দিদি আউট, না অলআউট!

মোঃ মেজবাহুল ইসলামঃ পৃথিবীর বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে সুদীর্ঘ দিন থেকে ভারতের সুখ্যাতি রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সরকারী বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে ভারতের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ব্যাপক আশংকা ক্রমশ বেড়েই চলছে।

এরেই মাঝে ভারতের রাজনীতির অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ পশ্চিমবঙ্গের ১৭তম বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের দামামা বেজে উঠেছে।ভূ-রাজনৈতিক কারণে কলকাতার বিধানসভার নির্বাচন বাংলাদেশের জনগণের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

এবারের বিধানসভার লড়াইকে কেন্দ্র করে ভারতের অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে তুলনামূলক অসাম্প্রদায়িক রাজ্য কলকাতার এবারের নির্বাচনের মুল হাতিয়ারই হলো উগ্র সাম্প্রদায়িকতা।

বামশক্তি সিপিএম দীর্ঘ ৩৪ বছর নানা ঘটনা মধ্যেই নানাভাবে রং বদলিয়ে কলকাতার মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনের চাবি পায় মমতা ব্যানাজী।ভারতীয় রাজনৈতিক ইতিহাসে এবার পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের উত্তাপ বেশ প্রখর।সেই ইলিয়াস শাহের আমল থেকেই বাংলা ও বাঙ্গালী পৃথিবীর একটি অসাম্প্রদায়িক জাতি হিসেবে সমাদৃত।

দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া ভারতে পূর্বে বেশ কয়েকটি ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলে তার প্রভাব সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়লেও পশ্চিম বাংলায় তার ঢেউ তেমন একটা তরঙ্গায়িত হয়নি।

রাজনৈতিক দলগুলো বরাবরই অসাম্প্রদায়িক চিন্তাধারা লালন করেছিল।সাম্প্রদয়িক দলগুলোও তেমন সুবিধা করতে পারেনি।২০১৬ সালে কট্টরপন্থী হিন্দুবাদী দল বি.জে.পি ক্ষমতায় আসলে শুধু ভারতেই নয় পুরো উপমহাদেশের রাজনীতির ইকুয়েশন অনেকটা পরিবর্তিত হয়।

ধীরে ধীরে বি.জে.পি তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি সারা ভারতে শুরু করে দেয়।পশ্চিমবঙ্গে তাদের শক্তি ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে।বিগত লোকসভা নির্বাচনে মমতার খাস তালুকেই ৪২ টির মধ্যে ১৮ টি আসন লাভ করে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়।

এরপরেই বিধানসভা নির্বাচনে কলকাতার চাবিকাঠি নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য বি.জে.পির শীর্ষ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ প্রায়শই পশ্চিমবঙ্গে এসে সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দিয়ে হিন্দু মেজোরিটি ভোটের দিকেই বিশেষ নজর দিচ্ছে। ভারতীয় রাজনীতির ডার্কসাইড হলো রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দলবদল।

এবার বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এ লজ্জাজনক ইতিহাস অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙে একটি লজ্জাজনক ইতিহাস ভারতের রাজনীতিতে সুনামির ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে।

তৃণমূল কংগ্রেসের স্টার ক্যাম্পেইনার মমতার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা সিঙ্গুর আন্দোলনের মূল হোতা শুভেন্দু অধিকারী এবার বিজেপির সবচেয়ে বড় টার্মকার্ড। তাকে দলে বাগিয়ে নিয়ে একের পর এক তৃণমূলের জনপ্রিয় পোড়খাওয়া নেতাদের দলে ভিড়িয়ে বেশ চাঙ্গা মেজাজেই নির্বাচনি সমাবেশ করেছে বিজেপি।

এছাড়া টালিগঞ্জের জনপ্রিয় মিডিয়া তারকাদের দলে ভিড়িয়ে তাদের টিকিট দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চাচ্ছে বিজেপি।২০১১ সালে সিপিএম এর পতন ঘটিয়ে মমতা বন্দোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসে রাজ্যের বৃহৎ সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন মাওবাদীদের শক্তহাতে প্রতিহত করে রাজ্যের উন্নয়নের দিকে নজর দেয়।

যার ফলে ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়।মমতার সরকার দ্বিতীয় টার্মে ক্ষমতায় এসে কন্যাশ্রী, খাদ্যসাথী, স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের মাধ্যমে পুরো ভারতের মানুষের নজর কাড়ে।

বাংলাদেশের আলোচিত সমালোচিত নারায়নগঞ্জের সাংসদ শামীম ওসমানের “খেলা হবে ডায়লগটিই এবার পশ্চিমবঙ্গের মূল ডায়লগ। পশ্চিমবঙ্গের ৩০ শতাংশ ভোট মুসলিমদের। যা একসময় কংগ্রেস, একসময় বাংলা কংগ্রেস, আবার প্রায় ৩৪ বছর এ ভোটটি বামপন্থীরাই পায়। এই মুসলিম ভোটই মূলত কলকাতা বিধানসভার চাবি কার কাছে যাবে তা নিয়ন্ত্রণ করে।

লাগাতার আন্দোলন করে ৩৪ বছরের বামদুর্গ ২০১১ সালে ভেঙে তছনছ করে মমতা বন্দোপাধ্যায়, সেবার মুসলিমরা ব্যালট বাক্স ভরিয়ে দিয়েছিল জোড়াফুলে।মমতাও তাদের যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া শুরু করে।তাদের ইমাম ভাতা,মুয়াজ্জিন ভাতা,নতুন নতুন মসজিদ নির্মাণ করে তাদের মন জয় করে নেয়।

এই মুসলিমদের ভোটেই মূলত ২০১৬ সালে আবারও ক্ষমতায় আসে তৃণমূল কংগ্রেস।এবারও মুসলিমরা জোড়াফুলের প্রধান এবং রিজার্ভ ভোট।কিন্তু এই মুসলিম ভোটে ভাগ বসানোর জন্য হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন ভারতের ৩য় গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান হুগলী জেলার ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী যিনি ভাইজান হিসেবেই সর্বধিক পরিচিত।

ফুরফুরা শরিফ অতীতে কখনোই প্রকাশ্যে রাজনীতি করেনি তবে তারা তাদের প্রভাব ভোটের মাঠে শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয় পুরো ভারতে কম-বেশি কাজে লাগাত।নাগরিকত্ব বিল সিএএ ও এনআরসিকে কেন্দ্র করে ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী ভাইজান মাঠে সরব ভূমিকা পালন করে।তিনি মুসলিমদের নিরাপত্তার জন্য মমতা ব্যানার্জীকে চলমান বিধানসভা নির্বাচনে তাকে ৪৪টি আসন দেয়ার প্রস্তাব দেন।

যা তৃণমূল সুপ্রিমো সরাসরি নাকচ করে দেন।এরপরেই ভাইজান একের পর এক ধর্মীয় সভা আহবান করে তৃণমূল ও মমতার একহাত নেন।মুসলিম জনগণের সামনে তিনি উঁচু গলায় বলেন -মুসলিমদের আর তৃণমূল আর কংগ্রেস নিয়ে পড়ে থাকলে হবেনা, এখন মুসলিমদেরই নিজেদের দল গঠন করতে হবে না হলে বিজেপি তাদের দেশ ছাড়া করবে।

এভাবে তিনি হুগলী,মালদা,উত্তর -দক্ষিণ দিনাজপুরের বিভিন্ন স্থানে জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়ে বেড়ান।প্রত্যেকটি সভায় চোখ ধাঁধানো জনসমাগম তৃণমূলের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী ভাইজান পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ সৃষ্টি করে তার দল ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট(আইএসএফ) গঠন করে যার সভাপতি বানান একজন হিন্দুকে।

অপরদিকে ভারতীয় উপমহাদেশের চির অসাম্প্রদায়িক দল কংগ্রেস এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালনকারী বামদের সাথে আইএসএফ নির্বাচনী জোট গঠন করে। যা সকলের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।এর পাশাপাশি আব্বাস সিদ্দিকীর একক দৃঢ়তায় সংযুক্ত মোর্চাকে নিয়ে কলকাতায় ইতিহাস সেরা বিগ্রেড সমাবেশ করে।যা মূলত তৃণমূলের জন্য মহাচিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

তৃণমূল বরাবরই অভিযোগ করে আসছিল আব্বাস সিদ্দিকী ব্যারিস্টার আাসাউদ্দিন ওয়াইসির মতো বিজেপির বি টিম, বিজেপির দালাল ও ভোট কাটুয়া।বিধানসভার ২৯৪ টি আসনের মধ্যে ২১৮টিতে হিন্দু ভোট মেজোরিটি এবং ৮২টি কেন্দ্রে মুসলিম ভোট মেজোরিটি।

এই ৮২টি আসনে বরাবরই নির্ভার থাকে তৃণমূল তবে এবার গলার কাটা ভাইজান।বিজেপি এই ৮২ টি আসনে তেমন গুরুত্ব না দিয়ে পুরো নির্বাচন কালীন সময়ে নরেন্দ্র মোদি,যোগী আদিত্যনাথ,নির্বাচন মাস্টার অমিত শাহকে নিয়ে বিশাল বিশাল নির্বাচনী জনসমাবেশ করে।যেখানে তারা উগ্র সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দেয় এবং জনগণকে সাবধান করে দেয় এবার যদি তৃণমূল আসে তবে মুসলিম গুন্ডারা হিন্দুদের ধুতি,মালা এবং হিন্দুত্ব চিহ্ন মুছে দিবে।

এছাড়া বাংলাদেশ বিরোধী বক্তব্য পুরো নির্বাচন সময় জুড়েই ছিল।তৃণমূলের নির্বাচনী স্ট্যান্ডবাজী ছিল ১০বছর তাদের সুদীর্ঘ তালিকার উন্নয়ন কার্যক্রম।ভারতের বর্তমান দশকের রহস্যময়ী পুরুষ প্রশান্ত কিশোর বা পিকে যিনি মমতা ব্যানার্জীসহ বিভিন্ন রাজ্যের বৃহৎ দলগুলোর অ্যাডভাইজার।

প্রত্যেকটি দল তার এ্যাসাইনমেন্ট অনুযায়ী কাজ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছে।এবারের বিধানসভা নির্বাচনের প্রায় বছর খানেক আগে তিনি বলেছিলেন বিজেপি ১০০ আসন পেলে তিনি রাজনৈতিক কার্যক্রম ছেড়ে দিবেন এবং এ পেশা চিরতরে ছেড়ে দিবেন এবং তিনি এ বক্তব্যে অটুট আছেন আজ অব্দী।বুথ ফেরত সমীক্ষা বলছে তৃণমূল সরকার গঠন করতে যাচ্ছে তবে তারা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না।

অপরদিকে বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে বিজেপি ১১০/১১৫টি আসন পেতে পারে এবং সংযুক্ত মোর্চা ২০/২২টি আসন পেতে পারে।যদি তৃণমূল ১৮০ এর নিচে আসন পায় তবে তারা জিতেও হেরে যাবে।কারণ বিজেপির মতো উগ্রবাদী দল যদি ১১০+ আসন পায় তবে তারা রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে পুরো মেয়াদে তৃণমূলের নাভিশ্বাস বৃদ্ধি করে ছাড়বে।

অপরদিকে বিজেপি যদি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় তবে বাঙালির অসাম্প্রদায়িকতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।যদি বিজেপি ১০০+ আসন পায় তবে তারা হেরেও জিতে যাবে।আরেক সাম্প্রদায়িক শক্তি অসাম্প্রদায়িকতার মোড়কে থাকা আব্বাস সিদ্দিকী ভাইজানের মনোনীত প্রার্থী যদি ২০+ আসন পায় তবে ধরে নিতে হবে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমরা তাদের জাত ভাইদের কাছ থেকেই নেতৃত চাচ্ছে।

তৃণমূল আসলে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কের উন্নতি অবনতি দুটোই হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।তবে যদি বিজেপি সাদা দুর্গের চাবি পায় তবে হিংসার আগুনে জ্বলে উঠবে পুরো পশ্চিমবঙ্গ।এবারের নির্বাচনে বিজেপির অনেক প্রার্থীর উপর তৃণমূলের বিশেষ করে মুসলিম সমর্থকবৃন্দ বিনা উসকানিতে হামলা করে।

ক্ষমতায় আরোহণের সাথে সাথেই বিজেপি এসব হামলার প্রতিশোধ নিবে এবং তা সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় রূপ নিবে।যার আঁচ এপার বাংলায় আসবে এবং তা আসতে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ দু বাংলাকেই উসকানি দিবে।বিজেপির কলকাতায় বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক অপকৌশল।

বিজয়ী দলের জন্য অগ্রিম অভিনন্দন।

লেখকঃ সহ-সভাপতি,
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ

Leave a Comment