দেশ ভ্রমণ রচনা – পরীক্ষায় ১০০% কমন

দেশ ভ্রমণ অনেকের নেশা। তারা অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার নেশায় ছুটে বেড়ায় পৃথিবীর এক কোণ থেকে আরেক কোণে। বিপুলা এই পৃথিবীর পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, আগ্নেয়গিরি আরও কত কি আছে দেখার। শুধুমাত্র ঘরকুনো না হয়ে ক্ষুদ্র সীমানার মধ্যে বন্দী হয়ে না থেকে আমাদের উচিত দেশ ভ্রমণ করে এই বিশ্ব সংসারের রূপ উপভোগ করা। চলো, আজকে এ সম্পর্কে রচনাটি জেনে নিই।

দেশ ভ্রমণ

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,

সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে

অনেক ঘুরেছি আমি। —–জীবনানন্দ দাশ

ভূমিকা

অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার আকাঙ্ক্ষায় মানুষের মন সদাই উন্মুক্ত। মুক্ত বিহঙ্গের মত সে ছুটে যেতে চায় সংসারের সংকীর্ণ ছাড়িয়ে অবাধ মুক্তির মধ্যে। ক্ষুদ্র সীমানার মধ্যে বন্দি হয়ে থাকা মানুষের ধর্ম নয়। বিরাট বিশ্বের অন্তহীন অসংখ্য বৈচিত্র্য ছড়িয়ে আছে পাহাড়ে পর্বতে, নদীনির্ঝরে, অরণ্য কান্ডারে বৈচিত্র্য ছড়িয়ে আছে অসংখ্য মানুষের জীবন যাপনের বিচিত্র ধারায় আর সমাজ সংস্কৃতিতে। সব কিছুকে জানার কৌতূহলই মানুষকে টেনে এনেছে অনন্ত পথের ধূলায়। বিপুলা এ পৃথিবী প্রতিমুহূর্তে হাতছানি দিয়ে আহ্বান জানায় তাকে, আর সে আহবানে সাড়া দিয়েই মানুষ হয় চিরপথিক।

চলাই মানবজীবনের মূলমন্ত্র

মানুষ চির যাযাবরের মত। তার ধমনীর রক্তে আছে ভ্রমণের নেশা ও অজানাকে জানার অনন্ত জিজ্ঞাসা। তাই স্বভাবতই সে ভ্রমণবিলাসী।

সমুদ্র , নদী, পর্বত, মরু, উপবন শোভিত এ বিশাল বিপুল বিশ্ব মানুষের অন্তরকে প্রতিমুহূর্তে হাতছানি দিয়ে ভাকে। বিশ্বের এ বিশাল আয়োজনের সঙ্গে রয়েছে মানুষের অন্তরের একটি নিগূঢ় যোগসূত্র। উপনিষদের মধ্যে তাই উচ্চারিত হয়েছে পথ চলার মন্ত্র। চরৈবেতি। চরৈবেতি। এগিয়ে চল, এগিয়ে চল। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো চল, পাখির গানের মতো চল, প্রভাতের আলোর মত চল। বিপুল, বিশাল এ বিশ্বে গতিই সত্য, গতিহীনতায় আসে মৃত্যু। গতিময় জীবনের এ রহস্য উপলব্ধি করতে পেরেছে বলেই মানুষ অনন্তকাল ধরে এ সত্যকে মানবজীবনের মর্মবাণী করে নিয়েছে। সে চায় প্রকৃতির রূপ, রস, রহস্য ও সৌন্দর্যকে আস্বাদন করতে, মানবজীবনের অজানা কথা উন্মোচন করতে। আর এরই আকর্ষণে দেশ ভ্রমণের পালা।

ভ্রমণের আনন্দ

মানুষ চিরপথিক, পথ চলতেই তার আনন্দ। মানুষের স্বভাবগত নেশা ভ্রমণ থেকে মানুষ বিচিত্র আনন্দ পায়। দেশ দেশান্তরে ভ্রমণের মাধ্যমেই মানুষ তার মনের সৌন্দর্য পিপাসাকে চরিতার্থ করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ নানা কারণে আকর্ষণ করে রসিকজনদের। ভূপর্যটন তাদের কাছে গভীর আনন্দের প্রতীক। প্রকৃতি যে অন্তহীন সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসে আছে, একমাত্র দেশ ভ্রমণের মাধ্যমে তা পরিপূর্ণভাবে উপভোগ এবং আনন্দ লাভ করা সম্ভব হয়। আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে অবাধ চলার সুযোগ করে দিয়েছে বলেই মানুষ আজ সহজেই পারে প্রকৃতি জগতের আনন্দলীলার বৈচিত্র্য উপভোগ করতে। অতীতের মানুষ দেশ ভ্রমণ করত কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো পশুর ওপর সওয়ার হয়ে কিংবা পশুবাহিত মন্থর গতির যানবাহন বা পালতোলা জলযানে চড়ে। নতুন নতুন জনপদ ও সভ্যতা সংস্কৃতির আকর্ষণে মানুষ এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেত। এভাবে মানষ নানা দেশ ভ্রমণ করে লাভ করেছে বিচিত্র অভিজ্ঞতা এবং অপার আনন্দ।

শিক্ষার অঙ্গরূপে দেশ ভ্রমণ

শুধু আনন্দ লাভের আকাঙ্ক্ষাই নয়, শিক্ষালাভের আকাঙ্ক্ষাও দেশ ভ্রমণের অন্যতম উদ্দেশ্য। শিক্ষার অন্যতম অঙ্গ হলো দেশ ভ্রমণ। স্কুল কলেজের বই পড়ে মানুষ বা শিক্ষার্থী যে জ্ঞান অর্জন করে তা পরোক্ষ, কিন্তু দেশ ভ্রমণের মাধ্যমে সে পায় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ন্ধ জ্ঞান। বিশেষ করে ভূগোলের প্রকৃত শিক্ষা বই পড়ে লাভ করা যায় না। পৃথিবী মানে তো আর মানচিত্রের কতকগুলো মৃতরেখা নয়, দেশ মানেও নয় ভূগোলের নিষ্প্রাণ বিবৃতি। পৃথিবী বহু মানুষের কলরব মুখরিত সঞ্জীব সুন্দর বিচিত্র বিস্ময় এবং দেশ রক্তমাংসের মানুষের হাসি কান্নার সংমিশ্রিত শ্যামল শোভন প্রাণোচ্ছল ভূখণ্ড। তাই কেবল ইতিহাস ও ভূগোলের পাঠই জ্ঞানলাভের পরিপূর্ণতা আনতে পারে না। প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ করতে হলে যেতে হবে দেশ ভ্রমণে। দেশ ভ্রমণের মাধ্যমে মানুষ পায় সজীব মানুষের সান্নিধ্য, প্রকৃতির প্রত্যক্ষ অনুষঙ্গে পায় অপার আনন্দ, লাভ করে প্রকৃত শিক্ষা। ঐতিহাসিক, সামাজিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ঘটনাবলির সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপন করার অথবা ঐতিহ্যানুসরণ করার অন্যতম উপায় হচ্ছে দেশ ভ্রমণ। যুগ-যুগান্তর ধরে মানুষের ধর্মীয় স্থান বা তীর্থ ভ্রমণের ইতিবৃত্তও অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনা ও দূরকে কাছে টানার বাসনারই ফলশ্রুতি। ইতিহাস, ভূগোলের বাইরে অবাধ উন্মুক্ত আকাশের নীচে জীবন্ত দেশটি দেখে, তার অধিবাসীদের প্রত্যক্ষ স্পর্শ লাভ করে তাদের জীবনধারা সম্পর্কে মানুষ যে জ্ঞান লাভ করে সেই জ্ঞানই প্রকৃত জ্ঞান, প্রকৃত শিক্ষা।

