জয় বাংলা আম্রকানন: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

একটি ত্রিভুজ প্রয়াস

প্রমত্তা পদ্মার তীরে সুবিস্তৃত মতিহার প্রাঙ্গন। প্রিয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে কৃষি অনুষদের নিকটেই বিশ্ববিদ্যালয় কবরস্থান। পাশেই যে ক্যাম্পাসের এত বিস্তীর্ণ জায়গা! অনেকেরই হয়তো জানা নেই; জানা ছিলনা আমাদেরও। শেষ যেবার গিয়েছিলাম সেবারই প্রথম জেনেছি। একেবারে পশ্চিমপ্রান্তে বলে স্থানীয় লোকজন ছাড়া ছাত্র-ছাত্রীদের যাতায়াত-ও বেশ কম।

দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকার পর ‘কৃষি প্রকল্প- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়’ এর উদ্যোগে এখানেই গড়ে তোলা হয়েছে সুবিশাল আমের বাগান। রয়েছে ল্যাংড়া, ক্ষীরসাপাত এবং আম্রপালি সহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ৪৫০ টি আমগাছ। নামটিও রাখা হয়েছে অসাধারণ- ‘জয় বাংলা আম্রকানন’। ‘জয় বাংলা’- শব্দ মাত্র দুটো। অথচ ভাবের ব্যাপ্তি ও গভীরতায় অসীম।

১৯৭১ সালের ৭ ই মার্চ। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ভাষণের সমাপ্তি টেনেছিলেন এই দুই শব্দে। তারপর ক্ষুরধার শব্দ দুটি পরিনত হয় বাঙালী জাতির প্রেরণায়। তীব্র, সুসংহত ও তাৎপর্যপূর্ণ স্লোগানটিতে প্রকাশ পায় রাজনীতি, সংস্কৃতি, দেশ, ভাষার সৌন্দর্য ও জাতীয় আবেগ।
‘আম্রকানন’-এই শব্দটিও ঐতিহাসিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। রয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ ইতিহাস। ১৯৭১ সালে ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুর এ বৈদ্যনাথবাবুর আম্রকাননে স্বাধীন বাংলার প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করেন। পাঠ করেন স্বাধীনতার ঘোষনা পত্র। ‘জয় বাংলা’ এবং ‘আম্রকানন’, ঐতিহাসিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই শব্দগুলোর প্রাসঙ্গিক যোগকে মাথায় রেখে নামকরনের এমন মুনশিয়ানা সত্যিই অসাধারণ। এ যেন ইতিহাসের-ই ‘প্রকৃতি-পাঠ’। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় কে সবুজ চাদরে আবৃত করার এক মহৎ প্রয়াস। ইতোমধ্যে তরুণ গাছগুলো-ও বেশ পরিনত হয়ে উঠেছে। পাখপাখালির কলকাকলি আর পাশে থাকা পুকুরে মেঘহও (Stork Billed Kingfisher), পাতি মাছরাঙার ছুটোছুটি; পানকৌরির জলকেলি আর বাগানের ভেতরে চরে বেরানো অসংখ্য সাদা বক মুগ্ধ করছে প্রকৃতি প্রেমিকদের। খুব শীঘ্রই আম্রমুকুলের মিষ্টি সুবাসে ভরে উঠবে চারিদিক।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি প্রকল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ বোধও জাগাচ্ছে সবার মনে। উন্নয়ন বলতে শুধু কনক্রিটের-ই উন্নয়ন নয়; প্রকৃতিকে রক্ষা করা, প্রকৃতির যত্ন নেয়া-ও উন্নয়নের-ই একটি বিশেষ দিক। রাজশাহী মহানগরী তে আবহাওয়া বরবরই একটু রুক্ষ। ইট পাথরের এই নগরে গ্রীষ্মকালে প্রচন্ড গরম থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষিপ্রকল্প যেভাবে বৃক্ষরোপন কার্যক্রম অত্যন্ত যত্নের সাথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাতে এখানে থাকা ছাত্রছাত্রীসহ নগরবাসী প্রাণ ভরে শ্বাস নেয়ার একটি স্থান পাবে।

