মো: বিল্লাল হোসেন
গতকাল (১৬ই জুন ২০২০ তারিখে) বিশ্ব মিডিয়ায় প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস এর ঔষধ হিসেবে ‘ডেক্সামিথাসোন’ আবিষ্কার হয়েছে এই নিউজটি ফলাওভাবে প্রচার করা হয়।
ডেক্সামিথাসোনকে করোনার বিরুদ্ধে কার্যকরী ঔষধ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে সংবাদমাধ্যমগুলোতে। যেহেতু ১৯৫৭ সালে এই ঔষধটি সর্বপ্রথম আবিষ্কার হয় এবং ১৯৬১ সালে ঔষধটি ব্যবহারের অনুমতি প্রাপ্ত হয় তাই অনেক আগে থেকেই এই ঔষধটি বাজারে বিদ্যমান রয়েছে।
এছাড়া ঔষধটির দামও তুলনামূলক কম ফলে যে কেউ ঔষধটি যেকোন সময় কিনতে পারেন বাজার থেকে। গতকাল করোনভাইরাসের ঔষধ হিসেবে ‘ডেক্সামিথাসোন’ কার্যকরী এই সংবাদটি মিডিয়ায় আসার পর বাংলাদেশের ফার্মেসীগুলোতে এটি কেনার হুজুগ পড়ে যায়। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ঔষধ ক্রয় একটি মারাত্বক ভুল।
ঔষধের ভুল বা অযাচিত ব্যবহারের ফলে মৃত্যু হতে পারে যে কোন সময়। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত আগে ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানা এবং ডাক্তারের পরামর্শ মতো ঔষধ সেবন করা। এবার তাহলে এই ঔধধটি আসলে কিভাবে কাজ করে সেটি জেনে নেয়া যাক। ডেক্সামিথাসোন ঔষধটি একটি হরমোন জাতীয় ঔষধ।
এটি কর্টিকোস্টেরয়েড নামক স্টেরয়েড হরমোন যা অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি থেকে সংশ্লেষণ করা হয়। এই ঔষধটি মূলত করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর শরীরে “সাইটোকাইন স্টোর্ম” প্রতিরোধ বা প্রশমিত করার উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করা হয়।
কোনো ব্যক্তি যদি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহলে তার শরীরের শ্বেত রক্তকণিকা (দেহের অভ্যন্তরে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করলে মেরে ফেলতে বা কার্যক্ষমতা নষ্ট করতে সহায়তা করে) প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি উৎপন্ন হয়। এবং এই অতিরিক্ত শ্বেত রক্ত কণিকা অতিরিক্ত সাইটোকাইন (একধরনের রাসায়নিক, কোষ থেকে কোষের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে অর্থাৎ মেসেনজার হিসেবে কাজ করে) উৎপাদন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে।
দেহের এর অতিরিক্ত সাইটোকাইন উৎপাদন করার প্রক্রিয়াকে “সাইটোকাইন স্টোর্ম” বলা হয়। সাইটোকাইন স্টোর্মের ফলে রোগীর দেহে অতিরিক্ত জ¦র, খুবই নিম্ন রক্তচাপ, রক্ত জমাট বাধা, অক্সিজেনের অভাব, রক্তের পিএইচ কমে যাওয়া এবং ফুসফুসে তরল (হায়ালিন মেমব্রেন) জমা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়।
শ্বেত রক্তকণিকার কাজ হলো দেহের অভ্যন্তরে ক্ষতিকর কোনো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া ঢুকলে সেটি শনাক্ত করা এবং মেরে ফেলা বা কার্যকারিতা নষ্ট করে দেওয়া কিন্তু করোনা আক্রান্ত রোগীর দেহে অতিরিক্ত শ্বেত রক্তকনিকা উৎপন্ন হয় যা ক্ষতিকর ভাইরাসকে মারার পরও প্রচুর পরিমানে অবশিষ্ট থেকে যায়।
এই অবশিষ্ট শ্বেত রক্তকনিকা গুলো দেহের সুস্থ্য কোষগুলো বিশেষ করে ফুসফুসের কোষগুলো মেরে ফেলতে শুরু করে ফলে ফুসফুসে তরল (হায়ালিন মেমবব্রেন) জমতে শুরু করে যা অক্সিজেন পরিবহনে বাধা প্রদান করে এজন্য রোগীর শ্বাসকষ্ট শুরু হয় খুবই তীব্র আকারে। এছাড়া দেহের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ধরনের সুস্থ্য কোষ মেরে ফেলে ফলে আরো কিছু উপসর্গ দেখা দেয় যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই ঘটনা গুলো ঘটে তীব্রআক্রান্ত (সিভিয়ার) রোগীর ক্ষেত্রে। কিন্তু করোনা আক্রান্ত বেশীরভাগ রোগীই মিল্ড অবস্থায় থাকে। আর ডেক্সামিথাসোন ব্যবহার করা হয়েছে সিভিয়ার রোগীর ক্ষেত্রে তাদের “সাইটোকাইন স্টোর্ম” প্রতিরোধ করার জন্য যাতে ফুসফুস ও দেহের অন্যান্য কোষগুলো ধ্বংস না হয় এবং দেহে অক্সিজেন পরিবহনে বাধার সৃষ্টি না হয়। অর্থাৎ, ডেক্সামিথাসোন দেহের শ্বেত রক্তকণিকার পরিমান কমিয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তার মানে হলো মিল্ড রোগীর ক্ষেত্রে ডেক্সামিথোসেন ব্যবহার করা হলে রোগীর রোগ প্রতিরোধ কমে যাবে যা রোগীর মৃত্যুঝুকি বাড়িয়ে দেবে।
সুতরাং এটি শুধুমাত্র সিভিয়ার রোগীর ক্ষেত্রে ডেক্সামিথাসোন প্রযোজ্য। এছাড়া এই ঔষধ ব্যবহারের আরো কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে যেমন অতিরিক্ত ওজন, অস্টিপোরোসিস, হাত পা ফোলা, ডায়াবেটিস বেড়ে যাওয়া, উচ্চ রক্তচাপ ও ক্ষুধা বাড়া ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে। তাই আসুন ডেক্সামিথাসোনের যত্রতত্র ব্যবহার পরিহার করি। নিজেরা ডাক্তার না হই। সচেতন থাকি, সুস্থভাবে বাঁচি।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, জীববিজ্ঞান অনুষদ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।