যমে দেশ গঠনের কারিগর বিনির্মাণে মনোযোগ দিতে হবে।
দেশের প্রতিটি সেক্টরে যদি দক্ষ নেতৃত্বের পুনর্বাসন করা যায়, তাহলে দেশের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবে। সেলক্ষ্যে ক্ষমতার মোহ নির্ভর মরীচিকার ছাত্ররাজনীতি থেকে বেরিয়ে মেধা ভিত্তিক আদর্শ ও নীতি নির্ভর ছাত্র রাজনীতি বাস্তবায়ন করা সময়ের দাবি।
তাই ছাত্র রাজনীতিকে আরো বেশি শিক্ষার্থী বান্ধব, আরো বেশি মানবিক, আরো বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক তথা শিক্ষার মান উন্নয়ন কেন্দ্রিক করতে হবে। এবং ছাত্র সংগঠনগুলোকে নেতৃত্বের ট্রেনিং এর জন্য নানাবিধ কর্মসূচি, কর্মশালা ও সেমিনার আয়োজনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ – ই একমাত্র ছাত্র সংগঠন যে সংগঠনের নেতাকর্মীরা ইতিহাসের প্রতিটি আন্দোলন, লড়াই – সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে।
দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগেরই ১৭ হাজার নেতাকর্মী শহীদ হওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেটা ইতিহাস বিবেচনায় আসলেই বিরল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রলীগকে নিয়ে বলেছিলেন, “ছাত্রলীগের ইতিহাস, বাঙালির ইতিহাস”।
তিনি যথার্থই বলেছিলেন। আমি মনে করি, একুশ শতকের চলমান রাজনীতির বিপরীতে ছাত্র রাজনীতিকে নার্সিং করে সুষ্ঠু ধারায় প্রবাহিত করার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং সাফল্য অর্জন করার কৃতিত্ব একমাত্র ছাত্রলীগের রয়েছে। ছাত্রলীগ যেমন অতীতের সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে গৌরবের সাথে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে, তেমনি চলমান ছাত্র রাজনীতিকে সুষ্ঠু ধারায় প্রবাহিত করার সাংগঠনিক সক্ষমতা একমাত্র ছাত্রলীগই রাখে।
একটি উন্নত নেতৃত্বগুণ সম্পন্ন, সুষ্ঠু ছাত্র রাজনীতি চর্চা নির্ভর, নীতি ও আদর্শ কেন্দ্রিক রাজনীতি নির্ভর উন্নত ও আধুনিক বাংলাদেশের প্রত্যাশায়।
লেখক
মোঃ রিয়াজ উদ্দীন রেজা
কর্মী, যশোর জেলা ছাত্রলীগ।