আম্রকাননের পাশ দিয়েই রাজশাহী সিটি করপোরশনের ফ্লাইওভার ও প্রশস্ত রাস্তার নির্মান কাজ চলছে। ফ্লাইওভারটি চালু হয়ে গেলে এর উপর থেকে মানুষ চোখ জুড়ানো মনোমুগ্ধকর দৃশ্যও দেখতে পারবে। এতে যে কেউ প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয় এর সৌন্দর্য দেখে অভিভুত হবেন। শুধু পশ্চিম প্রান্তিকই নয়, পূর্ব প্রান্তিক পর্যন্ত পুরো ক্যম্পাসেই চলছে সবুজায়নের এমন মহা কর্মযজ্ঞ।

বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মদিনে ‘শতবর্ষে শতপ্রাণ’ নামে বনায়ন কিংবা জননেত্রী শেখ হাসিনার ৭৪তম জন্মদিনে ‘শান্তিবৃক্ষ’ রোপন, সফেদা বাগান, আমলকি বাগান, ঔষধি বাগান এর মতো এমন উদ্যোগ গুলো একান্ত প্রকৃতি অনুরাগী না হলে হয়তো সম্ভব হতো না। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়তাম ক্যাম্পাসের পাখি নিয়ে আমরা কাজ করতাম। সে সময় আমরা ক্যাম্পাসে দেশীয় ফলজ গাছের প্রয়োজনীয়তা খুব অনুভব করতাম।

দীর্ঘ দশ বছর পরে ঘুরতে গিয়ে ক্যাম্পাসে এমন মহৎ উদ্যোগগুলো আমাদের খুবই আপ্লুত করেছে। ছাত্রাবস্থায় ক্যাম্পাসের একেবারে পুর্বপ্রান্তে ফায়ার সার্ভিসের পেছনে থাকা বৃক্ষাচ্ছাদিত ছোট অরণ্যে পাখি দেখতে যেতাম। শাহবুলবুলি (Asian Paradise Flycatcher), পাপিয়া (Pied Cuckoo), চোখগেলো (Common Hawk Cuckoo), কোকিল (Asian Koel) সহ অসংখ্য পাখির বিচরণ ভুমি ছিল স্থানটি। পাশে আখ কিংবা ধঞ্চে চাষ হতো। দেরিতে হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের নজর পড়েছে স্থানটির উপর। অরণ্যটির নামকরণ করা হয়েছে ‘মতিহার উদ্যান’। রোপন করা হয়েছে নিম, খয়েরসহ বিভিন্ন ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছ।

‘কৃষি প্রকল্প- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়’ এর এমন উদ্যোগে এভাবেই প্রিয় ক্যাম্পাসটি দৃষ্টিনন্দন একটি বৃক্ষরাজ্যে পরিনত হচ্ছে। ক্যাম্পাসের এই সবুজ শ্যামল প্রকৃতি দেখে কমবেশি সবাই প্রকৃতি সম্পর্কে কৌতুহলি হচ্ছে; পরিচিত হচ্ছে নতুন নতুন বৃক্ষের সাথে। যেমন আমরাও এখানে প্রথম খয়ের গাছ দেখেছি; দেখেছি হরিতকি, বহেরা, নাগেশ্বর (Ceylon Ironwood) সহ আরো অনেক গাছ। খুব যত্ন করে রোপন করা রক্তকাঞ্চন গুলো-ও দৃষ্টি রাঙানোর অপেক্ষায়।

শীত পেরুলেই আসছে বসন্তে পলাশ, শিমুল ও রক্তকাঞ্চন রাঙানো রঙিন ক্যাম্পাস এর রুপ মুগ্ধ করবে সবাইকে। তাই, পেছনের মানুষ যারা কৃষি প্রকল্পের আওতায় এমন উদ্যোগ গুলো নিয়েছেন, যারা প্রিয় ক্যাম্পাসকে আমাদের গর্বের সম্পদে পরিনত করার মহান ব্রত নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন তাদের জানাই গভীর শ্রদ্ধা। শুভ কামনা সবসময়।

হুমায়ন কবির, সায়েম খান, তারিকুজ্জামান তপু
…একটি ত্রিভুজ প্রয়াস
https://www.facebook.com/trivuj2020

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ

Leave a Comment