ভ্রমণে মানবসভ্যতার সমৃদ্ধি

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটকের দল দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার পেরিয়ে পৌঁছেছে দেশ দেশান্তরে। প্রখ্যাত পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ, ফা-হিয়েন, মেগাস্থিনিস, ইবনে বতুতা, ভাস্কো-দা-গামা, সিভিংস্টোন, মার্কো পোলো, কলম্বাস, ক্যাপ্টেন কুক কিংবা আমাদের দেশের অতীশ দীপঙ্কর এমনিভাবেই সভ্যতা সংস্কৃতির সম্যক জ্ঞানলাভের আশায়, কিংবা অজানা ভূখণ্ডকে আবিষ্কারের আকাঙ্ক্ষায় ভয়কে তুচ্ছ করে পাড়ি জমিয়েছেন অজানার পথে। প্রাণ বাজি রেখে অচেনা পথে পাড়ি দিয়েছিলেন বলেই অনেক অজানা দেশ, পাহাড়-পর্বত, মরুভূমি, মরূদেশ কিংবা অনেক ধ্বংসপ্রাপ্ত সভ্যতার স্মারক হয়েছে আবিষ্কৃত, মানুষের জ্ঞানের ভাণ্ডার হয়েছে পূর্ণ, মানবসভ্যতা হয়েছে সমৃদ্ধ। আন্তর্জাতিক মৈত্রী এবং সৌভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধনেও সুদূরপ্রসারী ভূমিকা গ্রহণ করেছে দেশ ভ্রমণ।

জাতীয় সংহতি স্থাপনে দেশ ভ্রমণ

আধুনিক বিশ্বের মানুষ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ ও পর্যটনকে গ্রহণ করেছে শিল্প হিসেবে। এ পর্যটনের উন্নতির জন্যে তাই শুরু হয়েছে নানামুখী প্রচেষ্টা। পথ ও পরিবহনের উন্নতির জন্যে যেমন নানা কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে, তেমনি গৃহীত হয়েছে পর্যটকদের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির ব্যবস্থা। দেশে দেশে ট্যুরিস্ট ব্যুরো স্থাপিত হওয়ায় পর্যটকদের সুবিধা বেড়েছে। ফলে আজ নানা দেশের মানুষের সঙ্গে গড়ে উঠেছে সৌভ্রাতৃত্বের সহজ- সুন্দর সম্পর্ক, ব্যবসায়-বাণিজ্যের হচ্ছে সম্প্রসারণ। শুধু আনন্দ লাভই দেশ ভ্রমণের একমাত্র ফলশ্রুতি নয়, মনের প্রসারতা, হৃদয়ের ব্যাপ্তি ও সে সঙ্গে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে অখণ্ড সংহতি সৃষ্টিও দেশ ভ্রমণের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ফল। ভ্রমণের মাধ্যমে পারস্পরিক বন্ধুত্বের মধ্যস্থতায় বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে যে একটা অখণ্ড ভাবমূলক সংহতি গড়ে ওঠে, তা জাতীয় সংহতির পক্ষে, মানবিক সৌভ্রাতৃত্ববোধের উনোষের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

উপসংহার

সারা পৃথিবীতেই দেশ ভ্রমণের জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমান। জাতিসংঘও দেশ ভ্রমণকে ‘বিশ্ব শান্তির ছাড়পত্র’ বলে অভিহিত করে বিশ্ববাসীর কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। তাই আজ পৃথিবীর দেশে দেশে অসংখ্য ভ্রমণ বিলাসীর দল বিশ্বের অজানা, অচেনাকে জানবার জন্যে ঘর ছেড়ে বের হয়ে পড়েছে দিকে দিকে। ভ্রমণের গুরুত্ব আজ সব দেশেই স্বীকৃত। আনন্দের উৎস হিসেবে এবং সেই সূত্রে শিক্ষার অঙ্গরূপেও দেশ ভ্রমণের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। শিক্ষার্থীদের গৃহকোণে বন্দি না থেকে সুযোগ পেলেই বাইরের পৃথিবীকে জানতে হবে জ্ঞান বৃদ্ধির জন্যে। তবেই প্রত্যক্ষ শিক্ষার মধ্য দিয়ে জ্ঞানের দীনতা ঘুচে যাবে এবং কৌতূহল হবে চরিতার্থ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *