দীর্ঘকালীন করোনা: বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইনাল পরীক্ষার মূল্যায়ন জরুরি

ড. মো. মাহবুবুল আলম
আবু জাফর আহমদ মুকুল


গত ৩০ এপ্রিল, ২০২০ইং শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সভাপতিত্বে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত সভায় করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস, পরীক্ষা, মূল্যায়ন ও ভর্তি কার্যক্রম শুরুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

করোনা মহামারীর কারণে দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় সীমিত আকারে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বৈশ্বিক মহামারীর সময় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন কার্যক্রম শুরু করেছে।

করোনা মহামারীর কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে দেশের অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, দেরিতে হলেও সিদ্ধান্তটি সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত।

তবে শুধু অনলাইনে ক্লাস নয়, পরীক্ষার্থীদের মূল্যায়নেরও ব্যবস্থা থাকতে হবে অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থায়, নতুবা শিক্ষার্থীদের দীর্ঘমেয়াদী সেশনজটে পড়তে হবে, নষ্ট হয়ে যাবে মূল্যবান সময়। করোনার এই মহামারীর মধ্যেও কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বপ্রণোদিত হয়ে অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম পরিচালনার করছেন।

অর্থাৎ প্রতিকূল অবস্থায়ও শিক্ষা কার্যক্রমকে স্বাভাবিক রাখতে সকলে নিজ নিজ অবস্থান থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে পাঠদান কতটুকু সার্থক হলো তার সার্থকতা নির্ভর করে একটি সুষ্ঠু মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার ওপর। স্বাভাবিক অবস্থায় মূল্যায়ন পদ্ধতি আর বর্তমান পরিবর্তিত অবস্থায় মূল্যায়নের মধ্যে বিশাল ব্যবধান রয়েছে।

পাঠদান যতই ইতিবাচক হোক তা দেখে পাঠদান কতটুকু ফলপ্রসূ হয়েছে তা ধারণা করার সুযোগ নেই। এর জন্য একটি মূল্যায়ন প্রক্রিয়া অবশ্যই অবলম্বন করতে হবে। তবে পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় মূল্যায়ন পদ্ধতিতে সমন্বয় করা অতীব জরুরী। সঠিক মূল্যায়ন পদ্ধতির অভাব এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনভিজ্ঞতা শিক্ষা-শিক্ষার্থী-দুই পক্ষের জন্যই ক্ষতির কারণ হতে পারে।

আমাদের দেশে যে পরীক্ষা পদ্ধতি তা একেবারেই প্রথাগত ও আনুষ্ঠানিক। সুতরাং তার মূল্যায়ন পদ্ধতিও কাঠামোবদ্ধ। প্রক্রিয়াটি সারাদেশে মোটামুটি একই রকম তা হলো- প্রশ্নের মাধ্যমে খাতায় লিখে প্রশ্নোত্তর পদ্ধতি। কোন কোন কোর্সে হয়ত কিছু প্রেজেন্টেশন, গ্রুপ ওয়ার্ক, প্রজেক্ট ইত্যাদি থাকে।

বছরের পর বছর ধরে আমাদের শিক্ষক -শিক্ষার্থীরা একটা গতানুগতিক পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। সুতরাং এর বাহিরে কোন এ্যাসেসমেন্ট পদ্ধতি অবলম্বনের চিন্তা করলে স্বাভাবিক ভাবেই আপত্তি উঠবে। কিন্তু মনে রাখা জরুরী প্রয়োজন অনুযায়ী রেসপন্স বা প্রতিক্রিয়া দেখানো অতি জরুরী, যদি আমরা মূল্যবান সময় নষ্ট করতে না চাই।

লেখকদ্বয় বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত নাগরিক যারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষকতা করছেন, তাদের সাথে কথা বলেছেন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার এই স্থবিরতা কাটিয়ে উঠার উপায় নিয়ে। আসলে উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে আমাদের পার্থক্য হলো, উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের শিক্ষকদের পূর্ণস্বাধীনতা দেয় এ্যাসেসমেন্ট পদ্ধতি নিজ উপায়ে ঠিক করে নিতে। কোর্সের কনটেন্ট, শিক্ষন উদ্দেশ্য, শিক্ষন পদ্ধতি-তার উপর ভিত্তি করে একজন শিক্ষক তার মূল্যায়নের ধরন ঠিক করেন।

আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিন্তু সেরকম করে চলে না। এখানকার মূল্যায়ন পদ্ধতি অনেকখানি কাঠামোবদ্ধ। শিক্ষক নিজে থেকে মূল্যায়ন পদ্ধতি পরিবর্তন করার এখতিয়ার রাখেন না। কোন পদ্ধতি পরিবর্তনে বিভাগীয় কমিটির সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কমিটির সভায় সংখ্যাগরিষ্ট সদস্যদের অনুমোদন সাপেক্ষে শুধু সেটি পরিবর্তন করা সম্ভব।

বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইন কুইজ, এ্যাসাইনমেন্ট, গ্রুপ প্রজেক্ট, প্রেজেন্টেশন, ভাইভ-এরকম বিভিন্ন পদ্ধতির সমন্বয়ে তাদের এ্যাসেসমেন্ট পদ্ধতি চালু রেখেছে। এই পদ্ধতিগুলোর সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে আপদকালীন ব্যবস্থা হিসাবে এই পদ্ধতিগুলোর উপর নির্ভর করা যেতে পারে।

বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা ভিডিও রেকর্ডিং করে ল্যাবের বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের মাঝে উপস্থাপন করছেন। এ্যাসেসমেন্টের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগুলো উপস্থাপনা বা ভাইভা বা এমন কোন সমস্যা দিচ্ছেন যা শিক্ষার্থী নিজের বাসায় করে ভিডিও এর মাধ্যমে শিক্ষকের কাছে জমা দিতে পারছেন।

তবে এই প্রক্রিয়ায় এ্যাসাইনমেন্ট সিলেকশনের ক্ষেত্রে শিক্ষককে যথেষ্ট মুনশিয়ানা আর অভিজ্ঞতার পরিচয় দিতে হবে। এমন সমস্যা নিরূপণ করতে হবে যা শিক্ষা কন্টেন্ট, পদ্ধতির সাথে একই সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিন্তু একই সাথে ইউনিক, যাতে শিক্ষার্থীরা পরস্পরের কাছ থেকে কপি বা নকল করতে না পারে। আসলে এই ধরনের এ্যাসাইনমেন্ট একজন শিক্ষার্থী প্রবলেম সলভিং বা সমস্যা নিরূপনে এতটা দক্ষ তা বুঝাতে সাহায্যে করে।

অনলাইন মাধ্যমে শিক্ষা ও মূল্যায়ন – সবচেয়ে কঠিন হলো টেকনিক্যাল বিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য। কিন্তু আপদকালীন সমাধান হিসাবে ভাইভা, রেকর্ডেড কন্টেন্ট, ভার্চুয়াল ল্যাব, কম্প্রেহেমসিভ পরীক্ষা পদ্ধতি হতে পারে সঠিক সমাধান। মনে রাখা প্রয়োজন আমাদের দেশে ইন্টারনেট স্পীড বা কোয়ালিটি সমভাবে বিস্তৃত নয়। তার উপর আছে বিদ্যুৎ এর আসা-যাওয়া। সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের জন্য সমাধান হলো, কুইজের ক্ষেত্রে মোবাইল ডাটা ব্যবহার করা। যাতে পরীক্ষাকালীন সময়ে টেস্টটা কোন সমস্যা ছাড়া শেষ করা যায়।

অন্যদিকে শিক্ষকদের জন্য সমাধান হলো, বই বা শিক্ষা উপকরণ থেকে সরাসরি প্রশ্ন না দিয়ে, শিক্ষার্থীদের বিষয়বস্তু বোঝার ও ব্যবহার করার দক্ষতার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে তথাকথিত প্রোক্টোরিং বা পরীক্ষা পরিদর্শনের প্রশ্নটি গৌণ হয়ে পড়ে।

আশার কথা হলো, প্রথমদিকে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারকেরা অনলাইন শিক্ষা নিয়ে আগ্রহী না হলেও, দেরীতে হলেও তারা এই মাধ্যমে ক্লাস শুরু করেছে। যার জন্য তারা অবশ্যই সাধুবাদ পাবার যোগ্য। কিন্তু তাদের মাঝে এখনও অনলাইন পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে অনাগ্রহ বা নেতিবাচক মনোভাব পরিলক্ষিত।

পরিশেষে বলতে চাই, শুধু অনলাইনভিত্তিক পাঠদান করলে শিক্ষার্থীরা খুব একটা মনোযোগী হবে না। হয়ত যে উৎসাহ শিক্ষার্থীদের মাঝে দেখা যাচ্ছে অনলাইনে ক্লাস অধিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে। দীর্ঘদিন পরীক্ষার অনুপস্থিতি তাদের এই উৎসাহে ডাটা পড়তে পারে। লাগাতার পড়াশোনা বিমুখ থাকার ফলে তাদের ভেতরের অন্তর্নিহিত প্রতিভার বিকাশ বাধাগ্রস্থ হবে এবং ধারাবাহিকতা না থাকলে পরবর্তী সময়ে পড়াশোনার প্রতি অনীহা সৃষ্টি হবে।

তাই নির্দিষ্ট সিলেবাসের ভিত্তিতে একটি মূল্যায়ন ব্যবস্থা দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। যখন নীতিমালার অধীনে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হবে। তখন সকলের মধ্যে মূল্যায়নের প্রতি তাড়না সৃষ্টি হবে। কেবল তখন একটি অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থার সময়োপযোগী সমাধান সর্বমহলে ইতিবাচক ফল আনবে।

এই বিষয়ে কালক্ষেপণ না করে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা গেলে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকলে উপকৃত হবেন বলে আশা করা যায়।

লেখকবৃন্দ: ড.মো. মাহবুবুল আলম, অধ্যাপক ও আবু জাফর আহমদ মুকুল, সহকারী অধ্যাপক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *