নতুন প্রজন্মের প্রেরণা রাবির ‘শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা’

অধ্যাপক ড. আনন্দ কুমার সাহা


১৯৮৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর আমানুল্লাহ আহমদ এবং ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৯০ সালে তা উদ্বোধন করেন শহীদ শিক্ষকপত্নী বেগম ওয়াহিদা রহমান, বেগম মাসতুরা খানম এবং শ্রীমতি চম্পা সমাদ্দার।

চারকক্ষ বিশিষ্ট ভবনটির সর্বত্র সুরুচির ছাপ বিদ্যমান। খোলা বারান্দার বিশাল পরিসরে ফ্রেমবন্দী বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের গাম্ভীর্যপূর্ণ আলোকচিত্র প্রথমেই উদ্দীপ্ত করে তোলে দর্শকদের।

একইসাথে মহান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও খেতাবপ্রাপ্ত বীরশ্রেষ্ঠ, বীরউত্তম, বীরবিক্রম ও বীরপ্রতীকদের নামের তালিকাসহ আলোকচিত্র শোভা পাচ্ছে সংগ্রহশালার বাইরের দেয়ালে- যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাঁথাকে।

সম্প্রতি শহীদ ড. শামসুজ্জোহা এবং জাতীয় চারনেতার অন্যতম এ.এইচ.এম কামারুজ্জামানের আরও ২টি পোট্রেট সংযোজিত হয়েছে। শিল্পী বিপ্লব দত্ত। অত্যন্ত চমৎকারভাবে শিল্পী পোট্রেট ২টি রংতুলিতে ফুটিয়ে তুলেছেন। অসাধারণ হয়েছে ড. শামসুজ্জোহার পোট্রেটটি।

গ্যালারী-১

এ গ্যালারিটিকে সাজানো হয়েছে ভাষা আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের নানা স্মারক দিয়ে। দরজা দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীদের সাদা-কালো ছবি। মাঝখানে বিশাল বড় একটি বঙ্গবন্ধুর পোট্রেট।

এ ছবিতেও রংতুলি দিয়েছেন শিল্পী বিপ্লব দত্ত। বঙ্গবন্ধুর চমৎকার ছবিটি ভীষণ আকৃষ্ট করে। না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না- একজন শিল্পী এত চমৎকার ছবি আঁকতে পারেন। এক নম্বর গ্যালারিতে ঢুকতেই ডানদিকে যার ছবি প্রথমেই দেখা যায় তিনি হচ্ছেন ড. শামসুজ্জোহা। শহীদ ড. শামসুজ্জোহা বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্বের প্রতীক।

তিনি বলেছিলেন “আমি বলছি গুলি বর্ষণ হবে না যদি গুলিবর্ষণ হয় তবে কারো গায়ে লাগার পূর্বেই সেটা আমার গায়ে লাগবে”- তেমনটাই সত্য হয়েছিল। ১৯৬৯ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি পাকবাহিনীর পুলিশের গুলিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে তিনি শহীদ হন। এই জায়গাটি দৃষ্টিনন্দন করার চেষ্টা করা হয়েছে। মার্বেল পাথরে বর্ণনা করা হয়েছে জোহার স্মৃতি। অর্নামেন্টাল প্লান্ট দ্বারা সাজানো হয়েছে ড. জোহার গুলিতে আহত হওয়ার স্থানটি। উক্ত স্থানটি আন্তরিকতার মাধ্যমে পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করা হয়ে থাকে।

ডাকটিকেট হলো যে কোনো জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য। বঙ্গবন্ধুর উপর ডাকটিকিটগুলো সংগ্রহ করেছিলেন ফোকলোর বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. উদয় শংকর বিশ্বাস। তিনি এগুলো শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালাকে দান করেছেন। এ ধরনের সংগ্রহ বাংলাদেশের অন্য কোন মিউজিয়ামে আছে কি-না সন্দেহ। শিক্ষার্থী বন্ধুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসলে অবশ্যই দর্শন করবে শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা।

আলোকচিত্রে বঙ্গবন্ধু: তিন নম্বর গ্যালারির মূল আকর্ষণ বঙ্গবন্ধুর নানান আলোকচিত্র। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন ও ব্যক্তিজীবনের নানা মুহূর্তের ছবি রয়েছে এ গ্যালারিতে। ১৯৭২ সালের ৯ই মে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই ঐতিহাসিক ঘটনাটি ক্যামেরাবন্দী করা হয়েছিল যে ক্যামেরা দিয়ে-তাও আছে এখানে।

বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে বঙ্গবন্ধু কিভাবে পরিচিত করেছিলেন তা উদ্ভাসিত হয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, চীনের মাও-সে-তুং, কিউবার ফিদেল ক্যাস্ত্রো, রাশিয়ার নেতা ব্রেজনেভ প্রমুখ বিশ্বনেতাদের সাথে তাঁর অন্তরঙ্গ সব ছবিতে। মা-বাবার স্নেহস্পর্শ, সন্তানদের ভালোবাসার দুর্লভ মুহূর্তসমূহ ফ্রেমবন্দী আছে সাদা-কালো অসংখ্য আলোকচিত্রে।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লীকবি জসীম উদ্দীন, গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যয়, বিজ্ঞানী কুদরাত-এ-খুদা প্রমুখ মনীষীর সাথে বঙ্গবন্ধুর যেসব ছবি রয়েছে তার মাধ্যমে খুব সহজেই বোঝা যায় তাঁর বিশাল হৃদয়ের কথা।

“যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।
দিকে দিকে আজ অশ্রুমালা রক্তগঙ্গা বহমান
তবু নাই ভয় হবে হবে জয়, জয় মুজিবুর রহমান।” ©অন্নদাশঙ্কর রায়

স্বাধীনতার মহান স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যার প্রজ্ঞা ও দক্ষ নেতৃত্বের কারণে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র, লাল-সবুজের পতাকা এবং বিশ্ব দরবারে মর্যাদার আসন। বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম, ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সাংস্কৃতিক দর্শন জনসাধারণের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। জাতির জনকের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা প্রকাশের দায়বদ্ধতা থেকে শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালার চতুর্থ গ্যালারিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু কর্ণার’।

এখানে রয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের উপর রচিত প্রায় চার সহস্রাধিক মূল্যবান গ্রন্থ, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বঙ্গবন্ধুর উপর রচিত নয় শতাধিক গ্রন্থ, ছবি এবং মুর‍্যালসহ নানা স্মারক। এসব দেখে বা বঙ্গবন্ধু সংশ্লিষ্ট বই পড়ে মহান এ নেতার বর্ণাঢ্য জীবন, পাহাড়সম ব্যক্তিত্ব, সুবিশাল রাজনৈতিক ইতিহাস খুব সহজেই জানা যাবে।

মহিলা বীরপ্রতীক: বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীরাও কম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেনি। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তিন জন নারী মুক্তিযোদ্ধাকে বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত করেছে।

বীরপ্রতীক ডা. সিতারা বেগম (১৯৪৫-) বীরপ্রতীক ডা. ক্যাপ্টেন (অব.) সিতারা বেগমের বড় ভাই মেজর হায়দার ছিলেন আরেক মহান মুক্তিযোদ্ধা; যিনি ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের দিন জেনারেল নিয়াজিকে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণ স্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন (অব.) সিতারার স্বামী ডা. আবিদুর রহমানও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন।

বীরপ্রতীক তারামন বিবি (১৯৫৭-১৯১৮) তারামন বিবি কুড়িগ্রাম জেলার রাজীবপুর উপজেলার শঙমাধবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তারামন বিবি মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র পরিস্কার করা, পাকিস্তানিদের ক্যাম্প থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রান্না-বান্না করে দেওয়ার পাশাপাশি রাইফেল ও মেশিনগান চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে শত্রুদের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৮ সালের ১লা ডিসেম্বর তারামন বিবি মৃত্যুবরণ করেন।

বীরপ্রতীক কাঁকন বিবি (-২০১৮)
খাসিয়া পরিবারের মেয়ে কাঁকন বিবি। ১৯৯৯ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কীর্তিময়ী নারীকে বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত করেন। ২১শে মার্চ ২০১৮ তারিখে সিলেট এম.এ.জি. ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

উইলিয়াম এ.এস. ওডারল্যান্ড (১৯১৭-২০০১) উইলিয়াম এ.এস. ওডারল্যান্ড একমাত্র বিদেশি যিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালের আগস্ট মাসে বাটা সু কোম্পানি লিমিটেড এর প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে ওডারল্যান্ড যোগ দেন। স্ত্রী এবং সন্তানকে দেশে পাঠিয়ে তিনি যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। লুকিয়ে লুকিয়ে পাকিস্তানি পশুদের হত্যাযজ্ঞের ছবি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পত্র-পত্রিকায় পাঠাতে থাকেন। ওডারল্যান্ড এদেশের জন্য যে ত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা ইতিহাসে বিরল।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালায় মহান মুক্তিযুদ্ধের বহু স্মৃতি সংগ্রহ করা আছে। বীরশ্রেষ্ঠ, বীরউত্তম, বীরবিক্রম, বীরপ্রতীক, সেক্টর কমান্ডার, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিচিহ্নসহ মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি পশুদের বর্বরোচিত নির্যাতনের অনেক ছবি রয়েছে শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালায়।

স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের যে অবদান রয়েছে, সেই অবদানকে স্মরণ করে রাখার জন্য রয়েছে প্রচুর স্মৃতিচিহ্ন। আমার বিশ্বাস শিক্ষার্থী বন্ধুরা শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালায় এলে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে একটি পরিচ্ছন্ন ধারণা পাবে।

বিশ্বাস করি শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ফিরে এলে শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা দর্শন করতে ভুল করবে না।

লেখক: উপ-উপাচার্য
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *