থানায় মামলা নিতে না চাইলে কী করবেন?

ধরুন,আপনার সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। এতে করে প্রতিহিংসায় পাশের বাড়ির/গ্রামের/ইউনিয়ন পরিষদের নেতার দ্বারা বা তার প্ররোচনায় অন্য কারো দ্বারা আপনার সন্তান মারধরের শিকার হয়েছেন। এ বিষয়ে নিকটস্থ থানায় মামলা করতে গেছেন। কিন্তু পুলিশ আপনার মামলা নিতে চাইছে না। সে ক্ষেত্রে কী করবেন?

অনেক ক্ষেত্রে দেখা কারণে অকারণে থানা কর্তৃপক্ষ মামলা নিতে চায় না। সে ক্ষেত্রে আপনি দুঃচিন্তা না করে আদালতের দ্বারস্থ হলে খুব সহজেই মামলা করে প্রতিকার নিতে পারবেন। এ ছাড়া আমলযোগ্য অপরাধ সংঘটনের পর কেউ থানায় মামলা করতে চাইলে পুলিশ বিনামূল্যে সে মামলা নিতে বাধ্য। কিন্তু বাস্তবে প্রায়ই এমন অভিযোগ শোনা যায় যে, থানা কর্তৃপক্ষ মামলা নিতে চায় না।এক্ষেত্রে অবশ্যই আপনার সমস্যার প্রতিকার আছে।
যেভাবে মামলা করবেন:
থানা কর্তৃপক্ষ যদি মামলা নিতে না চায়, তাহলে সরাসরি এখতিয়ার ভুক্ত বিচারিক হাকিমের আদালতে নালিশি অভিযোগ দায়ের করে উক্ত অপরাধের বিচার চেয়ে মামলা করা যায়। আর সংঘটিত অপরাধ আমল অযোগ্য হলে সব সময়ই এখতিয়ার ভুক্ত ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নালিশি মামলা দায়ের করতে হয়।
আমল অযোগ্য অপরাধ হলো যেসব অপরাধ সংঘটনের কারণে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে না এবং এসব অপরাধ বিষয়ে তদন্ত করতেও সংশ্লিষ্ট বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের পূর্বানুমতির প্রয়োজন।
কোনটি আমলযোগ্য এবং কোনটি আমল অযোগ্য অপরাধ, তা ফৌজদারি কার্যবিধির ২য় তফসিলের ৩য় কলামে ব্যাখ্যা করা আছে।
ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী নালিশ মানে হলো কোনো অপরাধ সংঘটন বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার নিমিত্তে মৌখিক বা লিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট বিচারিক হাকিমের কাছে আবেদন জানানো।
যদি কোনো আমল অযোগ্য অপরাধ সংঘটনের খবর কেউ সংশ্লিষ্ট থানায় নিয়ে যায়, তবে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বিষয়টি সাধারণ ডায়েরিতে (জিডি) লিপিবদ্ধ করে অভিযোগসহ অভিযোগকারীকে, মহানগরের ক্ষেত্রে মুখ্য মহানগর হাকিম বা মহানগর হাকিম এবং মহানগরের বাইরের এলাকার ক্ষেত্রে মুখ্য বিচারিক হাকিম বা কোনো প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট অথবা বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের, কাছে পাঠাবেন। এ ক্ষেত্রে থানায় না গিয়ে সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গিয়েও লিখিত বা মৌখিকভাবে অভিযোগ জানিয়ে প্রতিকারের আবেদন করা যায়।
অথবা পুলিশ যদি আমলযোগ্য অপরাধ সংঘটনের পর থানায় এজাহার নিতে রাজি না হয়, সে ক্ষেত্রেও সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নালিশি মামলা করা যাবে।
ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে কিভবে অভিযোগ করবেনঃ
ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে মৌখিকভাবে অভিযোগের ক্ষেত্রে বিস্তারিত ঘটনা আদালতে খুলে বলতে হবে এবং কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আবেদন করতে হবে।
এরপর দায়েরকৃত অভিযোগটির কোনো ভিত্তি আছে কি না, তা পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে এখতিয়ার ভুক্ত বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগকারীকে এবং প্রয়োজনে সাক্ষী থাকলে তাঁদের শপথের মাধ্যমে পরীক্ষা করবেন। পরীক্ষার সারসংক্ষেপ লিখে তিনি নিজে, অভিযোগকারীর এবং সাক্ষীর(যদি থাকে) স্বাক্ষর নেবেন।তবে যদি অভিযোগটি লিখিত হয় তবে এ ধরনের পরীক্ষার প্রয়োজন নেই।
ম্যাজিস্ট্রেট ওই পরীক্ষায় সন্তুষ্ট হলে বা লিখিত অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগটিকে একটি সিআর কেস নম্বর (Complaint Register case number) বা সিআরপি কেস নম্বর (Complaint Register Petition case number) দিয়ে নথিভুক্ত করবেন। এ জন্য একে সিআর মামলাও বলে।
তবে শপথ পরীক্ষার সময় যদি অপরাধ সংঘটন বিষয়ে অভিযোগকারীর বক্তব্যে সন্তুষ্ট না হন অথবা যদি অভিযোগকারী মামলার ভিত্তি (Prima facie) প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন, তবে ম্যাজিস্ট্রেট মামলাটি আমলে না নিয়ে আবেদনটি খারিজ করে দিতে পারেন।
নালিশি পিটিশনটি খারিজ হলে অভিযোগকারী খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে দায়রা জজ আদালতে বা সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে উক্তাদেশ ঘোষণার ৬০ দিনের মধ্যে রিভিশনের জন্য আবেদন করতে পারেন।
আর যদি অভিযোগটি আমলে নেয় সেক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট বিবাদীপক্ষের বিরুদ্ধে সমন জারি করে আদালতে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য উপস্থাপনের নির্দেশ দিবেন অথবা আমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে নিতে থানাকে নির্দেশ দিবেন।
ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে আদেশপ্রাপ্ত হলে পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগটি থানায় এজাহার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে মামলার জন্য প্রয়োজনীয় পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।
আবার,অআমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট সত্যতা যাচাইয়ের জন্য পুলিশকে তদন্তের নির্দেশ দিতে পারেন।
এ ক্ষেত্রেও আদেশপ্রাপ্তের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ তদন্ত শুরু করবে।
অভিযোগের তদন্ত শেষে পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিবেন।এক্ষেত্রে প্রতিবেদনে সমস্যা থাকলে অভিযোগকারী উক্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি দিতে পারেন। অর্থাৎ পুলিশ প্রতিবেদনে তিনি কেন সন্তুষ্ট নন, আদালতে সে কারণ দর্শিয়ে অভিযোগটির পুনঃতদন্তের আবেদন করতে পারেন।
এক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগটির সত্যতা বা অধিকতর তদন্তের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত করার উদ্দেশ্যে তিনি নিজে বা তাঁর অধস্তন অন্য কোনো ম্যাজিস্ট্রেটকে বিষয়টি তদন্ত করার নির্দেশ দিতে পারেন। অভিযোগটির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছ থেকেও তদন্তকাজে সাহায্য নিতে পারেন।
ফৌজদারি কার্যবিধি ১৫৪(১) উপধারা অনুযায়ী থানা এজাহার নিতে বাধ্য। যদি গ্রহণ করতে অস্বীকার করে তাহলে পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্ট (এস. পি.) এর নিকট অভিযোগ দায়ের করা যায়।পুলিশ প্রবিধান আইনের ৪২ ধারায় কর্তব্য অবহেলার জন্য সর্বোচ্চ তিন মাসের শাস্তির বিধানও আছে। যদি থানা কোনক্রমেই এজাহার গ্রহণ না করে তাহলে সংশ্লিষ্ট এখতিয়ার ভুক্ত ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে যথাযথ প্রক্রিয়ায় নালিশ দেওয়া যায়। নালিশসহ আবেদনকারী আদালতে উপস্থিত হলে ম্যাজিস্ট্রেট ২০০ এবং ১৫৫ ধারার অধীনে আবেদনকারীকে শপথের মাধ্যমে পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হলে বিষয়টা তদন্তের জন্য আদেশ দিতে পারেন, আবার ভিত্তিহীন বলে আবেদন বাতিল করে দিতে পারেন।
এছাড়া আমাদের দেশে বেশ কয়েকটা মানবাধিকার সংগঠন আছে। থানা এজাহার না নিলে তাদের কাছেও আবেদন করা যেতে পারে।
লেখক
মোঃখায়রুল ইসলাম
শিক্ষার্থী
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *