তারুণ্যের ভাবনা: বঙ্গবন্ধু, বাঙালি ও বাংলাদেশ

আবু জাফর আহমেদ মুকুল


আমার জন্ম বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রায় এক দশক পরে। বঙ্গবন্ধুকে আমি দেখিনি। খুব বেশি জানার সুযোগও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার ছিল না। স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে বঙ্গবন্ধুকে ঠিক যেভাবে পাওয়ার কথা ছিল, সেভাবে কখনো পাইনি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পড়া আমার প্রথম বই ‘মুজিবরের বাড়ি’।

সময়টা সম্ভবত ১৯৯৪ সালে আমি যখন ৬ষ্ট শ্রেনীতে পড়ি। সেই গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন লিখেছিলেন, ‘শত চেষ্টা করেও বাঙালির মন থেকে দুজন বাঙালির নাম মুছে ফেলা যাবে না। এমনই শক্তি ও দুটি নামের। এদের একজন হলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যিনি বাংলা ভাষাকে পরিচিত করেছিলেন বিশ্ব দরবারে। যাঁর গান আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। আরেকজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। যাঁর নেতৃত্বে বাঙালি প্রথম আলাদা একটি ভূখণ্ড নির্মাণ করতে পেরেছিল।’

এ বছর ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা-ডিআইটিএফ ২০২০ ঘুরে হঠাৎ দেখি একটি প্যাভিলিয়নে উপচেপড়া তরুণদের ভিড়। আমি ও আমার পরিবার একটু পথ এগিয়ে যেতে দেখি তরুণদের ভিড় সামলাতে ব্যস্ত স্বেচ্ছাসেবীগন। হয়তো ভাবতে পারেন এটি প্যাভিলনের কেনা-কাটার ভিড়। আসলে তরুণদের উপচে পড়া ভিড় ছিল বঙ্গবন্ধু প্যাভিলিয়নে।

পর্যবেক্ষণ করছিলাম মেলায় আসা অধিকাংশ তরুণ দর্শনার্থী প্যাভিলিয়নটি ঘুরে ঘুরে দেখছেন। তাদের অনেকেই বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালের সঙ্গে ছবি তুলছেন। অনেকে আবার প্যাভিলিয়নের মধ্যে বই পড়ে সময় পার করছেন। মেলায় এসে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে পেরে আনন্দিত আমার এক শিক্ষার্থী স্বপ্না আক্তার বলেন- এখানে বঙ্গবন্ধুর কিছু দুর্লভ ছবি দেখে ভালো লেগেছে।

বিশেষ করে এ প্যাভিলিয়নে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যে ভিডিও চিত্র দেখানো হয়েছে, তা আমার হৃদয় ছুঁয়েছে। কথাটি শুনে মন ভরে গেল এই ভেবে যে, সত্যিই তরুণ প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুকে ধারন করতে চায়। বঙ্গবন্ধু কোন নির্দিষ্ট দলের নয়, বঙ্গবন্ধু সকলের। তরুণ প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধু প্যাভিলিয়নের প্রবেশ দ্বারেই ছিল বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল। ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়ছিল আর্টিফিশিয়াল (কাঠের তৈরি) বই। যেখানে বঙ্গবন্ধুর নানা কথা তুলে ধরা হয়েছে। এর পাশে রয়েছে, সারিবদ্ধ একাধিক সেলফ, যেখানে সাজানো আছে জাতির পিতার ওপর লেখা নানা বই। মেলায় আগতরা যাতে বই পড়ে বঙ্গবন্ধুকে আরও ভালো করে জানার জন্য রাখা হয়েছে টেবিলও।

পুরো প্যাভিলিয়নজুড়ে ছিল- বঙ্গবন্ধুর নানা উক্তি এবং তাকে নিয়ে নানা লেখা। প্যাভিলিয়নের পশ্চিম দেয়ালে ঠাঁই পেয়েছিল শেখ পরিবার। যেখানে আছে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের পারিবারিক ছবি, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ছবিসহ নানা ধরনের দুর্লভ ছবি।
বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ ও বাঙালি শব্দগুলো একই সূত্রে গাঁথা। বর্তমান তরুণ সমাজে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না যে বঙ্গবন্ধুকে চেনে না। আর চিনবেই বা না কেন? তার মহান আত্মত্যাগের ফলেই জন্ম হয়েছে বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের।

বঙ্গবন্ধুর যে দুটি বই এখন অনেক পাঠকের হাতে দেখতে পাই—অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা, সে দুটিতে তারুণ্যের ওপর বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস এবং তাঁর নিজের তরুণ জীবনের সংগ্রামের ইতিহাস অত্যন্ত অন্তরঙ্গভাবে তিনি লিখে গেছেন। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো, অভয় মানো—তিনি তরুণদের বলছেন; যেখানে অন্যায়, অবিচার সেখানে প্রতিবাদ করো; মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ক্ষমতার এবং স্বার্থের ঘর বড় করে, তাদের প্রতিরোধ করো।

বঙ্গবন্ধু জীবনের প্রায় বেশিরভাগ সময় কারাগারে কাটিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী পড়ে আমরা জানতে পেরেছি, তার চিন্তা-চেতনা ছিল তারুণ্যকেন্দ্রিক। সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ও আবেগই পরবর্তী সময়ে প্রতিবাদী রূপ ধারণ করে তার মন ও মননে সূচনা ঘটিয়েছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের।

বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন, অধিকার পেতে হলে নীরব থাকলে চলবে না; সবাইকে জাগাতে হবে, তাদের মনে গেঁথে দিতে হবে স্বাধীনতার মন্ত্র।
বাংলার মাটি ও মানুষের হৃদয়ে যে নামটি চিরস্মরণীয় ও উজ্জল নক্ষত্রের মতো চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি হলেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা।

বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে লিখেছেন-‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এ নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’
তরুণদের সঙ্গে একটা অন্তরের সম্পর্ক ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। তিনি তাঁদের সংগ্রামের বাণী দিতেন, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সক্রিয়তায় উৎসাহিত করতেন, শিক্ষা এবং শিক্ষার আদর্শগুলো নিজেদের জীবনে ধারণ করার জন্য অনুপ্রাণিত করতেন।

তরুণদের তিনি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে, অসত্য, অর্ধসত্যকে প্রত্যাখ্যান করতে, বঞ্চনা-অনাচার এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে উদ্দীপনা জোগাতেন। তিনি চাইতেন বাঙালি তরুণ যুগের আদর্শগুলো ধরে রেখে বিশ্বমানব হোক। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুটি ছাত্র আন্দোলন সারা দেশের তরুণদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন শুরু হয়, তরুণেরা বঙ্গবন্ধু থেকে প্রেরণা নিয়েছিল। নিরাপদ সড়কের দাবিতে যে আন্দোলন হলো, তাতেও শিক্ষার্থীরা পোস্টার লিখে জানাল, তারা প্রতিবাদী হওয়ার সাহস বঙ্গবন্ধু থেকে নিয়েছে। বর্তমান তরুণদের মনে রাখা দরকার, বঙ্গবন্ধু ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা থেকে শুরু করে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পূর্ব দিন পর্যন্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন।

মুজিবের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল ১৯৩৯ সালে মিশনারি স্কুলে পড়ার সময় থেকেই। এ বছর স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন তদানীন্তন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং পরবর্তীতে বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং এমনকি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী হোসেন মো, শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী। তিনি স্কুলের ছাদ সংস্কারের দাবির উপর ভিত্তি করে একটি দল নিয়ে তাদের কাছে যান যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি নিজেই।

১৯৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু যখন ঢাকার রেসকোর্স মাঠে বাঙালির স্বাধীনতার ডাক দিলেন, দেশের মানুষকে প্রস্তুত হওয়ার বার্তা দিলেন, তা সারা দেশে সব মানুষের কাছে পৌঁছে গেল। তিনি উক্ত ভাষণ বিকেল ২টা ৪৫ মিনিটে শুরু করে বিকেল ৩টা ৩ মিনিটে শেষ করেন। উক্ত ভাষণ ১৮ মিনিট স্থায়ী হয়।

ভাষণে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) বাঙালিদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। ২০১৭ সালের অক্টোবরের শেষে ইউনেস্কো ৭ই মার্চের ভাষণকে “ডকুমেন্টারী হেরিটেজ” (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

এজন্যই বঙ্গবন্ধুকে বর্ণনা করতে গেলে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর উক্তি সবার আগে মনে পড়বে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, তার সিদ্ধান্ত, অবিচলতা নিয়ে বলতে গিয়ে ক্যাস্ট্রো বলেন,‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনি হিমালয়ের মতো।

আজ শোকাবহ ১৫ আগস্ট। পেছন ফিরে আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখি আর তাঁর কথা শুনি। তাঁর কথাগুলো এখন তরুণেরা শুনছে, পড়ছে। তারা অনুপ্রাণিত হচ্ছে। তারা যে বাংলাদেশ চায়, বঙ্গবন্ধুও সেই দেশটি চেয়েছিলেন এবং তার একটি বর্ণনা তিনি দিয়েছিলেন, ‘সোনার বাংলা।’

বঙ্গবন্ধু চেয়েছেন বাংলার মানুষ একতাবদ্ধভাবে থাকবে। সুন্দরভাবে হাসি-খুশিতে জীবনযাপন করবে। বর্তমান প্রজন্ম চেষ্টা করবে জাতির জনকের এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখতে। বঙ্গবন্ধু নিজেও বিশ্বাস করতেন তরুণরাই দেশের মূল চালক। তাই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্য নিয়ে বর্তমান প্রজন্মকে এক হতে হবে এবং দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। তবেই বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসা সার্থক হবে।

তথ্যসূত্রঃ দেশি ও বিদেশি বই-প্রবন্ধ, নির্ভরযোগ্য ওয়েবসাইট ও পর্যবেক্ষণ।

লেখক: শিক্ষাবিদ, বিশ্লেষক, ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ, গবেষণায় প্রধানমন্ত্রীর ফেলোশীপ প্রাপ্ত এবং প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ‘আগামীর বাংলাদেশ’।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ

Leave a Comment